(১) ইবনু শিহাব যুহরীর হিসাব মতে বয়কট শুরু হয় ৭ম নববী বর্ষের শেষ দিকে। ফলে তাঁর হিসাবে মেয়াদ হয় দু’বছর। কিন্তু মূসা বিন উক্ববা দৃঢ়তার সাথে বলেন, এর মেয়াদ ছিল তিন বছর। কেননা ইবনু ইসহাক বলেছেন, ৭ম নববী বর্ষের মুহাররম মাসের শুরু থেকে বয়কটের সূচনা হয়।
(২) বয়কট সম্পর্কিত বিস্তারিত বর্ণনা সমূহের কোনটাই ছহীহ সনদে প্রমাণিত নয়। তবে এটা যে অবশ্যই ঘটেছিল তার মূল সূত্র পাওয়া যায় আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত ছহীহ হাদীছে। যেখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে বলেন,مَنْزِلُنَا غَدًا إِنْ شَاءَ اللهُ بِخَيْفِ بَنِى كِنَانَةَ حَيْثُ تَقَاسَمُوا عَلَى الْكُفْرِ ‘আগামীকাল ইনশাআল্লাহ আমরা বনু কিনানাহ্র খায়েফ অর্থাৎ মুহাছ্ছাব উপত্যকায় অবতরণ করব। যেখানে তারা কুফরীর উপরে পরস্পরে কসম করেছিল’ (বুখারী হা/১৫৮৯)। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কুরায়েশ ও কিনানাহ গোত্র বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিবের বিরুদ্ধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল যে, তাদের সঙ্গে বিবাহ-শাদী, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই বন্ধ থাকবে, যতদিন না তারা মুহাম্মাদকে আমাদের হাতে সোপর্দ করবে’ (বুখারী হা/১৫৯০)।
(৩) দীর্ঘ তিন বছর বয়কট অবস্থায় থেকে গাছের ছাল-পাতা খেয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে বার্ধক্য জর্জরিত দেহ নিয়ে চাচা আবু ত্বালিব ও স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ) চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। একই অবস্থায় উপনীত হয়েছিলেন বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিবের মুমিন-কাফির শত শত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। কত নারী-শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সে বয়কটে না খেয়ে ও বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিল, তার হিসাব কে বলবে?
সমালোচকরা বলবেন, তারা জাহেলী যুগের লোক ছিল বলেই এই নিষ্ঠুরতা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক যুগের তথাকথিত ভদ্র নেতারা সে যুগের চাইতে উন্নত কিসে? বর্তমান যুগের গণতন্ত্রী ও মানবাধিকারের মোড়ল রাষ্ট্র আমেরিকা ও বৃটেন প্রভাবিত জাতিসংঘের অবরোধ আরোপের কারণে ১৯৯০ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ইরাকে অন্যূন ১৫ লাখ মুসলিম নর-নারী ও শিশু খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। অতঃপর ২০০৩ সালে ইরাকে ও আফগানিস্তানে সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে ইরাকে ১০ লাখ ও আফগানিস্তানে তারা বেহিসাব নর-নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে। এখনও তাদের কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিযানে হাযার হাযার বনু আদম নির্দয়ভাবে বিভিন্ন দেশে নিহত, পঙ্গু ও গৃহহারা হচ্ছে। সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর তাদের বয়কট, অবরোধ ও হামলার মাধ্যমে এবং সার্বক্ষণিক চক্রান্তের মাধ্যমে সর্বত্র মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে। উদ্দেশ্য, স্রেফ ঐসব দেশের সম্পদ লুট করা এবং তাদের উপর প্রভুত্ব চাপিয়ে দেওয়া। অথচ এত বড় পশুত্ব ও হিংস্রতাকেও তারা অবলীলাক্রমে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সন্ত্রাস দমনের মহান সংগ্রাম বলে চালিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়োজিত শত শত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সেই মিথ্যাগুলোকে হাযারো কণ্ঠে প্রচার করছে। সেই সাথে তাদের বশংবদ রাষ্ট্রগুলো এইসব যুলুম ও অত্যাচারের পক্ষে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন দেশের উপর পরাশক্তিগুলির প্রতারণাপূর্ণ বয়কটকে একদিকে রাখুন, আর চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে মক্কার এই বয়কটকে আরেক দিকে রাখুন। দু’টির মধ্যে আসমান ও যমীনের পার্থক্য দেখতে পাবেন। যেমন (ক) আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ বয়কটের উদ্দেশ্য স্রেফ লুটপাট ও পররাজ্য গ্রাস এবং সাথে সাথে খৃষ্টানীকরণের ঘৃণ্য অপচেষ্টা। পক্ষান্তরে জাহেলী যুগের ঐ বয়কটের একমাত্র কারণ ছিল নীতি ও আদর্শের সংঘাত এবং শিরক ও তাওহীদের সংঘর্ষ। সেখানে লুটপাট, খুনোখুনি বা নারী নির্যাতনের নাম-গন্ধ ছিল না।
(খ) ইরাকের বিরুদ্ধে বয়কটের সময় মুসলিম ও আরব রাষ্ট্র গুলির প্রায় সকলে প্রকাশ্যে বা গোপনে যালেম ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন দেয়। কথিত আরব জাতীয়তাবাদের বন্ধন বা ইসলামী জাতীয়তার আকর্ষণ কোনটাই সেখানে কার্যকর হয়নি। অথচ বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব-এর প্রায় সবাই কাফের-মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বংশীয় টানে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং বয়কটের সময় অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বরণ করে নেয়। আত্মীয়তার বন্ধনের প্রতি তাদের এই আনুগত্য ও নৈতিকতা বোধ আধুনিক বিশ্বের নীতিহীন শাসকদের জন্য চপেটাঘাত বৈ-কি! অতএব সেই যুগের চাইতে আজকের তথাকথিত সভ্য যুগকেই সত্যিকার অর্থে ‘জাহেলী যুগ’ বলা উচিত।