ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
ইসলামী জীবন-ধারা বেশভূষার আদব আবদুল হামীদ ফাইযী
৯। পরিহিত লেবাস (পায়জামা, প্যান্ট্, লুঙ্গি, কামীস প্রভৃতি) যেন পায়ের গোড়ালীর নিচে না যায়

মহানবী (ﷺ) বলেন,

مَا أَسْفَلَ مِنْ الْكَعْبَيْنِ مِنْ الْإِزَارِ فَفِي النَّارِ

‘‘গোড়ালীর নিচের অংশ লুঙ্গির (অঙ্গ) জাহান্নামে।’’[1] ‘‘মু’মিনের লুঙ্গি পায়ের অর্ধেকরলা পর্যন্ত। এই (অর্ধেক রলা) থেকে গোড়ালী পর্যন্ত অংশের যে কোনও জায়গায় হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু এর নিচের অংশ দোযখে যাবে।’’ এরূপ ৩ বার বলে তিনি পুনরায় বললেন, ‘‘আর কিয়ামতের দিন আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি তাকিয়েও দেখবেন না, যে অহংকারের সাথে নিজের লুঙ্গি (গোড়ালীর নিচে) ছেঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়।’’[2]

প্রকাশ থাকে যে, পুরুষদের জন্য কাপড় গোড়ালীর উপর থেকে নিয়ে পায়ের রলার অর্ধেক অংশ পর্যন্ত উঠিয়ে পড়া সুন্নাত। অবশ্য যেখানে প্রসিদ্ধি, রিয়া ও বিদ্রুপের ভয় আছে সেখানে বেশী তুলে লুঙ্গি বা পায়জামা পরা উচিত নয়।

যেমন পায়ের রলায় গোদ বা শীর্ণতা অথবা গোড়ালীর আশেপাশে কোন ত্রুটি ঢাকার জন্যও গোড়ালীর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরা বৈধ নয়।[3]

আল্লাহর রাসুল (ﷺ) এর সবচেয়ে বেশী পছন্দনীয় লেবাস ছিল কামীস (ফুল-হাতা প্রায় গোড়ালীর উপর পর্যন্ত লম্বা জামা বিশেষ)।[4] যেমন তিনি চেক-কাটা চাদর পরতে ভালোবাসতেন।[5]

তিনি মাথায় ব্যবহার করতেন পাগড়ী।[6] তিনি কালো রঙের পাগড়ীও বাঁধতেন।[7] আল্লাহর রাসুল (ﷺ) ও সাহাবা তথা সালাফদের যুগে টুপীও প্রচলিত ছিল।[8]

যেমন সে যুগে শেলোয়ার বা পায়জামাও পরিচিত ছিল। রাসুল (ﷺ) ও পায়জামা খরিদ করেছিলেন।[9] তিনি ইহরাম বাঁধা অবস্থায় হাজীদেরকে পায়জামা পরতে নিষেধ করেছেন।[10] অবশ্য লুঙ্গি না পাওয়া গেলে পায়জামা পরতে অনুমতি দিয়েছেন।[11]

ইবনে আব্বাস (রাঃ) যখন লুঙ্গি পরতেন, তখন লুঙ্গির সামনের দিকের নিচের অংশ পায়ের পাতার উপর ঝুলিয়ে দিতেন এবং পেছন দিকটা (গোড়ালীর) উপরে তুলে নিতেন। এরূপ পরার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (ﷺ) কে এরূপ পরতে দেখেছি।’[12]

তাঁর নিকট পোশাকের সবচেয়ে পছন্দনীয় রঙ ছিল সাদা। তিনি বলেন, ‘‘তোমরা সাদা কাপড় পরিধান কর। কারণ সাদা রঙের কাপড় বেশী পবিত্র থাকে। আর ঐ রঙের কাপড়েই তোমাদের মাইয়্যেতকে কাফন দাও।’’[13]

এ ছাড়া সবুজ রঙের কাপড়ও তিনি ব্যবহার করতেন।[14] এবং লাল রঙেরও লেবাস পরিধান করতেন।[15]

মুহাদ্দিস আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘লাল রঙের কাপড় ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেয়।’[16]

রঙের মধ্যে হলুদ বা জাফরানী রঙ ব্যবহার পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ।

লেবাসে-পোশাকে সাদা-সিধে থাকা ঈমানের পরিচায়ক।[17] মহানবী (ﷺ) বলেন, ‘‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিনয় সহকারে সৌন্দর্যময় কাপড় পরা ত্যাগ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতে সৃষ্টির সামনে ডেকে এখতিয়ার দেবেন; ঈমানের লেবাসের মধ্যে তার যেটা ইচ্ছা সেটাই পরতে পারবে।[18]

তবে সুন্দর লেবাস পরা যে নিষিদ্ধ তা নয়। কারণ, ‘‘আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। বান্দাকে তিনি যে নেয়ামত দান করেছেন তার চিহ্ন (তার দেহে) দেখতে পছন্দ করেন। আর তিনি দারিদ্র ও (লোকচক্ষু) দরিদ্র সাজাকে ঘৃণা করেন।’’[19] প্রিয় রসূল (ﷺ) বলেন,

« لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ ». قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً. قَالَ « إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ ».

‘‘যার অন্তরে অণু পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে জান্নাত প্রবেশ করবে না।’’ বলা হল, ‘লোকে তো চায় যে, তার পোশাকটা সুন্দর হোক, তার জুতোটা সুন্দর হোক। (তাহলে সেটাও কি ঐ পর্যায়ে পড়বে?)’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার তো ‘হক’ (ন্যায় ও সত্য) প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে ঘৃণা করার নাম।’’[20]

তিনি আরো বলেন, ‘‘উত্তম আদর্শ, উত্তম বেশভূষা এবং মিতাচারিতা নবুওতের ২৫ অংশের অন্যতম অংশ।’’[21]

আল্লাহর রসূল (ﷺ) এক ব্যক্তির মাথায় এলোমেলো চুল দেখে বললেন, ‘‘এর কি এমন কিছুও নেই, যার দ্বারা মাথার এলোমেলো চুলগুলোকে সোজা করে (আঁচড়ে) নেয়?!’’ আর এক ব্যক্তির পরনে ময়লা কাপড় দেখে বললেন, ‘‘এর কি এমন কিছুও নেই, যার দ্বারা ময়লা কাপড়কে পরিষ্কার করে নেয়?!’’[22]


আবুল আহওয়াস বলেন, একদা আমি আল্লাহর রাসুল (ﷺ) এর নিকট এলাম। আমার পরনে ছিল নেহাতই নিম্নমানের কাপড়। তিনি তা দেখে আমাকে বললেন, ‘‘তোমার কি মাল-ধন আছে?’’ আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ।’ বললেন, ‘‘কোন্ শ্রেণীর মাল আছে?’’ আমি বললাম, ‘সকল শ্রেণীরই মাল আমার নিকট মজুদ। আল্লাহ আমাকে উট, গরু, ছাগল, ভেঁড়া, ঘোড়া ও ক্রীতদাস দান করেছেন।’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ যখন তোমাকে এত মাল দান করেছেন, তখন আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত ও অনুগ্রহ তোমার বেশ-ভূষায় প্রকাশ পাওয়া উচিত।’’[23] পক্ষান্তরে খুব ভালো পোশাক পরার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করে তা কেউ ত্যাগ করে, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সৃষ্টির সামনে ডেকে ঈমানের জোড়া পোশাক তার পছন্দমত পরতে দেবেন।[24] ইসলাম বিলাসিতা ও অপচয় পছন্দ করে না। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ

অর্থাৎ, হে আদম সন্তানগণ! প্রত্যেক নামাযের সময় তোমরা সুন্দর পরিচছদ পরিধান কর। পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।[25] রাসুল (ﷺ) বলেছেন,

«كُلُوا، وَتَصَدَّقُوا، وَالْبَسُوا فِي غَيْرِ إِسْرَافٍ، وَلَا مَخِيلَةٍ»

‘‘তোমরা খাও, পান কর, দান কর, পরিধান কর, তবে তাতে যেন অপচয় ও অহংকার না থাকে।’’[26]

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, ‘‘যা ইচ্ছা তাই খাও এবং যেমন ইচ্ছা তেমনিই পর, তবে তাতে যেন দু’টি জিনিস না থাকে; অপচয় ও অহংকার।’’[27]

এই জন্য পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার বৈধ নয়; ছোট বাচ্চাদের জন্যও নয়। গলায় চেন পরাতে এমনিই মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বন হয়। আর সোনার হলে তা ডবল হারাম। হালাল নয়, সোনার বোতাম, আংটি, কলম ইত্যাদি ব্যবহার করা। মহানবী (ﷺ) বলেন, ‘‘সোনা ও রেশম আমার উম্মতের মহিলাদের জন্য হালাল এবং পুরুষদের জন্য হারাম করা হয়েছে।’’[28]

প্রকাশ থাকে যে, ব্যতিক্রমভাবে পুরুষের জন্য সোনার নাক বাঁধার অনুমতি রয়েছে ইসলামে। সাহাবী আরফাজার নাক কাটা গেলে রাসুল (ﷺ) তাঁকে সোনার নাক বানাতে আদেশ দিয়েছিলেন।[29]

প্রয়োজনে সোনার তার দিয়ে দাঁত বাঁধতে অথবা সোনার দাঁত বাঁধিয়ে ব্যবহার করাতেও অনুমতি আছে শরীয়তে।

১। যে কাপড়ে কোন বিচরণশীল প্রাণীর ছবি অথবা অমুসলিমদের প্রতীক চিত্রিত থাকে সে কাপড় পরা মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়। এমন কাপড় পরে নামায শুদ্ধ হয়ে গেলেও সে গোনাহগার হবে।[30]

২। কাপড় পরার সময় ডান দিক থেকে শুরু করুন। অর্থাৎ, ডান হাত ও পায়ে আগে কাপড় প্রবেশ করান।

৩। কাপড় পরার ও খোলার সময় নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করুন।[31]

৪। সতর্কতার বিষয় যে, অনেকে মডার্ন, আধুনিক বা মডেল পার্সন হতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের জন্য অথবা মা, বোন, স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের জন্য যে সব লেবাস-পোশাক ক্রয় করে, তার উপরে কি সব শব্দ বা বাক্য লিখা থাকে তা খেয়াল করে না। এক ব্যক্তি তার ছোট শিশু-পুত্রের সাথে বাজারে গিয়েছিল। হঠাৎ করে একজন জিজ্ঞাসা করে বসল, কি ব্যাপার ছেলেটির? (ছেলেটিকে বিক্রি করতে চান কেন?) কারণ, ছেলেটির শার্টের সম্মুখভাগে বড় অক্ষরে লিখা আছে, For Sale অর্থাৎ ছেলেটি বিক্রয়ের জন্য!!

অনুরূপই মহিলাদের বুকের উপর লিখা থাকে এমন সব কথা, যা অনেকে শুনতেও লজ্জাবোধ করবে। আবার এমন কথা লিখা থাকে যা একজন মুসলিমের ঈমান-বিরোধী অথবা শালীনতা ও রুচি-বিরোধী।

[1]. বুখারী, তাও হা:৫৪৮৭, মিশকাত হা/ ৪৩১৪

[2]. আবূ দাঊদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/ ৪৩৩১

[3]. সিলসিলাহ সহীহাহ ৬/৪০৫

[4]. আবূ দাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/ ৪৩২৮

[5]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/ ৪৩০৪

[6]. তিরমিযী, সহীহুল জা’মে হা/৪৬৭৬

[7]. আবূ দাঊদ হা/৪০৭৭, ইবনে মাজাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/৩৫৮৪

[8]. বুখারী, ফাতহুল বারী ১/৫৮৭, ৩/৮৬, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/৯২৫, আবূ দাঊদ হা/৬৯১

[9]. ইবনে মাজাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/২২২০, ২২২১

[10]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/ ২৬৭৮

[11]. ঐ ২৬৭৯

[12]. আবূ দাঊদ

[13]. আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/ ৪৩৩৭

[14]. আবূ দাঊদ হা/৪০৬৫

[15]. আবূ দাঊদ হা/৪০৭২, ইবনে মাজাহ ৩৫৯৯, ৩৬০০

[16]. মিশকাতের টীকা ২/১২৪৭

[17]. আবূ দাঊদ, মিশকাত হা/ ৪৩৪৫

[18]. তিরমিযী, হাকেম, সহীহুল জা’মে হা/৬১৪৫

[19]. বাইহাক্বী, সহীহুল জা’মে হা/১৭৪২

[20]. মুসলিম, আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা:২৭৫, সহীহুল জা’মে হা/৭৬৭৪

[21]. আহমাদ, আবূ দাঊদ, সহীহুল জা’মে হা/১৯৯৩

[22]. আহমাদ, আবূ দাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/ ৪৩৫১

[23]. আহমাদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/ ৪৩৫২

[24]. তিরমিযী, সহীহুল জা’মে হা/৬১৪৫

[25]. সূরা আ’রাফ-৭:৩১

[26]. বুখারী, মুসনাদে আহমাদ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/ ৬৬৯৫, নাসাঈ হা/ ২৫৫৯

[27]. বুখারী, মিশকাত হা/ ৪৩৮০

[28]. তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/ ৪৩৪১

[29]. মুসনাদে আহমাদ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/ ১৮৫২৭, আবূ দাঊদ হা/৪২৩২, তিরমিযী হা/১৭৭০, নাসাঈ হা/ ৫১৬১

[30]. ফাতাওয়াল লাজনাতিদ্ দায়িমাহ ৬/১৭৯, ১৮৩

[31]. দুআ ও জিকির দ্রষ্টব্য