মক্কা বিজয়ের দু’দিনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একাধিক ভাষণ দিয়েছেন। পূর্বাপর সম্পর্ক বিবেচনায় ভাষণগুলিকে ১ম দিনের ও ২য় দিনের ভাষণ হিসাবে ভাগ করা হয়েছে।
১ম দিন তিনি কা‘বাগৃহের দরজায় দাঁড়িয়ে কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।-
(১) হামদ ও ছানা শেষে তিনি বলেন,اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، لآ إلَه إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ صَدَقَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ ‘আল্লাহ সবার চেয়ে বড়, আল্লাহ সবার চেয়ে বড়, আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি এক, যাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সেনাদল সমূহকে একাই পরাভূত করেছেন’। (২) أَلاَ كُلُّ مَأْثُرَةٍ أَوْ مَالٍ أَوْ دَمٍ فَهُوَ تَحْتَ قَدَمَيَّ هَاتَيْنِ إِلاَّ سِدَانَةَ الْبَيْتِ وَسِقَايَةَ الْحَاجِّ ‘শুনে রাখ, সম্মান ও সম্পদের সকল অহংকার এবং রক্তারক্তি আমার এই পদতলে পিষ্ট হ’ল। কেবলমাত্র বায়তুল্লাহর চাবি সংরক্ষণ ও হাজীদের পানি পান করানোর সম্মানটুকু ছাড়া (অর্থাৎ এ দু’টি দায়িত্ব তোমাদের জন্য বহাল রইল)। (৩)أَلاَ وَقَتْلُ الْخَطَإِ شِبْهُ الْعَمْدِ السَّوْطُ وَالْعَصَا، فَفِيهِ الدِّيَةُ مُغَلَّظَةً مِائَةٌ مِنَ الْإِبِلِ أَرْبَعُونَ مِنْهَا فِي بُطُونِهَا أَوْلاَدُهَا ‘ভুলক্রমে হত্যা যা লাঠিসোটা দ্বারা হয়ে থাকে, তা ইচ্ছাকৃত হত্যার সমতুল্য। তাকে পূর্ণ রক্তমূল্য দিতে হবে একশ’টি উট। যার মধ্যে ৪০টি হবে গর্ভবতী’।[1]
(৪) অতঃপর বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ قَدْ أَذْهَبَ عَنْكُمْ عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ، فَالنَّاسُ رَجُلاَنِ : مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ، أَنْتُمْ بَنُوْ آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ ‘হে জনগণ! আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অংশ ও পূর্ব পুরুষের অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। মানুষ দু’প্রকারের : মুমিন আল্লাহভীরু অথবা পাপাচারী হতভাগা। তোমরা আদম সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী’ (আর মাটির কোন অহংকার নেই)। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ ‘হে মানবজাতি! আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হ’তে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পার। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং তিনি সবকিছুর খবর রাখেন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)।[2]
(৫) তিনি বললেন,لاَ يُقْتَلُ قُرَشِىٌّ صَبْرًا بَعْدَ هَذَا الْيَوْمِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘আজকের দিনের পর কোন কুরায়শীকে আর যুদ্ধাবস্থা ব্যতীত হত্যা করা হবে না’ (মুসলিম হা/১৭৮২)। অর্থাৎ তারা এদিন সবাই মুসলমান হবে এবং কেউ মুরতাদ হবে না। আর অন্যায়ভাবে তাদের কাউকে হত্যা করা হবে না (ঐ, শরহ নববী)। অতঃপর তিনি বলেন,أَقُوْلُ هَذَا وَاسْتَغْفَرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ ‘আমি এগুলি বললাম। অতঃপর আমি আল্লাহর নিকট আমার জন্য ও তোমাদের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৮২৮)।
(৬) ভাষণ শেষে তিনি সমবেত কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে বলেন,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ مَا تَرَوْنَ أَنِّي فَاعِلٌ بِكُمْ؟ ‘হে কুরায়েশগণ! আমি তোমাদের সাথে কিরূপ আচরণ করব বলে তোমরা আশা কর’? সবাই বলে উঠল,خَيْرًا، أَخٌ كَرِيمٌ وَابْنُ أَخٍ كَرِيمٍ ‘উত্তম আচরণ। আপনি দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,فَإِنّي أَقُولُ لَكُمْ كَمَا قَالَ يُوسُفُ لِإِخْوَتِهِ لاَ تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ اذْهَبُوا فَأَنْتُمُ الطُّلَقَاءُ ‘শোন! আমি তোমাদের সেকথাই বলছি, যেকথা ইউসুফ তার ভাইদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ আর কোন অভিযোগ নেই’ (ইউসুফ ১২/৯২)। যাও তোমরা সবাই মুক্ত’।[3] বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ।[4] কিন্তু মতন (Text) মশহূর এবং এর মর্ম (Meaning) সঠিক। কারণ ঐ দিন কাউকে বন্দী করা হয়নি বা গণীমত সংগ্রহ করা হয়নি। বরং সবাই মুক্ত ছিল এবং উপস্থিত সবাই বায়‘আত গ্রহণ করে ইসলাম কবুল করেছিল।
উক্ত প্রসঙ্গে উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) বলেন, ‘ওহোদের দিন আনছারদের ৬৪ জন ও মুহাজিরদের ৬ জন শহীদ হন। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর সাথীগণ বলেন, ‘যদি আমাদের নিকট মুশরিকদের সঙ্গে এইরূপ কোন দিন আসে, তাহ’লে আমরা অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে দ্বিগুণ প্রতিশোধ নেব। অতঃপর যখন মক্কা বিজয়ের দিন এল, তখন একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি বলে উঠল,لاَ قُرَيْشَ بَعْدَ الْيَوْمِ، فَنَادَى مُنَادِي رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمِنَ الْأَسْوَدُ وَالْأَبْيَضُ إِلاَّ فُلاَنًا وَفُلاَنًا، نَاسًا سَمَّاهُمْ ‘আজকের দিনের পর আর কোন কুরায়েশ নেই’। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর একজন ঘোষক উচ্চৈঃস্বরে বললেন, কালো-সাদা সকলে নিরাপত্তা পাবে, অমুক অমুক ব্যতীত, যাদের নাম তিনি বললেন। এ সময় আল্লাহ নাযিল করেন,وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ ‘যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে। আর যদি তোমরা ছবর কর, তাহ’লে সেটাই ছবরকারীদের জন্য উত্তম হবে’ (নাহল ১৬/১২৬)। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,نَصْبِرُ وَلاَ نُعَاقِبُ ‘আমরা ছবর করব, প্রতিশোধ নেব না’ (আহমাদ হা/২১২৬৭, সনদ হাসান)।
সেমতে ছবর করা হয়, ঘোষিত মাত্র কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। বস্ত্ততঃ এদিন কিছু সময়ের জন্য রক্তপাত হালাল করা হ’লেও ২য় দিনের ভাষণে তা চিরকালের জন্য হারাম ঘোষণা করা হয়।
[2]. তিরমিযী হা/৩২৭০; আবু দাউদ হা/৫১১৬; ঐ, মিশকাত হা/৪৮৯৯; ছহীহাহ হা/২৭০০।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৪১২; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬০; আর-রাহীক্ব ৪০৫ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৪/৩০১।
[4]. হাদীছ যঈফ, তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১৬৮১; যঈফাহ হা/১১৬৩; মা শা-‘আ ১৯০ পৃঃ।