জনগণকে ছালাতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ‘ফাযায়েলে আমলের’ মধ্যে এমন কিছু তথ্য ও কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, আজগুবি ও অবাস্তব। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হল :
(১) ‘যে ব্যক্তি ফরয ছালাত সমূহের যথাযথ হেফাযত করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে পাঁচ দিক থেকে সম্মানিত করবেন। যেমন- (ক) সংসারের অভাব-অনটন দূর করবেন (খ) কবরের আযাব মাফ করবেন (গ) বিচারের দিন ডান হাতে আমলনামা দিবেন (ঘ) পুলছিরাতের উপর দিয়ে দ্রুত গতিতে পার হয়ে যাবে (ঙ) বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ছালাতের ব্যাপারে অলসতা করবে তাকে পনের প্রকারের শাস্তি প্রদান করা হবে। তার মধ্যে পৃথিবীতে পাঁচ প্রকার, মৃত্যুর সময় তিন প্রকার, তিন প্রকার কবরে, কবর হতে উঠার পর তিন প্রকার। পৃথিবীতে পাঁচ প্রকার হল- (ক) তার জীবনে কোন কল্যাণ আসে না (খ) তার চেহারা হতে জ্যোতি দূর করা হয় (গ) তার সৎ আমলের কোন প্রতিদান দেওয়া হয় না (ঘ) তার দু‘আ কবুল হয় না (ঙ) সৎ ব্যক্তিদের দু‘আর মাঝে তার কোন অংশ থাকে না।
মৃত্যুর সময়ের তিন প্রকার শাস্তি হল- (ক) সে লাঞ্ছনার সাথে মৃত্যুবরণ করে (খ) ক্ষুধার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে (গ) এমন তৃষ্ণার্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে যে, সমুদ্র পরিমাণ পানি পান করলেও তার পিপাসা দূর হবে না। কবরে তিন প্রকার শাস্তি হল- (ক) তার জন্য কবর এমন সংকীর্ণ হবে যে, তার বুকের একদিকের হাড় অপরদিকে ঢুকে যাবে (খ) কবরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে (গ) এমন একটি সাপ তার কবরে রাখা হবে যার চক্ষুগুলো আগুনের এবং নখগুলো লোহার। সাপটি এত বড় যে, একদিনের পথ চলার পর শেষ পর্যন্ত পৌঁছা যাবে। এর হুংকার বজ্রের মত। সাপটি বলবে, আমার প্রভু তোমার জন্য আমাকে নির্ধারণ করেছেন, যেন ফজরের ছালাত ত্যাগ করার কারণে সূর্যোদয় পর্যন্ত তোমাকে দংশন করতে পারি, যোহরের ছালাত না পড়ার কারণে যেন আছর পর্যন্ত এবং আছরের ছালাত না পড়ার কারণে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দংশন করতে পারি। অনুরূপ মাগরিবের ছালাত না পড়ার কারণে এশা পর্যন্ত এবং এশার ছালাত নষ্ট করার কারণে সকাল পর্যন্ত দংশন করতে পারি। এই সাপ একবার দংশন করলে সত্তর হাত মাটির নীচে মুর্দা ঢুকে যাবে। এভাবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার শাস্তি হতে থাকবে।
কবর হতে উঠার পর তাকে তিন প্রকারের শাস্তি দেওয়া হবে। (ক) কঠিনভাবে তার হিসাব নেওয়া হবে (খ) আল্লাহ তার উপর রাগান্বিত থাকবেন (গ) তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। পনের নম্বরটি পাওয়া যায় না। তবে অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তার মুখমণ্ডলে তিনটি লাইন লেখা থাকবে : (ক) আল্লাহর হক বিনষ্টকারী (খ) ওহে আল্লাহর অভিশাপে অভিশপ্ত (গ) দুনিয়াতে যেমন আল্লাহর হক বিনষ্ট করেছ তেমনি আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়েছে’।[1]
পর্যালোচনা : পুরো বর্ণনাটি মিথ্যা ও বাতিল। কারণ এর কোন সনদ নেই, বর্ণনাকারীও নেই।[2] ফাযায়েলে আমলের মধ্যেই বর্ণনাটির পর্যালোচনায় এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘এই হাদীছ মিথ্যা’।[3]
(২) জামা‘আতের সাথে এক ওয়াক্ত ছালাত আদায় করলে তিন কোটি পঁয়ত্রিশ লক্ষ চুয়ান্ন হাযার চারশ‘ বত্রিশ গুণ নেকী হবে।[4]
পর্যালোচনা : হাদীছে বলা হয়েছে যে, জামা‘আতে ছালাত আদায় করলে একাকী পড়ার চেয়ে ২৫ গুণ বা ২৭ গুণ বেশী ছওয়াব পাওয়া যাবে।[5] অন্য হাদীছে রয়েছে, পঁচিশটি ছালাতের নেকী হবে।[6] উক্ত দুই হাদীছের ফযীলতের উদ্ভট ব্যাখ্যা দিয়ে কোটি কোটি বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
(৩) সাঈদ ইবনু মুসাইয়িব (রহঃ) পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত এশা ও ফজরের ছালাত একই ওযূ দ্বারা পড়েছেন।[7]
(৪) চল্লিশ জন তাবেঈ সম্পর্কে অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা এশা ও ফজর একই ওযূতে পড়তেন।[8]
(৫) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ত্রিশ বছর কিংবা চল্লিশ বছর কিংবা পঞ্চাশ বছর এশা ও ফজর ছালাত একই ওযূতে পড়েছেন।[9] তাঁর সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ওযূর পানি ঝরার সময় তিনি বুঝতে পারতেন এর সাথে কোন্ পাপ ঝরে যাচ্ছে।[10]
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (কুষ্টিয়া)-এর অধীন ফাযিল স্নাতক প্রথম বর্ষের আল-আক্বাঈদ বইয়ে আবু হানীফা (রহঃ)-এর গুণাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনি একাধারে ৩০ বছর রোযা রেখেছেন এবং ৪০ বছর যাবত রাতে ঘুমাননি। ইবাদত বন্দিগীতে রজনী কাটায়ে গিয়েছেন। প্রতি রামাযানে ৬১ বার কুরআন মাজীদ খতম করতেন। অনেক সময় এক রাক‘য়াতেই কুরআন মাজীদ এক খতম দিতেন। তিনি ৫৫ বার হজ্জ করেছেন। জীবনের শেষ হজ্জের সময় কা‘বা শরীফে দু’রাক‘য়াত নামায এভাবে পড়েন যে, প্রথম রাক‘য়াতে এক পা ওঠায়ে প্রথম অর্ধাংশ কুরআন মাজীদ পাঠ করেন। তারপর দ্বিতীয় রাক‘য়াতে অপর পা ওঠায়ে বাকি অর্ধাংশ কুরআন মাজীদ পাঠ করেন। যে স্থানে তাঁর ইন্তিকাল হয়েছে, সেখানে এক হাজার বার কুরআন মাজীদ খতম করেছেন। তিনি ৯৯ বার আল্লাহ তা‘য়ালাকে স্বপ্নে দেখেছেন’।[11]
(৬) ইমাম শাফেঈ (রহঃ) রামাযান মাসে ছালাতের মধ্যে পবিত্র কুরআন ৬০ বার খতম করতেন।[12]
(৭) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) দৈনিক ৩০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন। ৮০ বছর বয়সে তিনি দৈনিক ১৫০ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন।[13]
(৮) সাঈদ ইবনু যুবাইর (রহঃ) এক রাক‘আতে পুরা কুরআন খতম করতেন।[14]
(৯) আবু আত্তার সুলামী (রহঃ) চল্লিশ বছর পর্যন্ত সারা রাত ক্রন্দন করে কাটাতেন এবং দিনে সর্বদা ছিয়াম পালন করতেন।[15]
(১০) বাকী ইবনু মুখাল্লাদ (রহঃ) দৈনিক তাহাজ্জুদ ও বিতর ছালাতের তের রাক‘আতে কুরআন খতম করতেন।[16]
(১১) মুহাম্মাদ ইবনু সালামা ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রহঃ)-এর ছাত্র ছিলেন । তিনি ১০৩ বছর বয়সে মারা যান। ঐ বয়সে তিনি প্রতিদিন ২০০ রাক‘আত করে ছালাত আদায় করতেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর তার একটানা তাকবীরে তাহরীমা ছুটেনি। মায়ের মৃত্যুর কারণে মাত্র একবার ছুটে গিয়েছিল। জামা‘আতে না পড়ার জন্য তিনি ঐ ছালাত ২৫ বার পড়েন।[17]
(১২) ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) সারা রাত্রি ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এমনকি খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার ফরয গোসলের প্রয়োজন হয়নি।[18]
(১৩) জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তির পায়ে ফোঁড়া হয়েছিল। ডাক্তারগণ পরামর্শ দিলেন, পা না কাটা হলে জীবনের হুমকি রয়েছে। তখন তার মা বললেন, যখন ছালাতে দাঁড়াবে, তখন কেটে নিতে হবে। অতঃপর তিনি যখন ছালাতে দাঁড়ালেন তখন তারা তার পা কেটে ফেললে তিনি মোটেও টের পেলেন না।[19]
উল্লেখ্য যে, আলী (রাঃ) সম্পর্কে এধরনের একটি কাহিনী প্রচার করা হয় যে, যুদ্ধে তার পায়ে তীর বিদ্ধ হয়েছিল। সেই তীর বের করা যাচ্ছিল না। অবশেষে তিনি ছালাতে দাঁড়ালে তার পা থেকে তীর বের করা হল, অথচ তিনি টের পেলেন না। এই কাহিনীও মিথ্যা।
পর্যালোচনা : সুধী পাঠক! উক্ত কাহিনীগুলো মুসলিম বিশ্বের বরেণ্য মনীষীদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হল, তারা কি আদৌ এভাবে তাদের ইবাদতী জীবন অতিবাহিত করেছেন? তাদের দ্বারা কি এ ধরনের বাড়াবাড়ি সম্ভব? যেমন- (ক) দীর্ঘ ৪০/৫০ বছর যাবৎ এশার ছালাতের ওযূ দ্বারা ফজরের ছালাত আদায় করা। বছরের পর বছর একটানা ছিয়াম পালন করা ইত্যাদি। মানবীয় কারণ উল্লেখ না করে যদি প্রশ্ন করা হয়- শরী‘আতে এভাবে সারা রাত ধরে ইবাদত করার অনুমোদন আছে কি? রাসূল (ছাঃ) ও তার ছাহাবীদের পক্ষ থেকে এরূপ কি কোন নযীর আছে? আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে রাত্রের কিছু অংশ বাদ দিয়ে ইবাদত করতে বলেছেন (মুয্যাম্মিল ২-৪)। রাসূল (ছাঃ) ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনু আছ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, صُمْ وَأَفْطِرْ وَقُمْ وَنَمْ فَإِنَّ لِجَسَدِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِعَيْنِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِزَوْجِكَ عَلَيْكَ حَقًّا ‘তুমি ছিয়াম পালন কর আবার ছিয়াম ছেড়ে দাও, তুমি রাত্রে ইবাদত কর আবার ঘুমাও। কারণ তোমার উপর তোমার শরীরের হক আছে, তোমার উপর তোমার দুই চোখের হক আছে, অনুরূপ তোমার উপর তোমার স্ত্রীর হক আছে’।[20] রাসূল (ছাঃ) অন্য হাদীছে বলেন, ‘যে ব্যক্তি সর্বদা ছিয়াম পালন করে তার ছিয়ামের কোন মূল্য নেই। একথা তিনি দুইবার কিংবা তিনবার বলেন’।[21]
(খ) প্রতিদিন ৩০০, ২৫০ কিংবা ২০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করা। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম এ ধরনের কোন ইবাদত করেছেন মর্মে প্রমাণ নেই। জানা আবশ্যক যে, রাসূল (ছাঃ)-এর তরীক্বা ব্যতীত যেকোন ইবাদত প্রত্যাখ্যাত।[22] বরং শরী‘আতের বিধিবদ্ধ নিয়মকে অবজ্ঞা করে যে বেশী বেশী ইবাদত করবে নিঃসন্দেহে সে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মত থেকে বহিষ্কৃত হবে। কারণ রাসূল (ছাঃ) ইবাদতের কথা জেনে তিন ব্যক্তি খুব কম মনে করেছিল এবং তারা বেশী বেশী ইবাদত করতে চেয়েছিল। এদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলে দিলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়’।[23]
(গ) ছালাতে কুরআন খতম করা। এক রাক‘আতে পুরো কুরআন খতম করা এবং রামাযান মাসে শুধু তারাবীহর ছালাতে ৬০ বার খতম করা। এ হিসাবে প্রত্যেক রাতে দুইবার করে খতম করতে হয়েছে। এটা সম্ভব কি-না তা যাচাই করবেন পাঠকবৃন্দ। তবে স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)ও এভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে রাতের ছালাত আদায় করেননি। তিনি একবার এক রাক‘আতে সর্বোচ্চ সূরা বাক্বারাহ, নিসা ও আলে ইমরান পড়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।[24] জনৈক ছাহাবী সাত দিনের কমে কুরআন খতম করতে চাইলে রাসূল (ছাঃ) তাকে অনুমতি দেননি।[25] তিনি তিন দিনের কমে কুরআন খতম করতে নিষেধ করেছেন।[26] তাছাড়া আয়েশা (রাঃ) বলেন,
وَلاَ أَعْلَمُ نَبِىَّ اللهِ قَرَأَ الْقُرْآنَ كُلَّهُ فِى لَيْلَةٍ وَلاَ صَلَّى لَيْلَةً إِلَى الصُّبْحِ وَلاَ صَامَ شَهْرًا كَامِلاً غَيْرَ رَمَضَانَ.
রাসূল (ছাঃ) কোন এক রাত্রিতে পুরো কুরআন খতম করেছেন, কোন রাত্রে পুরো রাত ছালাত আদায় করেছেন এবং রামাযান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে সম্পূর্ণ মাস ছিয়াম পালন করেছেন মর্মে আমি জানি না’।[27] এই নিয়মতান্ত্রিক নির্ধারিত ইবাদত করার মাধ্যমেই তিনি হয়েছেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তাক্বওয়াশীল।[28]
প্রশ্ন হল- যে সমস্ত মহা মনীষী সম্পর্কে উক্ত অলীক কাহিনী রচনা করা হয়েছে, তারা কি শরী‘আতের এই বিধানগুলো জানতেন না? তারা কি রাসূল (ছাঃ) ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবীদের চেয়ে বেশী পরহেযগার হতে চেয়েছিলেন? (নাঊযুবিল্লাহ)। বিশেষ করে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে যে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে তা আসলেই দুঃখজনক। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বইয়ে কিভাবে তা সম্পৃক্ত হতে পারে? বলা যায় তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল এ সমস্ত অলীক কাহিনী আবিষ্কার করেছে।
(১৪) ছাবেত আল-বুনানী (রহঃ) আল্লাহর সামনে অধিক ক্রন্দন করতেন আর বলতেন, হে আল্লাহ কবরে যদি কাউকে ছালাত আদায় করার অনুমতি দান করে থাকেন, তাহলে আমাকে অনুমতি দিন। আবু সিনান বলেন, আল্লাহর কসম! ছাবেতকে যারা দাফন করেছেন তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। দাফনের সময় কবরের একটি ইট পড়ে গেল। আমি দেখতে পেলাম তিনি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছেন। তার কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, আব্বা ৫০ বছর যাবৎ রাত্রি জাগরণ করেছেন এবং উক্ত দু‘আ করেছেন।[29]
(১৫) একজন স্ত্রীলোককে দাফন করা হল । তার ভাই দাফনের কাজে শরীক ছিল। এ সময় তার টাকার থলি কবরের মাঝে পড়ে যায়। পরে বুঝতে পেরে চুপে চুপে কবর খুলে বের করার চেষ্টা করে। যখন সে কবর খুলল তখন কবরটি আগুনে পরিপূর্ণ ছিল। সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের নিকট আসল এবং ঘটনা বর্ণনা করল। তখন তার মা উত্তরে বলল, সে ছালাতে অলসতা করত এবং ছালাত ক্বাযা করত।[30]
পর্যালোচনা : কবর জীবন মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী জীবন। এই জীবন মানুষের বাস্তব জীবনের বিপরীত। দুনিয়ার কোন মানুষ বারযাখী জীবন সম্পর্কে খবর রাখে না। কবরের শান্তি বা শাস্তি কোনকিছু কেউ টের পায় না। সেখানকার অবস্থা দেখা তো দূরের কথা, মানুষ ও জিনের পক্ষে কানে শুনাও সম্ভব নয়।[31]
(১৬) শায়খ আব্দুল ওয়াহিদ (রহঃ) ছিলেন বিখ্যাত বুযুর্গের একজন। তিনি বলেন, আমার একবার খুব ঘুমের চাপ হল। ফলে রাত্রের নিয়মিত তাসবীহগুলো পড়তে ছুটে গেল। তখন স্বপ্নে আমি সবুজ রেশমী পোশাক পরিহিতা এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতীকে দেখলাম। তার পায়ের জুতাগুলো পর্যন্ত তাসবীহ পাঠ করছে। সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, তুমি আমাকে পাওয়ার চেষ্টা কর, আমি তোমাকে পাওয়ার চেষ্টা করছি। অতঃপর সে কয়েকটি প্রেমমূলক কবিতা পাঠ করল। এই স্বপ্ন দেখে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, রাত্রে আর কখনো ঘুমাব না। অতঃপর তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এশার ওযূ দিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করেন।[32]
(১৭) জনৈক বুযুর্গ বলেন, এক রাত্রিতে গভীর ঘুমের কারণে আমি জেগে থাকতে পারলাম না। ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে দেখলাম। এমন মেয়ে আমি কখনো জীবনে দেখিনি। তার দেহ থেকে তীব্র সুগন্ধি ছড়াচ্ছে। এমন সুগন্ধি আমি কখনো অনুভব করিনি। সে আমাকে একটি কাগজের টুকরা দিল। তাতে কবিতার তিনটি চরণ লেখা ছিল। যেমন- তুমি নিদ্রার স্বাদে বিভোর হয়ে জান্নাতের বালাখানা সমূহ ভুলে গেছ, যেখানে তোমাকে চির জীবন থাকতে হবে, যেখানে কখনো মৃত্যু আসবে না। তুমি ঘুম হতে উঠ, কুরআন তেলাওয়াত কর, তাহাজ্জুদ ছালাতে কুরআন তেলাওয়াত করা ঘুম হতে অনেক উত্তম। তিনি বলেন, এই ঘটনার পর হতে আমার কখনো ঘুম আসে না। কবিতাগুলো স্মরণ হয় আর ঘুম দূরিভূত হয়ে যায়।[33]
পর্যালোচনা : কী চমৎকার রোমাঞ্চকর উপন্যাস! সুন্দরী মেয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার কী সুন্দর অভিনব কৌশল! আল্লাহর ভয় ও ইসলামী বিধানের আনুগত্যের কোনই প্রয়োজন নেই। শুধু সুন্দরী নর্তকীকে পাওয়ার জন্য সে ইবাদত করবে। এটা কি কোন ইসলামী সভ্যতা?
সুধী পাঠক! ফাযায়েলে আমলে এ ধরনের অসংখ্য মিথ্যা কাহিনী রয়েছে। এই মিথ্যা ফযীলতের ধোঁকা দিয়ে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে প্রতারণার জালে আবদ্ধ করা হচ্ছে। যে সমস্ত ভাইয়েরা ফাযায়েলে আমল পড়েন ও আমল করেন তারা কি একটিবার চিন্তা করবেন? আমরা সরলপ্রাণ মুমিন ভাইদেরকে উক্ত মরণ ফাঁদ থেকে বের হয়ে প্রমাণসহ ছহীহ দলীলের অনুসরণ করার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহ রাববুল আলামীন মুসলিম উম্মাহকে উক্ত মিথ্যা ও কাল্পনিক ধর্ম থেকে রক্ষা করুন-আমীন!!
[2]. আরশীফ মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, ৪১/১১৬।
[3]. ফাযায়েলে আমল, (উর্দূ) পৃঃ ৩৪; বাংলা, পৃঃ ১০৬।
[4]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১২৫; (উর্দূ), ফাযায়েলে নামায অংশ, পৃঃ ৪৫।
[5]. ছহীহ বুখারী হা/৪৭৭, (ইফাবা হা/৪৬৩, ১/২৫৯ পৃঃ), ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘বাজারের মসজিদে ছালাত’ অনুচ্ছে এবং হা/৬৪৫, ‘আযান, অধ্যায়, ‘জামা‘আতে ছালাতের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১০৫২, পৃঃ ৯৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৮৫, ৩/৪৪ পৃঃ।
[6]. আবুদাঊদ হা/৫৬০, ১/৮৩ পৃঃ।
[7]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬০; (উর্দূ), পৃঃ ৬৮।
[8]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬০, (উর্দূ), পৃঃ ৬৮।
[9]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬০, (ঊর্দূ), পৃঃ ৬৮।
[10]. ফাযায়েলে আমল (বাংলা), পৃঃ ৭৮।
[11]. রচনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহাম্মদ আবু ইউসুফ খান, আল-আকাইদ আল-ইসলামিয়্যাহ (ঢাকা : আল-বারাকা লাইব্রেরী, ৩৪, নর্থব্রূক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০), পৃঃ ৪৫।
[12]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬১, (উর্দূ), পৃঃ ৬৮।
[13]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬১, ১৫৮, (উর্দূ), পৃঃ ৬৬ ও ৬৮।
[14]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৮, (উর্দূ), পৃঃ ৬৬।
[15]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬১, (উর্দূ), পৃঃ ৬৮।
[16]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬০, (উর্দূ), পৃঃ ৬৭।
[17]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১২৫-১২৬, (উর্দূ), পৃঃ ৪৬।
[18]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৭, (উর্দূ), পৃঃ ৬৫-৬৬।
[19]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৬, (উর্দূ), পৃঃ ৬৫।
[20]. ছহীহ বুখারী হা/৫১৯৯, ২/৭৮৩ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪৮২৪, ৮/৪৭৪ পৃঃ), ‘বিবাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৮৮; মিশকাত হা/২০৫৪, পৃঃ ১৭৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৯৫৬, ৪/২৫৩ পৃঃ, ‘ছিয়াম’ অধ্যায়, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ।
[21]. ছহীহ বুখারী হা/১৯৭৭, ১/২৬৫ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৮৫৩, ৩/২৭৭ পৃঃ), ‘ছিয়াম’ অধ্যায়, ‘ছিয়ামের ক্ষেত্রে পরিবারের হক’ অনুচ্ছেদ-৫৬- فَقَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ صَامَ مَنْ صَامَ الأَبَدَ لاَ صَامَ مَنْ صَامَ الأَبَدَ لاَ صَامَ مَنْ صَامَ الأَبَدَ.।
[22]. ছহীহ মুসলিম হা/৪৫৯০, ২/৭৭, (ইফাবা হা/৪৩৪৪), ‘বিচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮।
[23]. ছহীহ বুখারী হা/৫০৬৩, ২/৭৫৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪৬৯৭, ৮/৩৮১ পৃঃ), ‘বিবাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; ছহীহ মুসলিম হা/৩৪৬৯, ‘বিবাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১ এবং হা/২৫০০; মিশকাত হা/১৪৫, পৃঃ ২৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৭, ১/১০৯ পৃঃ - أَمَا وَاللهِ إِنِّيْ لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّيْ أَصُوْمُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّيْ وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّي।
[24]. ছহীহ মুসলিম হা/১৮৫০, ১/২৬৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬৮৪), ‘মুসাফিরদের ছালাত’ অধ্যায়, ‘রাত্রির ছালাতে ক্বিরাআত লম্বা করা মুস্তাহাব’ অনুচ্ছেদ-২৭।
[25]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৪৬, পৃঃ ৯৫ ও ৯৬, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘কয় দিনে কুরআন খতম করা ভাল’ অনুচ্ছেদ-১৭৮।
[26]. তিরমিযী হা/২৯৪৯, ২/১২৩ পৃঃ, ‘ক্বিরাআত’ অধ্যায়ের শেষ হাদীছ; ইবনু মাজাহ হা/১৩৪৭; মিশকাত হা/২২০১, পৃঃ ১৯১, ‘ফাযায়েলুল কুরআন’ অধ্যায়, ‘কুরআন পাঠের আদব’ অনুচ্ছেদ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২০৯৭, ৫/৩৬ পৃঃ।
[27]. ছহীহ মুসলিম হা/১৭৭৩, ১/২৫৬ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬০৯), ‘মুসাফিরদের ছালাত’ অধ্যায়, ‘রাত্রির ছালাত ও যে ছালাত না পড়ে ঘুমে যায়’ অনুচ্ছেদ-১৮; মিশকাত হা/১৫২৭, পৃঃ ১১১, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১১৮, ৩/১৩১ পৃঃ।
[28]. ছহীহ বুখারী হা/৫০৬৩, ২/৭৫৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪৬৯৭, ৮/৩৮১ পৃঃ), ‘বিবাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত হা/১৪৫, পৃঃ ২৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৭, ১/১০৯ পৃঃ।
[29]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৯, (উর্দূ), পৃঃ ৬৭।
[30]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১১৮।
[31]. ছহীহ বুখারী হা/১৩৩৮, (ইফাবা হা/১২৫৭, ২/৪০২ পৃঃ), ‘জানাযা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬ ও ১৩৭৪; মিশকাত হা/১২৬ ও ১৩১।
[32]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫২, (উর্দূ), পৃঃ ৬২।
[33]. ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৩, (উর্দূ), পৃঃ ৬৩।