ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
আদর্শ বিবাহ ও দাম্পত্য বিবাহ ও দাম্পত্য বিষয়াবলী আবদুল হামীদ ফাইযী
বিবাহের দিন

বিবাহ বন্ধন ও মজলিসের জন্য বর, কনে ও অভিভাবক ছাড়া আর মাত্র দুটি লোকের প্রয়োজন। তাও তো মিনিট কয়েকের ব্যাপার। কিন্তু এত বিপুল আয়োজন, এত ঘটা কিসের? এগুলো লোক প্রদর্শন নয় কি? ১০/২০টা ডুলার বিবি, ৮০/১০০টা বরযাত্রী; তাতে অমুসলিমও থাকবে! এত লোকের রাখা ও খাওয়ানোর দায়িত্ব পাত্রীপক্ষের ঘাড়ে। কোন অধিকারে? ‘এত জন পারব না’ বললেও উপায় নেই। সমস্ত কুটুম্বের মান রাখতেই হবে। জোর করে যাবে ১০০ জন বরযাত্রী। পাত্রীপক্ষ বাধ্য হয়েই রাজী হয়। এটা কি যুলুম নয়? যুলুম করে কি কারো বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাওয়া চলে? এমন পেটুকেরা কি লুটেরা নয়? কুটুম বুঝাতে নিজে খাওয়াও। পরের ঘাড়ে কেন কুটুমের মান রাখ? নাকি ‘পরের লেজে পা পড়লে তুলোপানা ঠেকে, আর নিজের লেজে পা পড়লে ক্যঁাক করে ডাকে।’ তাই না?

জোরের বরযাত্রী ভোর থেকেই প্রস্ত্তত। গতকাল পাত্র-পাত্রী সোঁদা ও আটা মেখে গায়ের হলুদ তুলে (আমপাতা দেওয়া) পানিতে গোসল করেছে। বর তার দাড়িগুলোকে বেশ তেল পারা করে চেঁছে মসৃণ গাল বের করেছে! আজ তাদের নবজীবনের নতুন প্রভাত। চারিদিক খুশীতে ডগমগ। কিন্তু কার খেয়াল থাকে যে, ‘কারো পৌষমাস, আর কারো বা সর্বনাশ।’ ‘কারো মোজ হয়, কেউ আমাশয় যায়।’

বর সাজানোর ধুম চলছে বাড়ির এক প্রান্তে। (নিজের অথবা সরকারী) ভাবীরা বরকে ঘিরে পরম আদরে কপালে চুন-কুমকুমের ফোটা, মাথায় মুকুট, গলায় ফুলের মালা, আঙ্গুলে সোনার অঙ্গুরীয়, গলায় সোনার হার, জামায় সোনার বোতাম, গায়ে রেশমের বা হলুদ কিংবা জাফরানী রঙের রুমাল বাঁধা হচ্ছে। যার প্রত্যেকটিই হারাম।

অন্য দিকে শাড়ি দেওয়া হয়নি বলে বড় ভাবী রাগ করেছে; তাই ডুলার বিবি যাবে না। ছোট বুনুইকে জামা-প্যান্ট দেওয়া হয়নি বলে রাগ করেছে; তাই বরযাত্রী যাবে না। বন্ধুকে বরযাত্রী না নিয়ে গেলে সেজো ভাইও বিয়েতে যাবে না বলছে। ও পাড়ার সাজু রাগ করেছে, সেও বরযাত্রী যাবে না। কারণ, তার চাচাকে বরযাত্রী বলা হয়নি তাই! ওদের সকলের রাগ মানাবার চেষ্টা চলছে।

বরকে কোলে তুলে পাল্কি বা গাড়িতে বসালো তার বুনাই অথবা চাচাতো ভাই। মা এল তেলের ভাঁড় ও পানির বদনা হাতে ছেলের কাছে। কয়জন মেয়ে মা-বেটাকে দিল কাপড় ঢেকে। মা ছেলের পায়ে তেল দিয়ে পানি দ্বারা পা ধুয়ে দিল! সস্নেহে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছ বাবা?’ ছেলে সত্বর জবাব দিল, ‘তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি মা!’ এরপর গাড়ি বা পাল্কি ছুটে পাত্রীর গ্রাম বা শহরের দিকে।

বলাই বাহুল্য যে, পূর্বের ঐ কীর্তিগুলো ইসলামের কিছু নয়। পরন্তু পয়সা নিয়ে দাসী আনার প্রভাব বহু সংসারেই বহু বধূর উপর পড়ে থাকে।

বরযাত্রীর গাড়ি পূর্বেই ছুটেছিল। থামল গ্রামের বাইরে। কেউ কোত্থাও নেই। ব্যাপার কি? এত অসামাজিক পাত্রীপক্ষ! নিমন্ত্রণ করতে বা আগে বাড়িয়ে (সংবর্ধনা জানিয়ে) নিতে আসে নি কেউ! দাওয়াত না দিলে কি কারো বাড়ি মেহেমান যাওয়া হয়। এত নীচ ও ছোঁচা নয় বরপক্ষ। তবে জালেম নিশ্চয় বটে। কারণ, জোরপূর্বক তো এত লোক সঙ্গে এনেছে তারা। জোর করে মেহেমান এসে আবার দাওয়াতের অপেক্ষা কেন? জালেমের মত ঢুকে পড়, আর লুটেরার মত পেটে ভর। দোষ কি তাতে? দেশাচার তো! নির্মম শোষণ হলেই বা ক্ষতি কি?

রাগ নিয়েই প্রবেশ করে বরযাত্রী। কনেপক্ষ ভুল স্বীকার করে কত কষ্টে রাগ মানায়। তবুও অসংগত মন্তব্য থেকে রেহাই পায় না। আবার এখানে তো ‘বাবু যত বলে, পারিষদ্ দলে বলে তার শতগুণ।’ কে কার মুখে হাত দেবে? যদি বিয়ে ঘুরে যায়!

বরানুগমন হলে সসম্মানে তাকে কোলে করে নামানো হয়। প্রথমে মসজিদে সালাম (?) অথবা দুই রাকআত নামায পড়ানো হয়। (এটি বিদআত, অবশ্য মসজিদে গেলে বা মসজিদে বিয়ে রাখলে সকলকেই তাহিয়্যাতুল মসজিদ দু’রাকআত পড়তে হয়। প্রকাশ যে, মসজিদে বিয়ে রেখে বরযাত্রীদের ধুমপান, অসংগত কথাবার্তা প্রভৃতি দ্বারা তার পবিত্রতা হানি করা অবশ্যই হারাম।) এরপর পীরতলায়, ইমামতলায় সালাম (?) করানো হয়। তারপর (কোন কোন এলাকায়) শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গিয়ে বরাসন সাত চক্র তওয়াফ করিয়ে বসানো হয়। এই সময় নাকি কনে লুকিয়ে কোন ফাঁক থেকে বরকে দেখে (পছন্দ করে) থাকে। কিন্তু এ সময় অপছন্দ হলেও কি বিয়ে ফিরিয়ে দিতে পারবে?

অতঃপর বর আসে বিবাহ মজলিসের ‘আলম তালায়।’ বড় বিনীত হয়ে রুমাল হাতে নিয়ে ঝুঁকে বিছানায় সালাম (?) করে। কি জানি, ‘আসসালামু আলাইকুম’ ব’লে সালাম হয়তো জানেও না। এরপর কেবলা মুখে নামাযে বসার মত (প্রায় সর্বদাই বসে)।

এই সময় অনেক জায়গায় প্যান্ডেলের গেটে দাঁড়িয়ে দুই প্রসাধিকা যুবতী কপালে চন্দনের ফোটা দিয়ে এবং গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বর ও বরযাত্রী বরণ করে!

তারপর শুরু খাওয়া-দাওয়া ও ভুঁড়িভোজন; অর্ধেক খাওয়া, অর্ধেক ফেলা। মিষ্টিখোরের দল তো গোনা-গাঁথা ৭০/৮০ টা রসগোল্লা খাবেই। না পারলে নিংড়ে-নিচুরে, চুরি করে লঙ্কা কামড়ে বা লেবু চুসেও পেটে ভরবে। পরে বমি হয়ে গেলেও ছাড়বে কেন? পয়সা তো লাগছে না।

এর পরেও যদি কিছু আনতে বা দিতে একটু বিলম্ব হয় তাহলে প্লেট উবুর হবে অথবা ফেলা হবে ছুঁড়ে! আরো কত অশালীন আচরণ এই বদ্যাত্রীদের! কিসের এত দাপ্, কেন এত বাপুত্তি অধিকার ফলানো? কারণ, হয়তো পাত্রীর বাপ চোরের দায়ে ধরা পড়েছে তাই। কন্যাদায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বরপক্ষের এত পায়ে ধরা। খাইয়ে-দাইয়েও যদি তারা গালে চড়ও মারে, তবুও গাল পেতে নীরবে সহ্য করে নিতে হবে। নচেৎ যদি বিয়ে ঘুরে যায়! নিহাতই মজবুর পাত্রীপক্ষ!

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا وَلاَ تُسْرِفُوْا، إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُسْرِفِيْن﴾

‘‘তোমরা পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’’[1]

﴿وَلاَ تُبَذِّرْ تَبْذِيراً- إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُوراً﴾

‘‘আর তোমরা কিছুতেই অপব্যয় করো না। যারা অপব্যয় করে তারা অবশ্যই শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’’[2]

﴿إِنَّمَا السَّبِيلُ عَلَى الَّذِينَ يَظْلِمُونَ النَّاسَ وَيَبْغُونَ فِي الأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ﴾

‘‘তাদের বিরুদ্ধেই (শাস্তির) ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অহেতুক বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়।’’[3]

﴿إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الظَّالِمِينَ﴾

‘‘আর তিনি অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন না।’’[4]

দয়ার নবী (ﷺ) বলেন,

الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ. التَّقْوَى هَا هُنَا .... بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ.

‘‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। কেউ কারো প্রতি যুলুম করবে না এবং কেউ কাউকে অসহায় ছেড়ে দেবে না। তাকওয়া হল হৃদয়ের জিনিস। আর কোন মানুষের মন্দের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে ঘৃণা করে। পরন্তু প্রত্যেক মুসলিমের জান, মাল ও ইজ্জত প্রত্যেক মুসলিমের জন্য হারাম করা হয়েছে।[5]

পাঠকমাত্রেই আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে, উপর্যুক্ত কর্মকান্ড ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের সপক্ষে কোন সমর্থনই ইসলামে নেই। তাছাড়া পাত্রীপক্ষের প্রতি এমন অভদ্র আচরণ শুধু ইসলাম বিরোধীই নয়; বরং অমানবিকও।

এখানে পাত্রীপক্ষেরও উচিৎ নয় কষ্ট স্বীকার করে নাম কিনতে যাওয়া এবং অপব্যয় করে বিভিন্ন খাদ্যের ভ্যারাইটিজ প্রস্ত্তত করা। কারণ, ‘‘অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’’[6] যেমন মেহেমানদের অসম্মান হতে না দেওয়াও তাদের কর্তব্য।

ওদিকে ডুলার (দোলার) বিবিরাও পর্দার ডুলি থেকে বের হয়ে বেগানা পুরুষের হাতে খাওয়া-দাওয়ার কর্তব্য (?) পালন করছে। আর মনে মনে চিন্তা করছে ‘কে কেমন কাপড় উপহার পাবে।’ কাপড় খারাপ হলে তো রেহাই নেই।

[1] (সূরা আল-আ‘রাফ (৭) : ৩১)

[2] (সূরা আল-ইসরা (১৭) : ২৬-২৭)

[3] (সূরা আশ-শূরা (৪২) : ৪২)

[4] (সূরা আশ-শূরা (৪২) : ৪০)

[5] (মুসলিম ২৫৬৪নং)

[6] (সূরা আল-ইসরা (১৭) : ২৭)