ইসলামী শিক্ষার বরকতে দুনিয়াপূজারী মানুষগুলি হয়ে উঠলো আখেরাতের পূজারী। আখেরাতের বিনিময়ে তারা দুনিয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করল। যে কাজে আখেরাতে কল্যাণ নেই, সে কাজ পরিত্যক্ত হ’ল। সম্পদের প্রাচুর্য তাদেরকে দিকভ্রান্ত করতে পারেনি। বরং আখেরাতের স্বার্থে দ্বীনের কাজে অকাতরে সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতেই তারা অধিক আনন্দ বোধ করলেন। নিজের সবচেয়ে পসন্দের বস্ত্তটি দান করে দিয়ে তাঁরা মানসিক তৃপ্তি পেতেন। দিনের বেলা দাওয়াত ও জিহাদে কিংবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যস্ততায় সময় কাটলেও রাতটি ছিল স্রেফ আল্লাহর ইবাদতের জন্য নিবেদিত। যে মানুষটি দু’দিন আগেও আল্লাহকে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মূর্তির শরণাপন্ন হ’ত, মহামূল্য নযর-নেয়ায নিয়ে প্রাণহীন মূর্তির সন্তুষ্টিতে রত ছিল এবং নিজেদের কপোল কল্পিত বিভিন্ন অসীলার মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করত, সেই মানুষটিই এখন সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে সরাসরি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করছে। দেহমন ঢেলে দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি কামনায় রাত্রি জাগরণে ও ইবাদতে লিপ্ত হচ্ছে। দু’দিন আগেও যারা পথে-ঘাটে রাহাযানি করত, নারীর ইযযত লুট করত, তারাই আজ অপরের জান-মাল ও ইযযত রক্ষায় হাসিমুখে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। মানুষ এখন একাকী রাস্তায় নির্ভয়ে চলে। ইরাকের হীরা নগরী থেকে একজন পর্দানশীন গৃহবধু একাকী মক্কায় এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করে চলে যান নিরাপদে নির্বিঘ্নে। বিপদগ্রস্ত নারীকে শক্তিশালী একজন পরপুরুষ মায়ের মর্যাদা দিয়ে তার বিপদে সাহায্য করছে স্রেফ পরকালীন স্বার্থে।
দু’দিন আগেও যারা সূদ ব্যতীত কাউকে ঋণ দিত না, এখন তারাই সূদকে নিকৃষ্টতম হারাম গণ্য করছে এবং নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে ‘কর্যে হাসানাহ’ দিচ্ছে। যেখানে ছিল গাছতলা ও পাঁচতলার আকাশসম অর্থনৈতিক বৈষম্য, সেখানে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, যাকাত নেওয়ার মত হকদার খুঁজে পাওয়া যায় না। দু’দিন আগেও যে সমাজে ছিল মদ্যপান, নগ্নতা, বেহায়াপনা ও যৌনতার ছড়াছড়ি, আজ সেই সমাজে চালু হয়েছে পর্দানশীন, মার্জিত ও সুনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার। যে সমাজে ছিল ধর্মের নামে অসংখ্য শিরক-বিদ‘আত ও অর্থহীন লোকাচার। ছিল গোত্রে গোত্রে বিভক্তি ও হানাহানি। আজ সেখানে সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরে আদর্শিক মহববত ও ভালোবাসার অটুট বন্ধনের এক জান্নাতী আবহ। সবকিছুই সুন্নাহ দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত ও সুবিন্যস্ত। আগে যেখানে ছিল মানুষের মধ্যে প্রভু ও দাসের সম্পর্ক, ছোট-বড় ও সাদা-কালোর ভেদাভেদ। আজ সেখানে এক আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান। অর্থনৈতিক বৈষম্য, বংশীয় কৌলিন্য ও আভিজাত্যের অহংকারের বদলে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হ’ল আল্লাহভীরুতার মাপকাঠিতে। বলা হ’ল, সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী। তাই কারু কোন অহংকার নেই। বলা হ’ল সকলের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। তাই তাঁর প্রেরিত বিধান সকলের জন্য সমান। আগে যেখানে দুনিয়াবী ভোগবিলাস ছিল মূল লক্ষ্য। আজ সেখানে দুনিয়া তুচ্ছ, আখেরাতই মুখ্য।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের এই আমূল পরিবর্তনের ফলে মুসলমানদের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজনীতি সবকিছুতেই সূচিত হয় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। যা পুরা মানব সভ্যতায় আনে এক বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও বিজ্ঞানের অভাবিত উন্নতিতে পরবর্তীকালে মুসলমানদের যে অনন্য অবদানের স্বাক্ষর বিশ্ব অবলোকন করেছিল, তার মূলে ছিল ইসলামের তাওহীদী চেতনার অম্লান ছাপ। তার সর্বজয়ী আবেদনের বাস্তব প্রতিফলন। তাওহীদ ও সুন্নাহর সনিষ্ঠ অনুসারী হ’তে পারলে মুসলমান আবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘তোমরা হীনবল হয়োনা ও চিন্তান্বিত হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)।