ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী بيان أصول العقيدة الإسلامية إجمالا وأدلتها - দলীলসহ ইসলামী আকীদার মূলনীতিগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
المبحث الأول: توحيد الربوبية - প্রথম অনুচ্ছেদ: তাওহীদুর রুবুবীয়্যা

তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ হল দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা একই সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা। সব কিছুর ব্যবস্থাপক, পরিচালক, জীবন দাতা, মৃত্যু দাতা। তিনিই রিযিক দানকারী এবং প্রবল শক্তিধর। এ প্রকার তাওহীদকে মেনে নেয়ার প্রবণতা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের মধ্যেই স্থাপন করে দেয়া হয়েছে। মানব জাতির কেউ এ বিষয়ে তেমন কোনো মতভেদ করেনি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ﴾

‘‘তুমি যদি এদের জিজ্ঞাসা করো, কে এদেরকে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে? (সূরা যুখরুফ: ৮৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ﴾

‘‘তুমি যদি এসব লোকদের জিজ্ঞাসা করো, আসমান-যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা এগুলো সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা যুখরুফ: ৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُلْ مَن رَّبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ سَيَقُولُونَ الله﴾

‘‘তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহ’’। (সূরা মুমিনুন: ৮৬-৮৭)

এ রকম আয়াত কুরআনে অনেক রয়েছে। কাফেরদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াত স্বীকার করতো। তারা বিশ্বাস করতো আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, রিযিক দাতা, জীবন দাতা এবং মৃত্যু দাতা। মানব জাতির সামান্য লোকই কেবল তাওহীদুর রুবুবীয়াত এবং প্রভুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।

কেউ কেউ প্রকাশ্যে প্রভু ও স্রষ্টাকে অস্বীকার করলেও গোপনে এবং হৃদয়ের গভীর থেকে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে। অহংকার করার কারণেই কেবল তারা প্রকাশ্যে প্রভুকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ফেরাআউন সম্পর্কে বলেন যে, সে বলেছিল,

﴿يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي ﴾


‘‘হে সভাসদবর্গ! আমি তো নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোনে প্রভু আছে বলে জানি না’’। (সূরা কাসাস: ৩৮)

আল্লাহর নবী মূসা আলাইহিস সালামের কথা থেকে বুঝা যায় ফেরাউন আল্লাহর উপর ঈমান রাখতো। আল্লাহ তা‘আলা মূসার উক্তি উল্লেখ করে বলেন,

﴿قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ﴾

‘‘তুমি খুব ভাল করেই জান এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেননি’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১০২)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

﴿وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا﴾

‘‘তারা একেবারেই অন্যায়ভাবে অহংকারের সাথে নিদর্শনগুলো অস্বীকার করলো অথচ তাদের মনমগজ সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে’’। (সূরা নামাল: ১৪)

তারা সত্য অস্বীকারের ক্ষেত্রে কোনো দলীল-প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি। কেবল অহংকার করেই তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ وَمَا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ﴾

‘‘এরা বলে, জীবন বলতে তো শুধু আমাদের দুনিয়ার এ জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করে না। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এদের কোনো জ্ঞান নেই। এরা শুধু ধারণার উপর নির্ভর করে এসব কথা বলে’’। (সূরা জাছিয়া: ২৪)

সুতরাং তাদের কাছে এমন কেনো জ্ঞান ছিল না, যা তাদেরকে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করার পথ দেখিয়েছে: বরং আসমানী শরী‘আত, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এবং সৃষ্টিগত স্বভাব সবই স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার ও সাব্যস্ত করেছে।

এ সৃষ্টিজগত এবং তাতে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে তা সবই আল্লাহ তা‘আলার একত্ব এবং তার প্রভুত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ। কেননা সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা থাকা আবশ্যক। সৃষ্টিজগতে যা কিছু প্রবর্তিত হচ্ছে, তার জন্য প্রবর্তক থাকা আবশ্যক।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ * أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ﴾

‘‘তারা কি কোনো কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না’’। (সূরা তুর: ৩৫-৩৬)

কবি বলেছেন, وَفِي كُلِّ شَيْءٍ لَهُ آيَةٌ... تَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ وَاحِد  প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে তার নিদর্শন রয়েছে, যা প্রমাণ করে তিনি একক। তারা কি কোনো কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? এ প্রশ্নটির জবাব দেয়া আবশ্যক। তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নাস্তিকরা এলোমেলো জবাব দিয়েছে। তারা কখনো বলেছে, প্রকৃতির নিয়মেই এ সৃষ্টিজগত সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে উদ্ভিদ, জীব ও জড় বস্ত্তকে প্রকৃতি বলা হয়। এ বিশাল সৃষ্টিজগতের সবকিছু তাদের নিকট প্রকৃতি। এ নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে!!

তারা কখনো বলেছে, উদ্ভিদ, জীব ও জড় বস্ত্তর বিভিন্ন স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের নামই প্রকৃতি। যেমন গরম হওয়া, ঠান্ডা হওয়া, আদ্র হওয়া, শুস্ক হওয়া, মসৃণ হওয়া, মোটা হওয়া, নড়াচড়া করা, স্থির হওয়া, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া, প্রজনন, বংশ বিস্তার করা ইত্যাদি সব কিছু প্রাকৃতিক নিয়মে হয়। তাদের মতে বস্ত্তসমূহের স্বভাব এবং বিভিন্ন অবস্থায় সেটা রূপান্তরিত হওয়ার যে যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখে তাকেই প্রকৃতি বলা হয়। তাদের মতে এ স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যগুলোই সৃষ্টিজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছে।

উভয় দিক থেকেই তাদের কথা বাতিল। যদি বলা হয় উদ্ভিদ, জীব ও জড় পদার্থগুলোর নামই প্রকৃতি এবং প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে, তাহলে তাদের কথা অনুযায়ী প্রকৃতি একই সাথে স্রষ্টা ও সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক হয়। এতে আবশ্যক হয় যে, পৃথিবী নিজেই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে, আকাশও নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে কথা একই...। এটি অসম্ভব।

এভাবে প্রকৃতির নিয়মে এক বস্ত্তর সত্তা থেকে সমজাতীয় আরেক বস্ত্তর সত্তা সৃষ্টি হওয়া যদি অসম্ভব হয়, তাহলে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সৃষ্টি হওয়া আরো বেশী কঠিন। অর্থাৎ কেননা কোনো বস্ত্ত নিজেই যদি নিজেকে সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বস্ত্তর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য বস্ত্তকে সৃষ্টি করা আরো বেশী অসম্ভব। কেননা موصوف বা বিশেষিত সত্তার সাথে যুক্ত না হয়ে صفة বা স্বভাব ও বিশেষণ অস্তিত্বশীল হয় না। সুতরাং ছিফাত কিভাবে মাউসুফকে সৃষ্টি করতে পারে!! অথচ ছিফাত নিজেই মাউসুফের প্রতি মুখাপেক্ষী। সুতরাং যখন দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হলো যে মাউসুফ সৃষ্টি হয়েছে, তখন এ বিশ্বাস করা আবশ্যক যে ছিফাতও সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি কথা বুঝা দরকার যে, প্রকৃতির কোনো অনুভুতি নেই। এটি একটি যন্ত্রের মত। সুতরাং তা থেকে কিভাবে এত বিশাল বিশাল ও সুনিপুন-অভিনব কাজ-কর্ম তৈরী হতে পারে, যা সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং যা পরস্পর মিলে একটি সুশৃঙ্খল বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে।

নাস্তিকদের কেউ কেউ বলে থাকে, এ সৃষ্টিজগত আকস্মিকভাবে তৈরী হয়। অর্থাৎ আকস্মিকভাবে অনেকগুলো অণু-পরমাণু ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্ত্ত একসাথে মিলিত হয়ে প্রাণ তৈরী হয়। এতে কোনো স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপকের ব্যবস্থাপনা ও কলা-কৌশলের প্রয়োজন হয় না। এটি একটি বাতিল কথা। বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত স্বভাব এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। কেননা আপনি যখন এ সুশৃঙ্খল সৃষ্টিজগতের মহাশূন্য, ভূপৃষ্ঠ এবং মহাকাশে সুক্ষ্ম, বিস্ময়কর ও সুবিন্যস্তভাবে চলাচলকারী সৃষ্টিসমূহের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিবেন, তখন আপনার কাছে সুস্পষ্ট হয় যাবে যে, প্রজ্ঞাবান এক স্রষ্টা ব্যতীত এসব তৈরী হওয়া মোটেই সম্ভব নয়।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, তুমি স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী নাস্তিককে জিজ্ঞাসা করো, ঐ মেশিনের ব্যাপারে তোমার ধারণা কী, যা একটি নদীতে রাখা হয়েছে। তার যন্ত্রাংশগুলো মজবুত, সেগুলো মজবুতভাবে লাগানো হয়েছে এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেগুলো তৈরী করা হয়েছে। দর্শক মেশিনের ভিতরে যেমন কোনো দোষ ধরতে পারে না তেমনি তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কোনো ত্রুটি খুঁজে পায় না। আর এ মেশিনটি দিয়ে বিরাট একটি বাগানে পানি দেয়া হচ্ছে। বাগানে রয়েছে প্রত্যেক প্রকার ফলফলাদির গাছপালা। মেশিনটি বাগানের গাছপালা ও ফল-ফসলের চাহিদা মোতাবেক পানি সরবরাহ করছে। ঐদিকে বাগানকে ঠিক-ঠাক রাখার জন্য তাতে একজন পরিচর্যাকারী রয়েছে। সে ভালোভাবে বাগানের যত্ন নেয়, খোঁজ-খবর রাখে এবং বাগানের সার্বিক কাজ-কর্ম সম্পন্ন করে। বাগানের কোনো কিছুই ত্রুটিযুক্ত রাখে না। অতঃপর লোকটি বাগানের ফল-ফসল উঠিয়ে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে তাদের মধ্যে ভাগ-বন্টন করে দেয়। প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষকেই প্রয়োজন মোতাবেক দান করে। সর্বদা সে এ রকমই করতে থাকে। তুমি কি মনে করো কোনো কারিগর ও ব্যবস্থাপক ছাড়াই বাগান এবং তার সবকিছু আকস্মিকভাবে হয়ে গেছে?

বাগানে পানি দেয়ার মেশিনটি এমনিতেই হয়ে গেছে? বাগান ও তার ভিতরকার পরিবেশ হঠাৎ করেই তৈরী হয়েছে?

কোনো কর্তা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক ছাড়াই এসব কিছু আকস্মিকভাবেই হয়ে গেছে?

তোমার যদি বিবেক-বুদ্ধি থাকে, তাহলে এসবের ব্যাপারে তোমার বিবেক কী বলে তা খেয়াল করো। তোমার বিবেক কী জবাব দেয় তা ভালোভাবে বুঝো এবং কী দিক নির্দেশনা দেয় তা অনুধাবন করো। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি এ যে, তিনি এমন কিছু অন্তর সৃষ্টি করেছেন, যা সম্পূর্ণ অন্ধ, তাতে কোনো আলো নেই। যার কারণে সে উজ্জ্বল ঝকঝকে নিদর্শনগুলো কেবল ঐসব চতুষ্পদ জন্তুর মতোই দেখতে পায় যাদের চক্ষু আছে ঠিকই; কিন্তু তাতে কোনো আলো নেই। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের উক্তি এখানেই শেষ।