কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে কুরায়েশ নেতারা রাসূল (ছাঃ)-কে আপোষ প্রস্তাবের ফাঁদে আটকানোর চিন্তা করেন। সে মোতাবেক তারা মক্কার অন্যতম নেতা ওৎবা বিন রাবী‘আহকে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে পাঠান।
(১) একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বা চত্বরে একাকী বসেছিলেন। তখন কুরায়েশ নেতাদের অনুমতি নিয়ে ওৎবা তাঁর কাছে গিয়ে বসলেন এবং বললেন, হে ভাতিজা! তুমি আমাদের গোত্রের মধ্যে কেমন সম্মান ও উচ্চ মর্যাদায় আছ, তা তুমি ভালভাবেই জান। وَإِنَّكَ قَدْ أَتَيْتَ قَوْمَكَ بِأَمْرِ عَظِيمٍ فَرَّقْتَ بِهِ جَمَاعَتَهُمْ وَسَفَّهْتَ بِهِ أَحْلاَمَهُمْ وَعِبْتَ بِهِ آلِهَتَهُمْ وَدِينَهُمْ وَكَفَّرْتَ بِهِ مَنْ مَضَى مِنْ آبَائِهِمْ ‘কিন্তু তুমি তোমার সম্প্রদায়ের নিকটে একটি ভয়ানক বিষয় নিয়ে এসেছ। তুমি তাদের জামা‘আতকে বিভক্ত করেছ। তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছ। তাদের উপাস্যদের ও তাদের দ্বীনকে তুমি মন্দ বলেছ। এই দ্বীনের উপর মৃত্যুবরণকারী তাদের বাপ-দাদাদের তুমি কাফের বলেছ’। অতএব আমি তোমার নিকটে কয়েকটি বিষয় পেশ করছি। এগুলি তুমি ভেবে দেখ, আশা করি তুমি সেগুলির কিছু হ’লেও মেনে নিবে। জওয়াবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, বলুন! হে আবু অলীদ, আমি শুনব। তখন তিনি বললেন, হে ভাতিজা! তোমার এই নতুন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য যদি সম্পদ উপার্জন হয়, তাহ’লে তুমি বললে আমরা তোমাকে সেরা ধনী বানিয়ে দেব। আর যদি তোমার উদ্দেশ্য নেতৃত্ব লাভ হয়, তাহ’লে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে দেব। আর যদি আরবের বাদশাহ হ’তে চাও, তাহ’লে আমরা তোমাকে বাদশাহ বানিয়ে দেব। আর যদি মনে কর, তোমার মাথার জন্য জিনের চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহ’লে আমরাই তা আরোগ্যের জন্য সেরা চিকিৎসককে এনে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব এবং সব খরচ আমরাই বহন করব’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এমনকি নেতারা এ প্রস্তাবও দিয়েছিল যে, তুমি নারীদের মধ্যে যাকে চাও, তার সাথে তোমাকে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিব। আমাদের একটাই মাত্র দাবী, তুমি তোমার ঐ নতুন দ্বীনের দাওয়াত পরিত্যাগ কর’।[1]
জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ৫৪ আয়াত বিশিষ্ট সূরা হা-মীম সাজদাহ পাঠ করে শুনাতে লাগলেন। শুনতে শুনতে ওৎবা মন্ত্রমুগ্ধের মত হয়ে গেলেন। এক বর্ণনায় এসেছে, যখন রাসূল (ছাঃ) ১৩তম আয়াত পাঠ করলেন, তখন ওৎবা রাসূল (ছাঃ)-এর মুখের উপরে হাত চেপে গযব নাযিলের ভয়ে বলে উঠলেন, أَنْشُدُكَ اللهَ وَالرَّحِمَ আল্লাহর দোহাই! তুমি তোমার বংশধরগণের উপরে দয়া কর’। অতঃপর ৩৮তম আয়াতের পর রাসূল (ছাঃ) সিজদা করলেন এবং উঠে বললেন, قَدْ سَمِعْتَ يَا أَبَا الْوَلِيدِ مَا سَمِعْتَ فَأَنْت وَذَاكَ ‘আবুল অলীদ আপনি তো সবকিছু শুনলেন। এখন আপনার যা বিবেচনা হয় করুন’। এরপর ওৎবা উঠে গেলেন।
কুরায়েশ নেতারা সাগ্রহে ওৎবার কাছে জমা হ’লে তিনি বললেন, নেতারা শুনুন! আমি মুহাম্মাদের মুখ থেকে এমন বাণী শুনে এসেছি, যেরূপ বাণী আমি কখনো শুনিনি। যা কোন কবিতা নয় বা জাদুমন্ত্র নয়। সে এক অলৌকিক বাণী। আপনারা আমার কথা শুনুন! মুহাম্মাদকে বাধা দিবেন না। তাকে তার পথে ছেড়ে দিন’। লোকেরা হতবাক হয়ে বলে উঠলো سَحَرَكَ وَاللهِ يَا أَبَا الْوَلِيدِ بِلِسَانِهِ ‘আল্লাহর কসম হে আবুল অলীদ! মুহাম্মাদ তার কথা দিয়ে আপনাকে জাদু করে ফেলেছে’।[2]
(২) একদিন যখন রাসূল (ছাঃ) কা‘বাগৃহ ত্বাওয়াফ করছিলেন, তখন আসওয়াদ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এসে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রস্তাব দেন,يَا مُحَمَّدُ، هَلُمَّ فَلْنَعْبُدْ مَا تَعْبُدُ، وَتَعْبُدُ مَا نَعْبُدُ، فَنَشْتَرِكُ نَحْنُ وَأَنْتَ فِي الْأَمْرِ ‘হে মুহাম্মাদ! এসো আমরা ইবাদত করি, যার তুমি ইবাদত কর এবং তুমি ইবাদত কর, যার আমরা ইবাদত করি। তাতে আমরা ও তুমি আমাদের উপাসনার কাজে পরস্পরে অংশীদার হব’। তখন আল্লাহ সূরা কাফেরূন নাযিল করেন।[3] যাতে কাফেরদের সঙ্গে পুরাপুরি বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করা হয়।
[2]. ইবনু হিশাম ১/২৯৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৫ আয়াত; ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১০৭; সনদ হাসান।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৩৬২ ‘সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ’; আলবানী, ছহীহুস সীরাহ ২০১-২০২ পৃঃ।