(১) কুরায়েশ নেতারা বদর যুদ্ধের পূর্বে আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং মূর্তিপূজারী নেতাদের প্রতি নিম্নোক্ত কঠোর ভাষায় হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠায়।-
إِنَّكُمْ آوَيْتُمْ صَاحِبَنَا وَإِنَّا نُقْسِمُ بِاللهِ لَتُقَاتِلُنَّهُ أَوْ لَتُخْرِجُنَّهُ أَوْ لَنَسِيرَنَّ إِلَيْكُمْ بِأَجْمَعِنَا حَتَّى نَقْتُلَ مُقَاتِلَتَكُمْ وَنَسْتَبِيحَ نِسَاءَكُمْ-
‘তোমরা আমাদের লোকটিকে (মুহাম্মাদকে) আশ্রয় দিয়েছ। এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, হয় তোমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ও তাকে বের করে দিবে নতুবা আমরা তোমাদের উপরে সর্বশক্তি নিয়ে হামলা করব। তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা করব ও মহিলাদের হালাল করে নেব’।[1] অতঃপর বদর যুদ্ধে কুরায়েশদের পরাজয়ে ভীত হয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সাথীরা প্রকাশ্যে ইসলাম কবুল করে। এমতাবস্থায় কুরায়েশ নেতারা ইহূদীদের কাছে পত্র লিখে যে,إِنَّكُمْ أَهْلُ الْحَلْقَةِ وَالْحُصُونِ وَإِنَّكُمْ لَتُقَاتِلُنَّ صَاحِبَنَا أَوْ لَنَفْعَلَنَّ كَذَا وَكَذَا وَلاَ يَحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ خَدَمِ نِسَائِكُمْ شَىْءٌ ‘তোমরা অস্ত্র ও দুর্গের মালিক। অবশ্যই তোমরা আমাদের লোকটির সাথে যুদ্ধ করবে। অথবা আমরা তোমাদের সাথে এই এই করব। আর তখন আমাদের মধ্যে ও তোমাদের নারীদের পায়ের অলংকারের মধ্যে কোন পর্দা থাকবে না’। তখন বনু নাযীর চুক্তি ভঙ্গের সংকল্প করে। সেমতে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে লোক পাঠায় এই বলে যে, আমাদের নিকট আপনার ত্রিশজন সাথীকে পাঠান। আমরাও তাদের নিকট আমাদের ত্রিশজন আলেমকে পাঠাব। অতঃপর আমরা একটি উপযুক্ত স্থানে বসব। সেখানে আপনি বক্তব্য রাখবেন। অতঃপর যদি তারা আপনার দ্বীন কবুল করে, তাহলে আমরাও তা কবুল করব’ (আবুদাঊদ হা/৩০০৪)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর যখন তারা উভয় দল একটি প্রকাশ্য স্থানে উপনীত হ’ল, তখন ইহূদীদের জনৈক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলল, কিভাবে আমরা এত লোকের মধ্যে মুহাম্মাদের কাছাকাছি হব? অথচ তাঁর সঙ্গে থাকবে ত্রিশজন মানুষ। যারা প্রত্যেকেই নিজের জীবন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর কাছে কাউকে পৌঁছতে দিবে না। তখন তারা প্রস্তাব পাঠালো এই মর্মে যে, ষাট জন লোক একত্রিত হ’লে আমাদের পরস্পরের কথা শুনতে ব্যাঘাত হবে। অতএব আপনি তিনজন সাথীকে নিয়ে আসুন। আমাদেরও তিনজন আলেম আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। যদি তারা আপনার উপর ঈমান আনে তাহ’লে আমরা আপনার অনুসারী হব। তখন তিনি তাই করলেন। অতঃপর ইহূদীরা তাদের ঐ তিনজন আলেমের সাথে গোপনে খঞ্জর (এক প্রকার দু’ধারী অস্ত্র) পাঠালো। এ খবর বনু নাযীরের জনৈকা মহিলা তার ভাই জনৈক আনছার মুসলিমের নিকটে পাঠান। তিনি এ খবর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে দেন। তখন রাসূল (ছাঃ) সেখানে পৌছার পূর্বেই ফিরে আসেন এবং পরের দিন সকালেই তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করেন ও সেদিনই তাদেরকে অবরুদ্ধ করে ফেলেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে প্রস্তাব পাঠালেন যে, তোমরা আমাদের পক্ষ থেকে কখনোই নিরাপদ হবে না, যতক্ষণ না তোমরা আমাদের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হবে। কিন্তু তারা চুক্তি করতে অস্বীকার করল। তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের সঙ্গে দিনভর যুদ্ধে রত হ’লেন।... পরের দিন তিনি পুনরায় শান্তিচুক্তির আহবান জানান। কিন্তু তারা অস্বীকার করে। ফলে আবার সারাদিন যুদ্ধ হয়। কারণ মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই গোপনে তাদের খবর পাঠিয়েছিল যে, তারা যুদ্ধ করলে আমরা তোমাদের সঙ্গে থাকব। তোমাদের বের করে দিলে আমরাও তোমাদের সঙ্গে বেরিয়ে যাব (হাশর ৫৯/১১)। কিন্তু দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরেও তাদের কোন সাহায্য না পেয়ে তারা নিরাশ হয়ে পড়ে। অবশেষে তারা চুক্তিতে বাধ্য হয় এবং সার্বিক বহিষ্কারে সম্মত হয়। এই শর্তে যে, অস্ত্র ব্যতীত উটে বহনযোগ্য সহায়-সম্পদ নিয়ে তারা চলে যাবে। ফলে তারা এমনকি তাদের ঘরের দরজা-জানালাসমূহ খুলে নিয়ে যায়। এভাবে তারা নিজেদের গড়া বাড়ি-ঘর নিজেদের হাতে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। তাদের এই বহিষ্কার ছিল ‘শামের দিকে প্রথম বহিষ্কার’(أَوَّلُ حَشْرِ النَّاسِ إِلَى الشَّامِ)।[2] এই সময় মদীনার প্রশাসক ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ) এবং যুদ্ধের পতাকাবাহী ছিলেন হযরত আলী (রাঃ)।
ইবনু হাজার বলেন, অত্র হাদীছে ইবনুত তীনের প্রতিবাদ রয়েছে। যিনি ধারণা করেন যে, বনু নাযীর যুদ্ধের বিষয়ে ছহীহ সনদে কোন হাদীছ নেই। তিনি বলেন, আমি বলব যে, এটি অধিকতর শক্তিশালী ইবনু ইসহাকের বর্ণনার চাইতে। যেখানে তিনি বনু নাযীর যুদ্ধের কারণ হিসাবে বলেছেন যে, রাসূল (ছাঃ) তাদের নিকটে দু’জন ব্যক্তির রক্তমূল্য আদায়ে সাহায্য নেয়ার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ জীবনীকার ইবনু ইসহাকের উক্ত বর্ণনার সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত’।[3] এ ঘটনা উপলক্ষে সূরা হাশর নাযিল হয় (বুখারী হা/৪৮৮২)। ইবনু আববাস (রাঃ) একে ‘সূরা নাযীর’(سُورَةُ النَّضِيرِ) বলতেন (বুখারী হা/৪৮৮৩)।
বনু নাযীর-এর বহিষ্কার বিষয়ে ছহীহ হাদীছসমূহ রয়েছে’।[4] তবে তাদের উপরে অবরোধ কতদিন আরোপিত ছিল, এবিষয়ে ইবনু কাছীর বলেন, ৬দিন এবং ওয়াক্বেদী ও ইবনু সা‘দ বিনা সনদে ১০ দিনের কথা বলেছেন’।[5] তাদের কিছু খেজুর গাছ কাটা হয়েছিল এবং কিছু ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটাও কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত’।[6] যেমন আল্লাহ বলেন, مَا قَطَعْتُمْ مِنْ لِينَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا قَائِمَةً عَلَى أُصُولِهَا فَبِإِذْنِ اللهِ وَلِيُخْزِيَ الْفَاسِقِينَ ‘তোমরা যে কিছু খেজুর গাছ কেটে দিয়েছ এবং কিছু রেখে দিয়েছ, তা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই হয়েছে। যাতে তিনি পাপাচারীদের লাঞ্ছিত করেন’ (হাশর ৫৯/৫)।
[1]. আবুদাঊদ হা/৩০০৪ ‘খারাজ’ অধ্যায় ‘বনু নাযীর-এর বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ-২৩।
[2]. ইবনু মারদাবিয়াহ, সনদ ছহীহ; ফাৎহুল বারী ‘বনু নাযীরের বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ, ৭/৩৩১ পৃঃ; আবু দাঊদ হা/৩০০৪, সনদ ছহীহ; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৯৭৩৩; কুরতুবী, তাফসীর সূরা হাশর ২ আয়াত।
বনু নাযীরের বহিষ্কার সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে বনু কেলাবের নিহত দুই ব্যক্তির রক্তমূল্য সংগ্রহের জন্য এলে তারা তাঁকে ও তাঁর সাথীদেরকে শঠতার মাধ্যমে বসিয়ে রাখে। অতঃপর দেওয়ালের উপর থেকে পাথরের চাক্কি ফেলে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তখন সেখান থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। অতঃপর ছয় বা পনের দিন অবরোধের পরে তারা আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে মদীনা থেকে চিরদিনের মত বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু ঘটনাটি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়, বরং ‘মুরসাল’ (ইবনু হিশাম ২/১৯০; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৮৬৬)।
[3]. ফাৎহুল বারী, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘বনু নাযীর’-এর বৃত্তান্ত, অনুচ্ছেদ-১৪, ৭/৩৩২ পৃঃ।
[4]. বুখারী হা/৪০৩১ প্রভৃতি; মুসলিম হা/১৭৪৬ (২৯); মিশকাত হা/৩৯৪৪।
[5]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হাশর ৫ আয়াত; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩০৮-০৯।
[6]. বুখারী হা/৪০৩২; মুসলিম হা/১৭৪৬ (৩০); মিশকাত হা/৩৯৪৪।