আগে হাত রাখার ছহীহ হাদীছ সমূহ :
সুন্নাত হল সিজদায় যাওয়ার সময় আগে মাটিতে হাত রাখা। উক্ত মর্মে অনেক ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَبْرُكْ كَمَا يَبْرُكُ الْبَعِيْرُ وَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন সিজদা করবে, তখন যেন উটের শয়নের মত না করে। সে যেন দুই হাঁটুর আগে দুই হাত রাখে’।[1]
উক্ত হাদীছ সম্পর্কে আব্দুল হক আল-আশবীলী বলেন, পূর্বের হাদীছের চেয়ে এই হাদীছের সনদ অধিক উত্তম।[2] অন্যত্র তিনি এই হাদীছকে ছহীহ বলেছেন।[3] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এর সনদ ছহীহ।[4] ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, وَ هُوَ أَقْوَى مِنْ حَدِيْثِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ ‘এই হাদীছ ওয়ায়েল ইবনু হুজুরের হাদীছের চেয়ে অধিক শক্তিশালী’। অতঃপর তিনি বলেন, فَإِنَّ لِلْأَوَّلِ شَاهِدًا مِنْ حَدِيْثِ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ صَحَّحَهُ اِبْنُ خُزَيْمَةَ وَذَكَرَهُ اَلْبُخَارِيُّ مُعَلَّقًا مَوْقُوفًا ‘প্রথম হাদীছের জন্য ইবনু ওমর (রাঃ)-এর হাদীছটি সাক্ষী, যাকে ইবনু খুযায়মাহ ছহীহ বলেছেন এবং ইমাম বুখারী (রহঃ) তা‘লীকসূত্রে মওকূফ হিসাবে বর্ণনা করেছেন’।[5]
উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছ সম্পর্কে আবু সুলাইমান আল-খত্বীব বলেন, এই হাদীছের চেয়ে ওয়ায়েল বিন হুজরের হাদীছ অধিক প্রামাণ্য। মানসূখও বলা হয়।[6] এর জবাবে শায়খ আলবানী বলেন,
هَذَا أَبْعَدُ مَا يَكُوْنُ عَنِ الصَّوَابِ مِنْ وَجْهَيْنِ الْأَوَّلُ أَنَّ هَذَا إِسْنَادَهُ صَحِيْحٌ وَحَدِيْثُ وَائِلٍ ضَعِيْفٌ كَمَا عَلَّقْتُ الثَّانِىْ أَنَّ هَذَا قَوْلٌ وَذَاكَ فِعْلٌ وَالْقَوْلُ مُقَدَّمٌ عَلَى الْفِعْلِ عِنْدَ التَّعَارُضِ وَوَجْهٌ ثَالِثٌ وَهُوَ أَنَّ لَهُ شَاهِدًا مِنْ فِعْلِهِ .
‘দুই দিক থেকে উক্ত কথা সত্য থেকে বহু দূরে। প্রথমতঃ এই হাদীছের সনদ ছহীহ আর ওয়ায়েলের হাদীছ যঈফ। দ্বিতীয়তঃ এটা রাসূলের কথা আর ঐটা কাজ। আর বিরোধের সময় কাজের উপর কথা প্রাধান্য পায়। তৃতীয়তঃ রাসূল (ছাঃ)-এর কাজও তার সাক্ষী হিসাবে বর্ণিত হয়েছে’।[7]
অনুরূপভাবে আগ হাঁটু রাখার পক্ষে যাদুল মা‘আদের মধ্যে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) যে সমস্ত বর্ণনা পেশ করেছেন, তার ভাষ্যকার শু‘আয়েব আরনাঊত্ব ও আব্দুল কাদের আরনাঊত্ব সেগুলোর পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেন যে, লেখকের সকল দলীল তাঁর বিপক্ষে গেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত আগে হাত রাখার হাদীছ নিঃসন্দেহে ছহীহ এবং ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বর্ণিত আগে হাঁটু রাখার হাদীছ যঈফ।[8]
হাঁটুর ব্যাখ্যা :
অনেকে উক্ত হাদীছের প্রথম অংশকে দ্বিতীয় অংশের বিরোধী মনে করেছেন। কারণ উটের বসা গরু-ছাগলের বসার মতই। চতুষ্পদ জন্তুর সামনের দু’টিকে হাত ও পেছনের দু’টিকে পা বলা হয়। উট বসার সময় প্রথমে হাত বসায়। অথচ হাদীছের প্রথম অংশে উটের মত বসতে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ রুকূ থেকে সিজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে হাত রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু হাদীছের শেষ অংশে প্রথমে হাত রাখতে বলা হয়েছে। তাই হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) সহ অনেকে প্রথমে হাঁটু রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
কিন্তু উক্ত যুক্তি সঠিক নয়। কারণ চতুষ্পদ জন্তুর হাতেই হাঁটু। যার প্রমাণে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে মদ্বীনার দিকে রওয়ানা হন, তখন কুরাইশ নেতারা রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা করতে পারলে একশত উট দেওয়ার পুরস্কার ঘোষণা দেয়। এই পুরস্কারের লোভে সুরাকাহ বিন জু‘শুম ঘোড়া ছুটিয়ে যখন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটবর্তী হল, তখন সে বলে যে, سَاخَتْ يَدَا فَرَسِىْ فِي الأَرْضِ حَتَّى بَلَغَتَا الرُّكْبَتَيْنِ ‘আমার ঘোড়ার হাত দু’টি হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে দেবে গেল’।[9]
ইমাম ত্বাহাবী বলেন, إَِنَّ الْبَعِيْرَ رُكْبَتَاهُ فِىْ يَدَيْهِ وَكَذَلِكَ فِىْ سَائِرِ الْبَهَائِمِ وَبَنُو آدَمَ لَيْسُوْا كَذَلِكَ ‘নিশ্চয় উটের দুই হাঁটু হল দুই হাতে। অনুরূপ প্রত্যেক চতুষ্পদ জন্তুরই তাই। আদম সন্তান তাদের মত নয়।[10] জাহেয বলেন, চতুষ্পদ জন্তুর হাঁটু হল হাতে এবং মানুষের হাঁটু হল পায়ে।[11]
অতএব উট ও অন্যান্য চতুষ্পদ জন্তুর হাতেই হাঁটু। তাই রাসূল (ছাঃ) সিজদায় যাওয়ার সময় উটের মত প্রথমে হাঁটু না দিয়ে হাত রাখার নির্দেশ দান করেছেন। তাছাড়া নিম্নের হাদীছ দ্বারাও আগে হাত রাখার আমল স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় :
عَنِ بْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّهُ كَانَ إِذَا سَجَدَ بَدَأَ بِوَضْعِ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ وَكاَنَ يَقُوْلُ كَانَ النَّبِىُّ يَصْنَعُ ذَلِكَ.
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন সিজদা করতেন, তখন দুই হাঁটু রাখার পূর্বে আগে দুই হাত রাখতেন। আর তিনি বলতেন, নবী (ছাঃ) এমনটি করতেন।[12] অতএব উটের হাঁটুর ব্যাখ্যা না করলেও চলে। দলীলের সামনে আত্মসমর্পণ করলেই মতানৈক্য দূরিভূত হয়।
উল্লেখ্য যে, অনেকে আগে হাঁটু রাখার আমলের পক্ষেই অবস্থান নেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সিজদায় যাওয়ার সময় আগে হাত রাখেন এবং উঠার সময় হাতের উপর ভর দিয়ে উঠেন। ইমাম আওযাঈ বলেন, আমি লোকদেরকে পেয়েছি এই অবস্থায় যে, তারা তাদের হাতকে হাঁটুর পূর্বে রাখত।[13] ইবনু হাযম আগে হাত রাখাকে ফরয ও অপরিহার্য বলেছেন।[14]
[2]. إنه أحسن إسنادا من الذى قبله কিতাবুত তাহাজ্জুদ ১/৫৬।
[3]. আল-আহকামুল কুবরা ১/৫৪ পৃঃ।
[4]. তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৮৯৯-এর টীকা দ্রঃ।
[5]. বুলূগুল মারাম হা/৩০৬, পৃঃ ৮২; বুখারী ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২৮, হা/৮০৩ -এর আলোচনা দ্রঃ, ১/১১০ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৬৭-এর আলোচনা দ্রঃ, ২/১৩০ পৃঃ)।
[6]. মিশকাত হা/৮৯৮ حديث وائل بن حجر أثبت من هذا قيل منسوخ।
[7]. মিশকাত হা/৮৯৯, ১/২৮৩ পৃঃ; ৮৯৮ নং হাদীছের টীকা সহ দ্রঃ।
[8]. যাদুল মা‘আদ (বৈরূত ১৪১৬/১৯৯৬) ১/২২৩ টীকা-১।
[9]. বুখারী হা/৩৯০৬, ১/৫৫৪ পৃঃ, ‘মর্যাদা’ অধ্যায়, ‘নবী (ছাঃ)-এর হিজরত’ অনুচ্ছেদ-৪৫।
[10]. ত্বাহাবী হা/১৪০৭-এর আলোচনা দ্রঃ; তামামুল মিন্নাহ, পৃঃ ১৯৫।
[11]. জাহেয, কিতাবুল হায়ওয়ান, ২/৩৫৫ পৃঃ।
[12]. ত্বাহাবী হা/১৪০৫; ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৬২৭, সনদ ছহীহ; মুস্তাদরাক হাকেম হা/৮২১; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/২৭৪৪; আলবানী, মিশকাত ১ম খন্ড, পৃঃ ২৮২, টীকা নং ১।
[13]. মাসায়েল ১/১৪৭ পৃঃ; আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন নবী (ছাঃ), পৃঃ ১৪০।
[14]. মুহাল্লা, মাসআলা নং ৪৫৬, ৪/১২৮ পৃঃ- فرض على كل مصل ان يضع إذا سجد يديه على الارض قبل ركبتيه ولا بد ।