আমরা জানি যে, সকল সমাজ, জাতি ও ধর্মে মিথ্যা ও মিথ্যাবাদী ঘৃণিত। সত্যবাদীতা সর্বদা ও সর্বত্র প্রশংসিত ও নন্দিত। এজন্যই আরবের জাহিলী সমাজেও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অতুলনীয় সত্যবাদিতা প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ‘আল-আমীন’ ও ‘আস-সাদিক’: বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সহচর সাহাবীগণকে অনুপম অতুলনীয় সত্যবাদিতার উপর গড়ে তুলেছেন। তাঁদের সত্যবাদিতা ছিল আপোষহীন। কোনো কষ্ট বা বিপদের কারণেই তাঁরা সত্যকে বাদ দিয়ে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেন নি। উপরন্তু তিনি ওহীর নামে ও হাদীসের নামে মিথ্যা বলতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন এবং এর কঠিন শাস্তির কথা বারংবার বলেছেন।
আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে ইচ্ছাকৃত কোনো মিথ্যা তো দূরের কথা, সামান্যতম অনিচ্ছাকৃত ভুল বা বিকৃতিকেও তাঁরা কঠিনতম পাপ বলে গণ্য করে তা পরিহার করতেন।
এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় বা তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে কখনোই কোনো অবস্থায় তাঁর নামে মিথ্যা বলার কোনো ঘটনা ঘটে নি। বরং আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ সাহাবী অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে কোনো হাদীসই বলতেন না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় মদীনার সমাজে কতিপয় মুনাফিক বাস করত। এদের মধ্যে মিথ্যা বলার প্রচলন ছিল। তবে এরা সংখ্যায় ছিল অতি সামান্য ও সমাজে এদের মিথ্যাবাদিতা জ্ঞাত ছিল। এজন্য তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করতেন না এবং তারাও কখনো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলার সাহস বা সুযোগ পাননি।
একটি ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে যে, এক যুবক এক যুবতীর পাণিপ্রার্থী হয়। যুবতীর আত্মীয়গণ তার কাছে তাদের মেয়ে বিবাহ দিতে অসম্মত হয়। পরবর্তী সময়ে সে যুবক তাদের কাছে গমন করে বলে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে তোমাদের বংশের যে কোনো মেয়ে বেছে নিয়ে বিবাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যুবকটি সেখানে অবস্থান করে। ইত্যবসরে তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে এসে বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তিনি বলেন, যুবকটি মিথ্যা বলেছে। তোমরা তাকে জীবিত পেলে মৃত্যুদন্ড প্রদান করবে। ... তবে তাকে জীবিত পাবে বলে মনে হয় না। ... তারা ফিরে যেয়ে দেখেন যে, সাপের কামড়ে যুবকটির মৃত্যু হয়েছে।..[1]
এ বর্ণনাটি নির্ভরযোগ্য হলে এ থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় তাঁর নামে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার একটি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এ বর্ণনাটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল। কয়েকজন মিথ্যায় অভিযুক্ত ও অত্যন্ত দুর্বল রাবীর মাধ্যমে ঘটনাটি বর্ণিত।[2]
সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পরে যতদিন মুসলিম সমাজে সাহাবীগণের আধিক্য ছিল ততদিন তাঁর নামে মিথ্যা বলার কোনো ঘটনা ঘটে নি।
সময়ের আবর্তনে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এ সময়ে অনেক সাহাবী মৃত্যুবরণ করেন। অগণিত নও-মুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলার প্রবণতার উন্মেষ ঘটে। ক্রমান্বয়ে তা প্রসার লাভ করতে থাকে।
২৩ হিজরী সালে যুন্নুরাইন উসমান ইবনু আফফান (রা) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩৫ হিজরী পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর তিনি খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে ইসলামী বিজয়ের সাথে সাথে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইসলামের প্রসার ঘটে। অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মদীনা থেকে বহুদূরে মিশর, কাইরোয়ান, কুফা, বাসরা, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, খোরাসান ইত্যাদি এলাকায় বসবাস করতেন। সাহাবীগণের সাহচর্য থেকেও তারা বঞ্চিত ছিলেন।
তাঁদের অনেকের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী বিশ্বাস, চরিত্র ও কর্মের পূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারে নি। এদের অজ্ঞতা, পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলাম ধর্ম বা আরবদের প্রতি আক্রোশ ইত্যাদির ফলে এদের মধ্যে বিভিন্ন মিথ্যা ও অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইসলামের অনেক শত্রু সামরিক ময়দানে ইসলামের পরাজয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে মিথ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে ইসলামের ধ্বংসের চেষ্টা করতে থাকে। আর সবচেয়ে কঠিন ও স্থায়ী মিথ্যা যে মিথ্যা ওহী বা হাদীসের নামে প্রচারিত হয়। ইসলামের শত্রুরা সে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে।
এসময়ে এ সকল মানুষ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশধরদের মর্যাদা, ক্ষমতা, বিশেষত আলী (রা)-এর মর্যাদা, বিশেষ জ্ঞান, বিশেষ ক্ষমতা, অলৌকিকত্ব, তাকে ক্ষমতায় বসানোর প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে ও উসমান ইবনু আফফান (রা)-এর নিন্দায় অগণিত কথা বলতে থাকে। এ সব বিষয়ে অধিকাংশ কথা তারা বলতো যুক্তিতর্কের মাধ্যমে। আবার কিছু কথা তারা আকারে-ইঙ্গিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামেও বানিয়ে বলতে থাকে। যদিও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে সরাসরি মিথ্যা বলার দুঃসাহস তখনো এ সকল পাপাত্মাদের মধ্যে গড়ে ওঠে নি। তখনো অগণিত সাহাবী জীবিত রয়েছেন। মিথ্যা ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তবে মিথ্যার প্রবণতা গড়ে উঠতে থাকে।
৩য়-৪র্থ হিজরী শতকের অন্যতম ফকীহ, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী (৩১০ হি) ৩৫ হিজরীর ঘটনা আলোচনা কালে বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা ইয়ামানের ইহুদী ছিল। উসমান (রা) এর সময়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর বিভিন্ন শহরে ও জনপদে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কথা প্রচার করতে থাকে। হিজাজ, বসরা, কূফা ও সিরিয়ায় তেমন সুবিধা করতে পারে না। তখন সে মিশরে গমন করে। সে প্রচার করতে থাকে: অবাক লাগে তার কথা ভাবতে যে ঈসা (আঃ) পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন বলে বিশ্বাস করে, অথচ মুহাম্মাদ (ﷺ) পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন বলে বিশ্বাস করে না। ঈসার পুনরাগমনের কথা সে সত্য বলে মানে, আর মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পুনরাগমনের কথা বললে তা মিথ্যা বলে মনে করে।.... হাজারো নবী চলে গিয়েছেন। প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতের একজনকে ওসীয়তের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রদান করে গিয়েছেন। মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রদত্ত ওসীয়ত ও দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি আলী ইবনু আবী তালিব। ... মুহাম্মাদ ﷺ শেষ নবী এবং আলী শেষ ওসীয়ত প্রাপ্ত দায়িত্বশীল।... যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওসীয়ত ও দায়িত্ব প্রদানকে মেনে নিল না, বরং নিজেই ক্ষমতা নিয়ে নিল, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে। ...[3]
এখানে আমরা দেখছি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা নিজের বিভ্রান্তিগুলোকে যুক্তির আবরণে পেশ করার পাশাপাশি কিছু কথা পরোক্ষভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলছে। আলী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাকে দায়িত্ব প্রদান না করা যুলুম ইত্যাদি কথা সে বলছে।
আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, এ সময়ে মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে সত্যপরায়ণতার ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্বলতা দেখা দেয়ায় সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের নামে মিথ্যা বলা প্রতিরোধের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেন।
প্রথম হিজরী শতকের শেষ দিকে নিজ নিজ বিভ্রান্ত মত প্রমাণের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বানোয়াট হাদীস তৈরি করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। সাহাবীগণের নামেও মিথ্যা বলার প্রবণতা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মুখতার ইবনু আবু উবাইদ সাকাফী (১-৬৭ হি) সাহাবীগণের সমসাময়িক একজন তাবিয়ী। ৬০ হিজরীতে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা) -এর শাহাদতের পরে তিনি ৬৪-৬৫ হিজরীতে মক্কার শাসক আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের (১-৭৩ হি) পক্ষ থেকে কুফায় গমন করেন। কুফায় তিনি ইমাম হুসাইনের হত্যায় জড়িতদের ধরে হত্যা করতে থাকেন। এরপর তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের আনুগত্য অস্বীকার করে নিজেকে আলীর পুত্র মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যার প্রতিনিধি বলে দাবী করেন। এরপর তিনি নিজেকে ওহী-ইলহাম প্রাপ্ত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিশেষ প্রতিনিধি, খলীফা ইত্যাদি দাবী করতে থাকেন। অবশেষে ৬৭ হিজরীতে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের বাহিনীর কাছে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।
তার এ সকল দাবীদাওয়ার সত্যতা প্রমাণিত করার জন্য তিনি একাধিক ব্যক্তিকে তার পক্ষে মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলার জন্য আদেশ, অনুরোধ ও উৎসাহ প্রদান করেন। আবু আনাস হাররানী বলেন, মুখতার ইবনু আবু উবাইদ সাকাফী একজন হাদীস বর্ণনাকারীকে বলেন, আপনি আমার পক্ষে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে একটি হাদীস তৈরি করুন, যাতে থাকবে যে, আমি তাঁর পরে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে আগমন করব এবং তাঁর সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করব। এজন্য আমি আপনাকে দশহাজার দিরহাম, যানবাহন, ক্রীতদাস ও পোশাক-পরিচ্ছদ উপঢৌকন প্রদান করব। সে হাদীস বর্ণনাকারী বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে কোনো হাদীস বানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোনো একজন সাহাবীর নামে কোনো কথা বানানো যেতে পারে। এজন্য আপনি আপনার উপঢৌকন ইচ্ছামত কম করে দিতে পারেন। মুখতার বলে: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে কিছু হলে তার গুরুত্ব বেশি হবে। সে ব্যক্তি বলেন: তার শাস্তিও বেশি কঠিন হবে।[4]
মুখতার অনেককেই এভাবে অনুরোধ করে। প্রয়োজনে ভীতি প্রদর্শন বা হত্যাও করেছেন। সালামাহ ইবনু কাসীর বলেন, ইবনু রাব‘য়া খুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগ পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি একবার কুফায় গমন করি। আমাকে মুখতার সাকাফীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমার সাথে একাকী বসে বলেন, জনাব, আপনি তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগ পেয়েছেন। আপনি যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে কোনো কথা বলেন তা মানুষেরা বিশ্বাস করবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে একটি হাদীস বলে আমার শক্তি বৃদ্ধি করুন। এ ৭০০ স্বর্ণমুদ্রা আপনার জন্য। আমি বললাম: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলার নিশ্চিত পরিণতি জাহান্নাম। আমি তা বলতে পারব না।[5]
সাহাবী আম্মার ইবনু ইয়াসারের (রা) পুত্র মুহাম্মাদ ইবনু আম্মারকেও মুখতার তার পক্ষে তাঁর পিতা আম্মারের সূত্রে মিথ্যা হাদীস বানিয়ে প্রচার করতে নির্দেশ দেয়। তিনি অস্বীকার করলে মুখতার তাকে হত্যা করে।[6]
প্রথম হিজরী শতকের শেষ দিক থেকে প্রখ্যাত সাহাবীগণের নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা দেয়। বিশেষত আলী ইবনু আবী তালিব (রা)-এর নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা তাঁর কিছু অনুসারীর মধ্যে দেখা দেয়। তিনি আবু বাকর (রা) ও উমার (রা)-কে মনে মনে অপছন্দ করতেন বা নিন্দা করতেন, তিনি অলৌকিক সব কাজ করতেন, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের বানোয়াট কথা তারা বলতে শুরু করে।
প্রখ্যাত তাবিয়ী ইবনু আবী মুলাইকা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (১১৭ হি) বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসের (৬৮ হি) নিকট পত্র লিখে অনুরোধ করি যে, তিনি যেন আমাকে কিছু নির্বাচিত প্রয়োজনীয় বিষয় লিখে দেন। তখন তিনি বলেন:
وَلَدٌ نَاصِحٌ أَنَا أَخْتَارُ لَهُ الأُمُورَ اخْتِيَارًا وَأُخْفِي عَنْهُ قَالَ فَدَعَا بِقَضَاءِ عَلِيٍّ فَجَعَلَ يَكْتُبُ مِنْهُ أَشْيَاءَ وَيَمُرُّ بِهِ الشَّيْءُ فَيَقُولُ وَاللَّهِ مَا قَضَى بِهَذَا عَلِيٌّ إِلا أَنْ يَكُونَ ضَلَّ
‘‘বিশ্বস্ত ও কল্যাণকামী যুবক। আমি তার জন্য কিছু বিষয় পছন্দ করে লিখব এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিব। তখন তিনি আলী (রা) এর বিচারের লিখিত পান্ডুলিপি চেয়ে নেন। তিনি তা থেকে কিছু বিষয় লিখেন। আর কিছু কিছু বিষয় পড়ে তিনি বলেন: আল্লাহর কসম, আলী এ বিচার কখনোই করতে পারেন না। বিভ্রান্ত না হলে কেউ এ বিচার করতে পারে না।’’[7]
অর্থাৎ আলীর কিছু অতি-উৎসাহী ও অতি-ভক্ত সহচর তাঁর নামে এমন কিছু মিথ্যা কথা এসব পান্ডুলিপির মধ্যে লিখেছে যা তাঁর মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে, যদিও তারা তার মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই এগুলো বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে অন্য তাবিয়ী তাঊস ইবনু কাইসান (১০৬ হি) বলেন:
أُتِيَ ابْنُ عَبَّاسٍ بِكِتَابٍ فِيهِ قَضَاءُ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فَمَحَاهُ إِلا قَدْرَ وَأَشَارَ سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ بِذِرَاعِهِ
‘‘ইবনু আববাস (রা) এর কাছে আলী (রা) এর বিচারের পান্ডুলিপি আনয়ন করা হয়। তিনি এক হাত পরিমাণ বাদে সে পান্ডুলিপির সব কিছু মুছে ফেলেন।’’[8]
প্রখ্যাত তাবিয়ী আবু ইসহাক আস-সাবীয়ী (১২৯ হি) বলেন, যখন আলী (রা)-এর এ সকল অতিভক্ত অনুসারী তাঁর ইন্তেকালের পরে এ সকল নতুন বানোয়াট কথার উদ্ভাবন ঘটালো তখন আলীর (রা) অনুসারীদের মধ্যে এক ব্যক্তি বলেন: আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন! কত বড় ইলম এরা নষ্ট করল![9]
তাবিয়ী মুগীরাহ ইবনু মিকসাম আদ-দাববী (১৩৬ হি) বলেন,
لَمْ يَكُنْ يَصْدُقُ عَلَى عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فِي الْحَدِيثِ عَنْهُ إِلا مِنْ أَصْحَابِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رضي الله عنه.
(আলীর (রা) নামে মিথ্যাচারের কারণে) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদের সাহচর্য লাভ করেছে এমন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ আলী (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করলে তা সঠিক ও নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হতো না।[10]
এভাবে আমরা দেখছি যে, প্রথম হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে ক্রমান্বয়ে মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থে ও উদ্দেশ্যে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা দেয়। যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে এ সব প্রবণতা বাড়তে থাকে। হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে ক্রমেই মিথ্যাবাদীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং মিথ্যার প্রকার ও পদ্ধতিও বাড়তে থাকে। আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদে জালিয়াতদের পরিচয় ও জালিয়াতির কারণ আলোচনা করব। তবে তার আগেই আমরা মিথ্যা প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহর কর্মপন্থা আলোচনা করতে চাই।
[2] যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল ৩/৪০১-৪০২; ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/৫৪, ফাল্লাতা, আল-ওয়াদউ ১/১৮৫-১৮৮।
[3] তাবারী, মুহাম্মাদ ইবনু জারীর (৩১০ হি), তারীখুল উমামি ওয়াল মুলুক ২/৬৪৭।
[4] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/১৬-১৭।
[5] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৮/৪৩৮; আত-তারীখুস সাগীর ১/১৪৭।
[6] বুখারী, আত-তারীখুস সাগীর ১/১৪৭; ইবনু আবী হাতিম, আব্দুর রাহমান ইবনু মুহাম্মাদ (৩২৭ হি), আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ৮/৪৩।
[7] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩।
[8] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩।
[9] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩।
[10] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩।