নিয়মানুযায়ী গণীমতের এক পঞ্চমাংশ রেখে বাকী সব বণ্টন করে দেওয়া হয়। বণ্টনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘মুওয়াল্লাফাতুল কুলূব’(مؤلفة القلوب) অর্থাৎ মক্কার নওমুসলিম কুরায়েশ নেতৃবৃন্দের এবং অন্যান্য গোত্রনেতাদের মুখ বন্ধ করার নীতি অবলম্বন করেন। যাতে তাদের অন্তরে ইসলামের প্রভাব শক্তভাবে বসে যায়। সেমতে তাদেরকেই বড় বড় অংশ দেওয়া হয়। যেমন নেতাদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ইবনু হারবকে ৪০ উক্বিয়া রৌপ্য এবং ১০০ উট দেওয়া হয়। পরে তার দাবী মতে তার দুই পুত্র ইয়াযীদ ও মু‘আবিয়াকে ১০০টি করে উট দেওয়া হয়। হাকীম বিন হেযামকে প্রথমে ১০০টি পরে তার দাবী অনুযায়ী আরো ১০০টি উট দেওয়া হয়। ছাফওয়ান বিন উমাইয়াকে প্রথমে ১০০, পরে ১০০ পরে আরও ১০০ মোট ৩০০ উট দেওয়া হয়। তখন ছাফওয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন। ইতিপূর্বে তিনি আমার নিকট সবচাইতে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। অতঃপর তিনি আমাকে দিতে থাকেন। অবশেষে এখন তিনি আমার নিকটে সবচাইতে প্রিয় ব্যক্তি’ (মুসলিম হা/২৩১৩)।[1] ছাফওয়ান তখনও মুশরিক ছিলেন এবং রাসূল (ছাঃ) তাকে মক্কা বিজয়ের দিন থেকে চারমাস সময় দিয়েছিলেন। অতঃপর হারেছ বিন কালদাহকে ১০০ উট এবং অন্যান্য কুরায়েশ নেতাকেও একশ একশ করে উট দেওয়া হয়। অন্যদেরকে মর্যাদা অনুযায়ী পঞ্চাশ, চল্লিশ ইত্যাদি সংখ্যায় উট দিতে থাকেন। এমনকি এমন কথা রটে যায় যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) এত বেশী দান করছেন যে, কারু আর অভাব থাকবে না। এর ফলে বেদুঈনরা এসে এমন ভিড় জমালো যে, এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি গাছের নিকটে কোনঠাসা হয়ে পড়লেন। যাতে তাঁর গায়ের চাদরটা জড়িয়ে গেল। তখন তিনি বলে উঠলেনأيها الناس، رُدُّوْا عَلَيَّ رِدَائِي ‘হে লোকেরা! চাদরটা আমাকে ফিরিয়ে দাও’। যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তার কসম করে বলছি, যদি আমার নিকটে তেহামার বৃক্ষরাজি গণীমত হিসাবে থাকত, তাও আমি তোমাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতাম। তখন তোমরা আমাকে কৃপণ, কাপুরুষ বা মিথ্যাবাদী হিসাবে পেতে না’। তারপর স্বীয় উটের দেহ থেকে একটি লোম উঠিয়ে হাতে উঁচু করে ধরে বললেন,أيُّهَا النَّاسُ، وَاللهِ مَا لِى مِنَ الْفَىْءِ شَىْءٌ وَلاَ هَذِهِ إِلاَّ خُمُسٌ وَالْخُمُسُ مَرْدُودٌ فِيكُمْ ‘হে জনগণ! আল্লাহর কসম! ফাই বা গণীমতের কিছুই আমার কাছে আর অবশিষ্ট নেই। এমনকি এই লোমটিও নেই, এক পঞ্চমাংশ ব্যতীত। যা অবশেষে তোমাদের কাছেই ফিরে যাবে’।[2]
এইভাবে নওমুসলিম মুওয়াল্লাফাতুল কুলূবদের দেওয়ার পর বাকী গণীমত ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বণ্টন করা হয়। যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ)-কে হিসাব করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায় যে, প্রতিজন পদাতিকের মাত্র ৪টি উট ও ৪০টি বকরী এবং অশ্বারোহীর ১২টি উট ও ১২০টি করে বকরী ভাগে পড়েছে। এই যৎসামান্য গণীমত নিয়েই তাদেরকে খুশী থাকতে হয় (যাদুল মা‘আদ ৩/৪১৫)।
এ সময় রাসূল (ছাঃ) বলেন,فَوَاللهِ إِنِّى لأُعْطِى الرَّجُلَ، وَأَدَعُ الرَّجُلَ ، وَالَّذِى أَدَعُ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنَ الَّذِى أُعْطِى ‘আল্লাহর কসম! আমি কাউকে দেই, কাউকে ছাড়ি। যাকে আমি ছাড়ি, সে আমার নিকটে অধিকতর প্রিয় তার চাইতে, যাকে আমি দেই’ (বুখারী হা/৯২৩)। উভয়ে মুমিন হওয়া সত্ত্বেও একজনকে দিচ্ছেন অন্যজনকে দিচ্ছেন না, সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)-এর এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنِّى أُعْطِى رِجَالاً وَأَدَعُ مَنْ هُوَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْهُمْ لاَ أُعْطِيهِ شَيْئًا مَخَافَةَ أَنْ يُكَبُّوا فِى النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ ‘আমি কাউকে দিচ্ছি এবং তাদের মধ্যে যারা আমার নিকট অধিক প্রিয় তাদেরকে ছাড়ছি এজন্য, যাতে তারা উপুড়মুখী হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত না হয়’ (আবুদাঊদ হা/৪৬৮৩)। তিনি বলেন,فَإِنِّي أُعْطِي رِجَالاً حَدِيثِي عَهْدٍ بِكُفْرٍ أَتَأَلَّفُهُمْ ‘আমি কুফরী থেকে নতুন আগত লোকদের দিচ্ছি তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য’ (বুখারী হা/৪৩৩১)।
ইবনু ইসহাকের হিসাব মতে এদিন ১২ জন নেতাকে একশ একশ করে উট দেওয়া হয়। পাঁচ জনকে একশর কিছু কমসংখ্যক দেওয়া হয়। এভাবে ২৯ জনকে দেওয়া হয়। অন্যেরা আরও ২৩ জনের কথা বলেছেন। সর্বমোট ৫২ জন মুওয়াল্লাফাতুল কুলূবকে এই দিন বেশী বেশী দান করা হয়। এদের সকলেরই ইসলাম সুন্দর ছিল, ওয়ায়না বিন হিছন আল-ফাযারীসহ দু’একজন ব্যতীত (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫১২)।
তৃণভোজী পশুর সম্মুখে এক গোছা ঘাসের অাঁটি ধরলে যেমন সে ছুটে আসে, মানুষের মধ্যে অনুরূপ একদল মানুষ আছে, যাদেরকে দুনিয়ার লোভ দেখিয়েই কাছে টানতে হয়। সদ্য দলে আগত লোকদের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ) উক্ত নীতি অবলম্বন করেন। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম তো পরীক্ষিত মানুষ। দুনিয়া তাদের কাছে তুচ্ছ। আখেরাত তাদের নিকটে মুখ্য। তাই তাদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর কোন উদ্বেগ ছিল না।
[2]. আহমাদ হা/৬৭২৯, নাসাঈ হা/৩৬৮৮, আবুদাঊদ হা/২৬৯৪; মিশকাত হা/৪০২৫।
প্রসিদ্ধ আছে যে, আববাস বিন মিরদাসকে অনেকগুলি উট দেওয়া হয়। কিন্তু সে তাতে সন্তুষ্ট হ’তে পারেনি। ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে সাত লাইনের কবিতা পাঠ করে। এ কথা জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা যাও এবং আমার পক্ষ থেকে ওর জিহবা কেটে নাও। অতঃপর তাকে আরও উট দিতে থাক। যতক্ষণ না সে খুশী হয়। ফলে তার জিহবা কেটে নেওয়া হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৪৯৩-৯৪)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৯৯ পৃঃ)।