ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত ছালাতের পদ্ধতি মুযাফফর বিন মুহসিন
(২৫) মুনাজাত করা

(২৫) মুনাজাত করা :

অধিকাংশ মসজিদে ফরয ছালাতের সালাম ফিরানোর পর পরই দুই হাত তুলে প্রচলিত মুনাজাত করা হয়। অথচ এই প্রথার শারঈ কোন ভিত্তি নেই। এরপরও বিদ‘আতের পৃষ্ঠপোষক একশ্রেণীর আলেম কিছু বানোয়াট ও মিথ্যা বর্ণনা পেশ করে এর পক্ষে উকালতি করে থাকেন। তাদের দাপট দেখে মনে হয় এটাই শরী‘আত, শরী‘আতে আর কোন বিধান নেই; শিরক-বিদ‘আত, সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারী, হারাম-নোংরামী পরিত্যাগ না করলেও তথাকথিত মিথ্যা মুনাজাতই তাদেরকে যেন জান্নাতে নিয়ে যাবে। উক্ত কাল্পনিক প্রথাকে চালু রাখার জন্য একশ্রেণীর আলেম যে সমস্ত বর্ণনা পেশ করে থাকেন, তার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল-

(১) عَنِ الْأَسْوَدِ الْعَامِرِىِّ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ الْفَجْرَ فَلَمَّا سَلَّمَ اِنْحَرَفَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَدَعَا.

(১) আসওয়াদ আল-আমেরী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি একদা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ফজরের ছালাত আদায় করলাম। তিনি সালাম ফিরিয়ে ঘুরে বসলেন এবং তাঁর দু’হাত উঠালেন ও দু‘আ করলেন।[1]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। সনদগত ত্রুটি হল- বলা হয়ে থাকে আসওয়াদ আল-আমেরী। অথচ মূল নাম হল, জাবির ইবনু ইয়াযীদ ইবনুল আসওয়াদ আস-সাওয়াঈ।[2] উপনাম হিসাবে আল-আমেরী উল্লেখ করা হয়। সেটাও ভুল। মূলতঃ এই লক্বব হবে তার পূর্বের রাবীর নামের সাথে। অর্থাৎ ইয়া‘লা ইবনু আত্বা আল-আমেরী।[3]

দ্বিতীয়তঃ সবচেয়ে মারাত্মক যে বিভ্রান্তি তা হল, মূল হাদীছের সাথে অন্য কারো কথা যোগ করা । উক্ত হাদীছের শেষের অংশ (وَرَفَعَ يَدَيْه وَدعَا) ‘অতঃপর তিনি দু’হাত তুললেন এবং দু‘আ করলেন’ মূল কিতাবে নেই। হাদীছটি মিয়া নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী (১৮০৫-১৯০২ খৃঃ) তাঁর ‘ফাতাওয়া নাযীরিয়াতে’ উল্লেখ করেছেন এভাবেই। অতঃপর আবদুর রহমান মুবারকপুরী (১৮৬৫-১৯৩৫ খৃঃ)ও তাঁর গ্রন্থ ‘তুহফাতুল আহওয়াযীতে’ হুবহু ঐভাবে উল্লেখ করেছেন এবং তাঁরা উভয়েই মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বার বরাত দিয়েছেন। কিন্তু মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাতে শেষের ঐ অংশটুকু নেই।[4]


শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এতে মিথ্যা ও ত্রুটি উভয়টিই সংযুক্ত হয়েছে।[5] অতঃপর তিনি বলেন,

أَمَّا الْكِذْبُ فَقَوْلُهُ وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَدَعَا فَإِنَّ هَذِهِ الزِّيَادَةِ لَاأَصْلَ لَهَا فِى الْمُصَنَّفِ لَا عِنْدَ غَيْرِهِ مِمَّنْ أَخَرَجَ الْحَدِيْثَ وَإِنَّمَا هِىَ مِمَّا أَمْلَاهُ عَلَيْهِ هَوَاهُ وَالْعِيَاذُ بِاللهِ تَعَالَى.

‘মিথ্যা হওয়ার কারণ হল, উক্ত বাড়তি অংশ। আর মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাতে এই অতিরিক্ত অংশের অস্তিত্ব নেই। অন্য কারো নিকটেও নেই, যারা এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। এটা মূলতঃ প্রবৃত্তির তাড়নায় কেউ সংযোগ করেছে। এর থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পরিত্রাণ চাচ্ছি!’ [6]

এক্ষণে প্রশ্ন হল, এই অতিরিক্ত অংশটুকু তাঁরা কিভাবে স্ব স্ব গ্রন্থে উল্লেখ করলেন? বলা যায়, তারা মূল কিতাব না দেখেই উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) যে মূল গ্রন্থ না দেখেই উল্লেখ করেছেন, তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, ‘এভাবেই কিছু ওলামায়ে কেরাম হাদীছটি সনদ ছাড়াই উল্লেখ করেছেন এবং মুছান্নাফ ইবনে শায়বার দিকে সম্বোন্ধিত করেছেন। আমি এর সনদ সম্পর্কে অবগত নই’।[7]

অনুরূপ মিয়া নাযীর হুসাইন দেহলভীও যে মূল কিতাব না দেখেই উদ্ধৃত করেছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ ফাতাওয়া নাযীরিয়াতে এ সংক্রান্ত ৪টি প্রশ্নোত্তর উল্লেখ করা হয়েছে। চারটিতেই উক্ত হাদীছ একইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।[8] অতএব এটা জানার পরও যদি এই বর্ণনাকে মুনাজাতের দলীল হিসাবে পেশ করা হয়, তাহলে রাসূল (ছাঃ)-এর নামে মিথ্যারোপ করা হবে।

(২) عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنِ النَّبِىِّ أَنَّهُ قَالَ مَا مِنْ عَبْدٍ بَسَطَ كَفَّيْهِ فِىْ دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ ثُمَّ يَقُوْلُ اللهُمَّ إِلهِىْ وَإِلهَ إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ وَإلهَ جِبْرِيْلَ وَمِيْكَائِيْلَ وَإِسْرَافِيْلَ عَلَيْهِمُ السَّلَامُ أَسْأَلُكَ أَنْ تَسْتَجِيْبَ دَعْوَتِىْ فَإِنِّىْ مُضْطَرُّ وَتَعْصِمُنِىْ فِىْ دِيْنِىْ فَإِنَّ مُبْتَلى وَتَنَالُنِىْ بِرَحْمَتِكَ فَإنِّىْ مُذْنِبٌ وَتُنْفِىْ عَنِّىْ الْفَقْرَ فَإنِّىْ مُتَمَسِّكُنَّ إلّا كَانَ حَقًّا عَلى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ أَنْ لَّايَرُدَّ يَدَيْهِ خَائِبِيْنَ.

(২) আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন বান্দা যখন প্রত্যেক ছালাতের পর স্বীয় দু’হাত প্রসারিত করে বলে, হে আমার আল্লাহ! ইবরাহীম, ইসহাক্ব, ইয়াকূবের আল্লাহ এবং জিবরীল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের আল্লাহ! আমি আপনার নিকট কামনা করছি যে, আপনি আমার দু‘আ কবুল করুন। কারণ আমি বিপদগ্রস্ত। আমাকে আমার দ্বীনের উপর অটল রাখুন। কারণ আমি দুর্দশা কবলিত। আমার প্রতি রহম করুন, আমি পাপী। আমার দরিদ্র্যতা দূর করুন, নিশ্চয়ই আমি ধৈর্যধারণকারী। তখন তার দু’হাত নিরাশ করে ফিরিয়ে না দেওয়া আল্লাহর জন্য বিশেষ কর্তব্য হয়ে যায়’। [9]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। উক্ত বর্ণনাটি মুহাম্মাদ তাহের পাট্টানী তার জাল হাদীছের গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।[10] কারণ এটি বিভিন্ন দোষে দুষ্ট। (ক) এর সনদে দুইজন রাবীর নাম ভুল রয়েছে। আবদুল আযীয ইবনু আবদুর রহমান আল-ক্বারশী। অথচ রিজালশাস্ত্রে এ নামের কোন ব্যক্তিকে পাওয়া যায় না। মূল নাম হবে আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুর রহমান আল-বালেসী।[11]

(খ) আবু ইয়াকূব ইসহাক্ব ইবনু খালিদ ইবনু ইয়াযীদ আল-বালেসী নামক রাবীও দুর্বল।[12] (গ) আব্দুল আযীয নামক বর্ণনাকারীও ত্রুটিপূর্ণ।[13] (ঘ) খুছাইফ নামক ব্যক্তিও নানা অভিযোগে অভিযুক্ত।[14] উল্লেখ্য যে, উক্ত মর্মে আরো অনেক জাল ও যঈফ হাদীছ রয়েছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ‘শারঈ মানদন্ডে মুনাজাত’ বইটি দেখুন।

[1]. শায়খুল কুল ফিল কুল সাইয়িদ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী (১৮০৫-১৯০২), ফাতাওয়া নাযীরিয়াহ (দিল্লী: ইদারাহ নূরুল ঈমান, ৩য় প্রকাশ: ১৪০৯/১৯৮৮), ১/৫৬৫ পৃঃ; আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী (বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪১০/১৯৯০), ২/১৭১ পৃঃ, হা/২৯৯ এর ব্যাখ্যা দ্রঃ, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘সালামের পর কী বলা হয়’ অনুচ্ছেদ।

[2]. তাহযীবুত তাহযীব ২/৪২ পৃঃ, রাবী- ৯৩০।

[3]. তাহযীবুত তাহযীব, ১১/৩৫১ পৃঃ, রাবী- ৮১৬৬।

[4]. দেখুনঃ হাফেয আব্দুল্লাহ ইবনু আবী শায়বাহ, আল-মুছান্নাফ (বৈরুত ছাপা: দারুল ফিকর, প্রথম প্রকাশঃ ১৪০৯ হিঃ/১৯৮৯ খৃঃ), ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৭।

[5]. َوفِيْهِ كِذْبٌ وَخَطَأٌ -সিলসিলা যঈফাহ ১২/৪৫৩ পৃঃ।

[6]. সিলসিলা যঈফাহ ১২/৪৫৩ পৃঃ।

[7]. তুহফাতুল আহওয়াযী শরহে তিরমিযী, ২/১৭১ পৃঃ, ২৯৯ নং হাদীছের শেষ আলোচনা দ্রঃ-كَذَا ذَكَرَ بَعْضُ الْأَعْلَامِ هَذَا الْحَدِيْثَ بِغَيْرِ سَنَدِ الْمُصَنَّفِ وَلَمْ أَقِفْ عَلَى سَنَدِهِ।

[8]. দেখুনঃ ফাতাওয়া নাযীরিয়াহ, ১/৫৬০-৫৭০ পৃঃ।

[9]. হাফেয আবুবকর ইবনুস সুন্নী (মৃঃ ৩৬৪হিঃ), আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ হা/১৩৫, পৃঃ ৪৯; মু‘জামু ইবনুল আরাবী, ১১৭৩।

[10]. মুহাম্মাদ তাহের পাট্টানী, তাযকিরাতুল মাওযু‘আত (বৈরুত ছাপা : ১৯৯৫), পৃঃ ৫৮।

[11]. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আয-যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল ফী নাক্বদির রিজাল (বৈরুত : দারুল মা‘রেফাহ, ১৯৬৩খৃঃ/১৩৮২হিঃ), ২/৬৩১ পৃঃ, রাবী নং-৫১১২।

[12]. رَوَى غَيْرَ حَدِيْثٍ مُنْكَرٍ يَدُلُّ عَلَى ضُعْفِهِ -মীযানুল ই‘তিদাল ১ম খন্ড, পৃঃ ১৯০।

[13]. قَدْ حَدَّثَ عَبْدُ الْعَزِيْزِ عَنْهُ عَنْ أَنَسٍ بِحَدِيْثٍ مُنْكَرٍ -আহমাদ ইবনু আলী ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪১৫/১৯৯৪), ৩/১৩০পৃঃ, রাবী নং ১৭৯৫ -এর আলোচনা।

[14]. তাহযীবুত তাহযীব, ৩/১৩০।