(৬ষ্ঠ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাস)
হামযার ইসলাম গ্রহণের মাত্র তিন দিন পরেই আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আরেকজন কুরায়েশ বীর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব আকস্মিকভাবে মুসলমান হয়ে যান। ওয়াক্বেদীর হিসাব মতে, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর এবং তখন মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৫৬ জন। যাদের মধ্যে ১০ বা ১১ জন ছিলেন নারী। এটি ছিল হাবশায় প্রথম হিজরতের পরের ঘটনা।[1] ইবনু কাছীর বলেন, ওমরকে দিয়ে মুসলমানের সংখ্যা ৪০ পূর্ণ হয়, কথাটি সঠিক নয়। কেননা তার পূর্বে ৮০ জনের উপরে মুসলমান হাবশায় হিজরত করেছিল। তবে এটি হ’তে পারে যে, দারুল আরক্বামে গিয়ে ইসলাম কবুল করার সময়ে সেখানে মুসলিম নারী-পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪০-এর কাছাকাছি (আল-বিদায়াহ ৩/৭৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে ৩৯ জন (ঐ, ৩০ পৃঃ)। ফলে সেদিন ওমরকে দিয়ে ৪০ পূর্ণ হয়।
তিনি যে আগে থেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তার প্রমাণ হিসাবে বলা যায় যে, হাবশা যাত্রী মহিলা মুহাজির উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে আবু হাছমাহ (أبو حَثْمَة) বলেন, আমরা হাবশা যাত্রার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলাম। আমার স্বামী ‘আমের তখন প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে ছিলেন। এমন সময় ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব এলেন। তখন তিনি মুশরিক ছিলেন। বললেন, এগুলি মনে হয় চলে যাওয়ার প্রস্ত্ততি? বললাম, হ্যাঁ। আমরা অবশ্যই আল্লাহর যমীনে বেরিয়ে যাব। তোমরা আমাদের কষ্ট দিচ্ছ ও নির্যাতন করছ। নিশ্চয়ই আল্লাহ একটা পথ বের করে দিবেন’। তখন ওমর বললেন, صَحِبَكُمُ اللهُ ‘আল্লাহ তোমাদের সাথী হৌন’! এদিন আমি তাকে অত্যন্ত দুঃখিত ও সংবেদনশীল দেখতে পাই’।[2] রাবী আব্দুল্লাহ বিন ‘আমের জ্যেষ্ঠ তাবেঈ ছিলেন। যিনি প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তার মায়ের সূত্রে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী তার সমালোচনা করেননি। ইবনু হিববান তার বিশুদ্ধতার সাক্ষ্য দিয়েছেন’।[3] তবে হাফেয ইবনু হাজার বলেন, বোন ফাতেমার গৃহে প্রবেশ ও তার নিকট থেকে কুরআন শ্রবণ তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রত্যক্ষ কারণ হ’তে পারে।[4] কিন্তু উক্ত বিষয়ে বর্ণিত প্রসিদ্ধ ঘটনাটির সনদ ‘যঈফ’।[5]
এছাড়াও মতনে বৈপরিত্য আছে। যেমন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, কুরায়েশ নেতারা তাকে পাঠিয়েছিলেন। কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি নিজ থেকে গিয়েছিলেন’ (ইবনু সা‘দ, দারাকুৎনী)। কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি বোনের ঘরে সূরা ত্বোয়াহা ও সূরা তাকভীর ১৪ আয়াত পর্যন্ত পড়েছিলেন’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪৫)। কোন বর্ণনায় এসেছে সূরা হাদীদ’ পড়েছিলেন (বায়হাক্বী, দালায়েল হা/৫১৮)। অথচ সূরা হাদীদ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে বায়তুল্লাহতে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত অবস্থায় সূরা হা-ক্কাহ শুনে তার অন্তরে ইসলাম দৃঢ় হয়’ (আহমাদ হা/১০৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি রাতের বেলা কা‘বার গেলাফের মধ্যে লুকিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাতের ক্বিরাআত শুনছিলেন। তিনি বলেন, এমন কথা আমি কখনো শুনিনি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বেরিয়ে গেলে আমি তাঁর পিছু নেই। তখন তিনি বললেন, কে? আমি বললাম, ওমর। তিনি বললেন, হে ওমর! দিনে-রাতে কখনোই তুমি আমার পিছু নিতে ছাড়ো না’। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে, উনি আমাকে বদ দো‘আ করতে পারেন। তখন আমি কালেমা শাহাদাত পাঠ করলাম। রাসূল (ছাঃ) বললেন, يَا عُمَرُ، اُسْتُرْهُ ‘হে ওমর! এটি গোপন রাখ’। আমি বললাম, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম করে বলছি, আমি অবশ্যই প্রকাশ করব, যেভাবে শিরক প্রকাশ করতাম’ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৭৭৫৪)। বর্ণনাগুলি সবই যঈফ’ (মা শা-‘আ ৫৭ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, দুর্বল সূত্র সমূহের আধিক্য সবসময় কোন বর্ণনার শক্তি বৃদ্ধি করেনা। বরং অনেক সময় তার দুর্বলতাই বৃদ্ধি করে। মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন’ (মা শা-‘আ ৫৯ পৃঃ)।
আমরা মনে করি ওমরের ইসলাম গ্রহণ ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর বিশেষ দো‘আর ফল। কেননা তিনি তাঁর জন্য খাছভাবে দো‘আ করেছিলেন, اللهُمَّ أَعِزَّ الإِسْلاَمَ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ‘হে আল্লাহ! তুমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব-এর মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী কর’।[6] অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللهُمَّ أَعِزَّ الإِسْلاَمَ بِأَحَبِّ هَذَيْنِ الرَّجُلَيْنِ إِلَيْكَ بِأَبِى جَهْلٍ أَوْ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ‘হে আল্লাহ! আবু জাহল অথবা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব এই দুই ব্যক্তির মধ্যে যিনি তোমার নিকট অধিক প্রিয়, তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী কর’।[7] পরের দিন সকালে ওমর দারুল আরক্বামে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে ইসলাম কবুল করেন এবং কা‘বাগৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করেন’।[8] এতে প্রমাণিত হয় যে, ওমরই ছিলেন আল্লাহর নিকটে অধিকতর প্রিয় ব্যক্তি।[9]
তবে এটা নিশ্চিত যে, ওমর ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী এবং আরবী ভাষালংকারে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ফলে কুরআনের সারগর্ভ ও আকর্ষণীয় বাকভঙ্গি এবং ক্বিয়ামত ও জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনাসমূহ তাঁর হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। যা তাকে ইসলামের দিকে চুম্বকের মত টেনে আনে। সর্বোপরি রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আ তাঁর শানে কবুল হওয়ায় তিনি দ্রুত এসে ইসলাম কবুল করেন।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৪২-৪৩; আল-বিদায়াহ ৩/৭৭; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৭৭ পৃঃ।
[3]. সীরাহ ছহীহাহ, টীকা-১, ১/১৭৮ পৃঃ।
[4]. বুখারী, ফাৎহসহ হা/৩৮৬২-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[5]. মা শা-‘আ ৫৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৩৪৩-৪৮; বোনের ঘটনাটি বর্ণনা শেষে রাবী ইবনু ইসহাক বলেন, فَهَذَا حَدِيثُ الرُّوَاةِ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ عَنْ إسْلاَمِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ حِينَ أَسْلَمَ ‘এটিই হ’ল ওমরের ইসলাম গ্রহণকালের ঘটনা সম্পর্কে মদীনাবাসী বর্ণনাকারীদের বক্তব্য’। অতঃপর কা‘বাগৃহে রাত্রিবেলায় ছালাতরত অবস্থায় গোপনে রাসূল (ছাঃ)-এর ক্বিরাআত শুনে বিগলিত ওমর সাথে সাথে ইসলাম কবুল করেন এবং রাসূল (ছাঃ) তার বুকে হাত মেরে ঈমানের উপর তার দৃঢ় থাকার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন’ বলে ঘটনাটি বর্ণনা শেষে রাবী ইবনু ইসহাক বলেন, وَاللهُ أَعْلَمُ أَيَّ ذَلِكَ كَانَ ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত কোন্টি ঘটেছিল’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪৮)।
[6]. হাকেম হা/৪৪৮৫; আহমাদ হা/৫৬৯৬; ইবনু মাজাহ হা/১০৫; ছহীহাহ হা/৩২২৫।
[7]. তিরমিযী হা/৩৬৮১, হাদীছ ছহীহ।
[8]. হাকেম হা/৬১২৯; আহমাদ হা/৫৬৯৬; তিরমিযী হা/৩৬৮১; মিশকাত হা/৬০৩৬, ‘ওমরের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
[9]. এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে, لَمَّا أَسْلَمَ عُمَرُ نَزَلَ جِبْرِيلُ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ لَقَدِ اسْتَبْشَرَ أَهْلُ السَّمَاءِ بِإِسْلاَمِ عُمَرَ ‘যখন ওমর ইসলাম কবুল করেন, তখন জিব্রীল অবতরণ করেন এবং বলেন, হে মুহাম্মাদ! ওমরের ইসলাম গ্রহণে আসমানবাসীগণ খুবই খুশী হয়েছেন’ (ইবনু মাজাহ হা/১০৩)। আলবানী বলেন, হাদীছটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল (ضَعِيْفٌ جِدًّا)।
উল্লেখ্য যে, ওমরের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তার কোনটিও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়’ (মা শা-‘আ ৫৪ পৃঃ)। ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) ওমরের ইসলাম গ্রহণের আকর্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা শেষে বলেন, هذا حديث حسن الألفاظ، ضعيف السند ‘এটি সুন্দর শব্দময় বর্ণনা, কিন্তু সনদ দুর্বল’ (মা শা-‘আ ৫৯ পৃঃ, গৃহীত : আত-তামহীদ ২৪/৩৪৭)।