১. মহান আল্লাহর নামের ওযীফা বা আমল
মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ ; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামে ডাকবে। যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করবে। তাদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই তাদেরকে প্রদান করা হবে।’’[1]
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত হাদীসে আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন :
إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ
‘‘নিশ্চয় আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে, ১০০’র একটি কম, যে ব্যক্তি এ নামগুলো সংরক্ষিত রাখবে বা হিসাব রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[2]
এ হাদীসে নামগুলো বিবরণ দেয়া হয় নি। ৯৯ টি নাম সম্বলিত একটি হাদীস ইমাম তিরমিযী, ইবনু মাজাহ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন।[3] কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিস উক্ত বিবরণকে যয়ীফ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী নিজেই হাদীসটি সংকলন করে তার সনদের দুর্বলতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেন, ৯৯ টি নামের তালিকা রাসূলুল্লাহ ﷺ বা আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত নয়। পরবর্তী রাবী এগুলো কুরআনের আলোকে বিভিন্ন আলিমের মুখ থেকে সংকলিত করে হাদীসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। কুরআন করীমে উল্লেখিত অনেক নামই এ তালিকায় নেই। কুরআন করীমে মহান আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ডাকা হয়েছে ‘রাবব’ বা প্রভু নামে। এ নামটিও এ তালিকায় নেই।[4]
এক্ষেত্রে আগ্রহী মুসলিম চিন্তা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ৯৯ টি নাম হিসাব রাখতে নির্দেশনা দিলেন কিন্তু নামগুলোর নির্ধারিত তালিকা দিলেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে উলামায়ে কেরাম বলেন যে, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আংশিক গোপন রাখা হয়, মুমিনের কর্মোদ্দীপনা বৃদ্ধির জন্য। যেমন, লাইলাতুল কাদ্র, জুম’আর দিনের দোয়া কবুলের সময়, ইত্যাদি। অনুরূপভাবে নামের নির্ধারিত তালিকা না বলে আললাহর নাম সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যেন বান্দা আগ্রহের সাথে কুরআন কারীমে আল্লাহর যত নাম আছে সবই পাঠ করে, সংরক্ষণ করে এবং সে সকল নামে আল্লাহকে ডাকতে থাকে এবং সেগুলির ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে।[5]
কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযী সংকলিত তালিকাটিকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন।[6] সর্বাবস্থায় আগ্রহী যাকির এই নামগুলো মুখস্থ করতে পারেন। এছাড়া কুরআন কারীমে উল্লেখিত আল্লাহর সকল মুবারাক নাম নিয়মিত কুরআন পাঠের মাধ্যমে সংরক্ষিত রাখতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলার বরকতময় নামের ওসীলা দিয়ে কিভাবে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে, মহিমাময় আল্লাহর ‘ইসমু আ’যম’ কি এবং এর মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহ মহান দরবারে দোয়া করতে হবে সে বিষয়ক সহীহ হাদীসগুলি আমি ‘রাহে বেলায়েত’ গ্রন্থে সনদের আলোচনা সহ উল্লেখ করেছি।
আমাদের দেশের প্রচলিত অনেক বইয়ে এ সকল নামের আরো অনেক ফযীলত লেখা হয়েছে। যেমন প্রত্যহ এগুলো পাঠ করলে অন্নকষ্ট হবে না, রোগ ব্যাধি দূর হবে, স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর যিয়ারত হবে, মনের আশা পূর্ণ হবে, দৈনিক এত বার অমুক নামটি এত দিন পর্যন্ত পড়লে বা লিখলে অমুক ফল লাভ করা যাবে অথবা অমুক নাম প্রতিদিন এত বার এ পদ্ধতিতে করলে অমুক ফল পাওয়া যাবে, অথবা অমুক নাম এতবার পাঠ করতে হবে, ইত্যাদি। এ ধরনের কোনো কথাই কুরআন-হাদীসের কথা নয়। কেউ হয়ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো তদবীর করেছেন বা শিখিয়েছেন। তবে এগুলোকে আল্লাহর কথা বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা মনে করলে বা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে মিথ্যা বলা হবে।
এ বিষয়ক প্রচলিত জাল হাদীসগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ
২. আল্লাহর যিকর সর্বোত্তম যিকর
বিভিন্ন পুস্তকে হাদীস হিসেবে নিম্নের বাক্যটির উল্লেখ দেখা যায়:
أَفْضَلُ الذِّكْرِ ذِكْرُ اللهِ
‘‘আল্লাহর যিকর সর্বোত্তম যিকর।’’
অর্থের দিক থেকে কথাটি ঠিক। আল্লাহর যিক্র তো সর্বোত্তম যিক্র হবেই। আল্লাহর যিক্র ছাড়া আর কার যিকির সর্বোত্তম হবে? তবে কথাটি হা্দীস নয়। কোনো সহীহ বা যায়ীফ সনদে তা বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না।
৩. যিকরে কলবে ও কবরে নূর
একটি ভিত্তিহীন কথা: ‘‘যে ব্যক্তি রাত্রিতে আল্লাহর নাম যিক্র করে তাহার অন্তরে এবং মৃত্যু হইলে তাহার কবরে নূর চমকাইতে থাকিবে।’’[7]
৪. ১০০ বার আল্লাহ নাম ও ৬টি নামের যিকর:
‘‘যে ব্যক্তি ফজরের সময় ‘আল্লাহ’ নামটি ১০০ বার যিক্র করে নিম্নোক্ত ৬টি নাম (জাল্লা জালালুহু, ওয়া আম্মা নাওয়ালুহূ, ওয়া জাল্লা সানাউহু, ওয়া তাকাদ্দাসাত আসমাউহূ, ওয়া আ’যামা শানুহু, ওয়া লা ইলাহা গাইরুহু) একবার করে পড়বে, সে ব্যক্তি গোনাহ হতে এমনভাবে মুক্ত হবে যেন সে এই মাত্র মাতৃগর্ভ হতে জন্মলাভ করল। তার আমলনামা পরিষ্কার থাকবে এবং সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই বেহেশতে প্রবেশ করবে।’[8]
এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা যা রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে বলা হয়েছে।
৫. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার খাস যিকর
আল্লাহর যিক্র-এর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘সর্বোত্তম যিকির ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’[9]। আরো বলেন: ‘‘তোমরা বেশি বেশি করে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।’’[10] অন্যত্র তিনি বলেন: ‘‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বাক্য চারটি : ‘সুব‘হা-নাল্লাহ’, ‘আল-হামদুলিল্লাহ’, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং ‘আল্লা-হু আকবার’। তুমি ইচ্ছামতো এ বাক্য চারটির যে কোনো বাক্য আগে পিছে বলতে পার।’’[11]
এ সকল যিকর-এর গুরত্ব, ফযীলত, সংখ্যা ও সময় বিষয়ক অনেক সহীহ ও হাসান হাদীস আমি ‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকে আলোচনা করেছি। আমরা সেখানে দেখেছি যে, এ সকল যিক্র যপ করার বা উচ্চারণ করার জন্য কোনো বিশেষ পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শেখান নি। কোথাও কোনো একটি সহীহ বা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাউকে টেনে টেনে, বা জোরে জোরে, বা ধাক্কা দিয়ে, বা কোনো ‘লতীফা’র দিকে লক্ষ্য করে, বা অন্য কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে যিক্র করতে শিক্ষা দিয়েছেন। মূল কথা হলো, মনোযোগের সাথে বিশুদ্ধ উচ্চারণে যিক্র করতে হবে এবং প্রত্যেকে তাঁর মনোযোগ ও আবেগ অনুসারে সাওয়াব পাবেন।
পরবর্তী যুগের বিভিন্ন আলিম, পীর ও মুরশিদ মুরিদগণের মনোযোগ ও আবেগ তৈরির জন্য কিছু বিশেষ পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। এগুলো তাঁদের উদ্ভাবন এবং মুরিদের মনোযোগের জন্য সাময়িক রিয়াযত বা অনুশীলন।
তবে জালিয়াতরা এ বিষয়েও কিছু কথা বানিয়েছে। এ জাতীয় একটি ভিত্তিহীন কথা ও জাল হাদীস নিম্নরূপ: ‘‘একদা হযরত আলী (রা) হুযুর (ﷺ)-কে বলিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের জন্য আমাকে সহজ সরল পন্থা বলিয়া দিন। হুযূর (ﷺ) বলিলেন- একটি যিকর করিতে থাক। হযরত আলী বলিলেন- কিভাবে করিব? এরশাদ করিলেন- চক্ষু বন্ধ কর এবং আমার সাথে তিনবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বল। হযরত আলী (রা) ইহা হযরত হাসান বসরীকে এবং হযরত হাসান বসরী হইতে মুরশিদ পরম্পরায় আমাদের নিকট পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে।’’
এ গল্পটির আরেকটি ‘ভার্সন’ নিম্নরূপ: ‘‘আলী (রা) বলেন, খোদা-প্রাপ্তির অতি সহজ ও সরল পথ অবগত হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওহীর অপেক্ষায় থাকেন। অঃপর জিবরাঈল (আঃ) আগমন করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা’ কালেমা শরীফ তিনবার শিক্ষা দিলেন। জিবরাঈল (আঃ) যে ভাবে উচ্চারণ করলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও সেভাবে আবৃত্তি করলেন। অতঃপর তিনি আলী (রা)-কে তা শিখিয়ে দিলেন। আলী (রা) অন্যান্য সাহাবীকে তা শিখিয়ে দিলেন।’’
এ হাদীসটি লোকমুখে প্রচলিত ভিত্তিহীন কথা মাত্র। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ সনদেও হাদীসটি কোনো গ্রন্থে সংকলিত হয় নি। এ জন্য শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী উল্লেখ করেছেন যে, তরীকার বুযুর্গগণের মুখেই শুধু এ কথাটি শোনা যায়। এছাড়া এর কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না।[12]
৬. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে ওযীফা
অগণিত সহীহ হাদীসে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে বিভিন্ন প্রকারের যিক্র, দোয়া বা ওযীফার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে পালন করতেন বা সাহাবীগণকে ও উম্মাতকে পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এগুলো ছাড়াও কিছু ওযীফা আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত, যা পরবর্তী যুগের মানুষদের বানানো, কোনো হাদীসে তা পাওয়া যায় না। নিম্নের ওযীফাটি খুবই প্রসিদ্ধ:
ফজর নামাযের পরে ১০০ বার (هو الحي القيوم), যোহরের নামাযের পরে ১০০ বার (هو العلي العظيم), আসরের নামাযের পরে ১০০ বার (هو الرحمن الرحيم), মাগরিবের নামাযের পরে ১০০ বার (هو الغفور الرحيم) এবং ঈশার নামাযের পরে ১০০ বার (هو اللطيف الخبير) পাঠ করা।
এ বাক্যগুলো সুন্দর এবং এগুলোর পাঠে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এগুলোর কোনোরূপ ফযীলত, এগুলোকে এত সংখ্যায় বা অমুক সময়ে পড়তে হবে এমন কোনো প্রকারের নির্দেশনা কুরআন বা হাদীসে নেই। আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো ওযীফাগুলো পালন করা।
৭. ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম...-এ সংযোজন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরয নামাযের সালাম ফিরিয়ে বলতেন:
اللهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ وَمِنْكَ السَّلاَمُ تَبَارَكْتَ ذَا الجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ
‘‘হে আল্লাহ, আপনিই সালাম (শান্তি), আপনার থেকেই শান্তি, হে মহাসম্মানের অধিকারী ও মর্যাদা প্রদানের অধিকারী, আপনি বরকতময়।’’[13]
অনেকে এ বাক্যগুলোর মধ্যে কিছু বাক্য বৃদ্ধি করে বলেন:
إِلَيْكَ يَرْجِعُ السَّلاَمُ، فَحَيِّنَا رَبَّنَا بِالسَّلاَمِ، وَأَدْخِلْنَا دَارَكَ دَارَ السَّلاَمِ...
মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি), আল্লামা আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ তাহতাবী হানাফী (১২৩১ হি) প্রমুখ আলিম বলেছেন যে, এ অতিরিক্ত বাক্যগুলো ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। কিছু ওয়ায়িয এগুলো বানিয়েছেন।[14]
৮. দোয়ায়ে গঞ্জল আরশ
প্রচলিত মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়াগুলোর অন্যতম দোয়ায়ে গঞ্জল আরশ বা কানযুল আরশ। এর মধ্যে যে বাক্যগুলো বলা হয় তার অর্থ ভাল। তবে এভাবে এ বাক্যগুলো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বাক্যগুলোর সম্মিলিতরূপ এভাবে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বাক্যগুলোর ফযীলত ও সাওয়াবে যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা কথা।
৯. দোয়ায়ে আহাদ নামা
অনুরূপ একটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে আহাদ নামা’। প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে এ দোয়াটি বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দোয়ার মূল বাক্যগুলো একাধিক যয়ীফ সনদে বর্ণিত হাদীসে পাওয়া যায়। এ সকল হাদীসে এ দোয়াটি সকালে ও সন্ধ্যায় পাঠ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফযীলত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি কেউ এ দোয়াটি সকাল সন্ধ্যায় পাঠ করেন তবে কিয়ামতের দিন সে মুক্তি লাভ করবে...।[15]
এছাড়া এ দোয়ার ফযীলত ও আমল সম্পর্কে প্রচলিত সব কথাই বানোয়াট। এরূপ বানোয়াট কথাবার্তার একটি নমুনা দেখুন: ‘‘তিরমিজী, শামী ও নাফেউল খালায়েক কিতাবে ‘দোয়ায়ে আহাদনামা’ সম্পর্কে বহু ফজীলতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি ইসলামী জিন্দেগী যাপন করে জীবনে আহাদনামা ১০০ বার পাঠ করবে সে ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে এবং আমি তার জান্নাতের জামিন হব।... হজরত জাবির (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে শুনেছি, মানব দেহে আল্লাহ তায়ালা তিন হাজার রোগব্যাধি দিয়েছেন। এক হাজার হাকিম ডাক্তারগণ জানেন এবং চিকিৎসা করেন। দু’হাজার রোগের ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কেহ জানেন না। যদি কেহ আহাদনামা লিখে সাথে রাখে অথবা দু’বার পাঠ করে আল্লাহ তায়ালা তাকে দু’হাজার ব্যাধি থেকে হিফাজত করবেন। ...’’[16]
এগুলো সবই ভিত্তিহীন ও জাল কথা। সুনানুত তিরমিযী বা অন্য কোনো হাদীস-গ্রন্থে এ সকল কথা সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি।
১০. দোয়ায়ে কাদাহ
প্রচলিত আরেকটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে কাদাহ’। এ দোয়াটির ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।
১১. দোয়ায়ে জামীলা
দোয়ায়ে জামীলা ও এর ফযীলত বিষয়ক যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।
১২. হাফতে হাইকাল
হাফতে হাইকাল নামক এ দোয়ায় মূলত কুরআনের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতগুলোর এরূপ বিভক্তি, বণ্টন ও ব্যবহার কোনো কোনো বুযুর্গের বানানো ও অভিজ্ঞতালব্ধ। এগুলোর ব্যবহার ও ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বিভিন্ন মানুষের কথা, রাসূলুল্লাহর ﷺ কথা বা হাদীস নয়।
১৩. দোয়ায়ে আমান
প্রচলিত আরেকটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দোয়া ‘দোয়ায়ে আমান। এ দোয়ার বাক্যগুলোর অর্থ ভাল। তবে এভাবে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি এবং এর ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট।
১৪. দোয়ায়ে হিযবুল বাহার
প্রচলিত একটি দোয়া ও আমল হলো ‘দোয়ায়ে হিযবুল বাহার’। এ দোয়াটির মধ্যে ব্যবহৃত অনেক বাক্য কুরআন ও হাদীস থেকে নিয়ে জমা করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে এ দোয়াটি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এর কোনোরূপ ফযীলত, গুরুত্ব বা ফায়দাও হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
অনেক বুযুর্গ এগুলোর আমল করেছেন। অনেকে ‘ফল’ পেয়েছেন। অনেকে হয়ত মনে করতে পারেন যে, এসকল দোয়াকে হাদীস বা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা মনে করলে অন্যায় হবে। কিন্তু বুযুর্গদের বানানো দোয়া হিসাবে আমল করতে দোষ কি?
এ সকল দুআ বুজুর্গদের বানানো হিসেবে আমল করা নিষিদ্ধ নয়। মুমিন যে কোনো ভাল বাক্য দিয়ে দোয়া করতে পারেন। তবে এ সকল দোয়ার কোনো সাওয়াব বা ফলাফল ঘোষণা করতে পারেন না। এছাড়া সহীহ হাদীসে অনেক সংক্ষিপ্ত ও সুন্দর দুআ উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলো পালন করলে এরূপ বা এর চেয়েও ভাল ফল পাওয়া যাবে বলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন। এ সকল বানোয়াট ‘সুন্দর সুন্দর’ দোয়ার প্রচলনের ফলে সে সকল ‘নাবাবী’ দোয়া অচল ও পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছে। এ সকল দুআয় বুযুর্গীর ছোয়া থাকলেও নবুওতের নূর নেই। আমাদের জন্য উত্তম নবুওতের নূর থেকে উৎসারিত দুআগুলো পালন করা। এতে দুআ করা ও ফল লাভ ছাড়াও আমরা সুন্নাতকে জীবিত করার এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ভাষায় দুআ করার অতিরিক্ত সাওয়াব ও বরকত লাভ করব। আমি ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে সহীহ হাদীস থেকে অনেক দুআ, মুনাজাত, যিক্র ও ওযীফা উল্লেখ করেছি।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ২/৯৮১, নং ২৫৮৫, মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৬৩, নং ২৬৭৭।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৩০, নং ৩৫০৭, ইবন মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৬৯, নং ৩৮৬১, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬২-৬৩।
[4] ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১১/২১৭।
[5] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১১/২১৭-২১৮, ১১/২২১, নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম ১৭/৫।
[6] নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৫১, মাওয়ারিদুয যামআন ৮/১৪-১৬, জামিউল উসূল ৪/১৭৩-১৭৫।
[7] মৌলবী মো. শামছুল হুদা, নেয়ামুল-কোর্আন, পৃ. ১৭।
[8] প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬।
[9] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৪৬২, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৪৯, ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৩/১২৬, হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩২৬-৩২৯, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৭৬, ৬৮১।
[10] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/২৮৫, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৫২, ২/২১১, ১০/৮২, আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৩৯৪।
[11] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৮৫, নং ২১৩৭।
[12] শাহ ওয়লীউল্লাহ, আল-কাউলূল জামিল, পৃ. ৩৮-৩৯; সিররুল আসরার, পৃ. ৪০।
[13] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪১৪, নং ৫৯১।
[14] মোল্লা আলী কারী, আল-আসরারুল মারফূ’আ, পৃ. ২৯০, নং ১১৩৪, তাহতাবী, হাশিয়াতু তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ, পৃ. ৩১১-৩১২।
[15] আহমাদ, আল-মুসনাদ ১/৪১২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৪০৯; হাকিম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ২/২৭২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৭৪, ১৮৪; তাবারী, আত-তাফসীর ১১/১৫৪।
[16] মাও. মুহাম্মাদ আমজাদ হুসাইন; অজীফায়ে ছালেহীন পৃ. ১৪৪।