ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
সালাফী ও সালাফিয়াত পরিচিতি ভূমিকা আবদুল হামীদ ফাইযী
ভূমিকা

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على أشرف المرسلين، نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين. أما بعد

জীবনে চলার পথে একটি জীবন-পদ্ধতি চাই। আর সেটা হওয়া চাই বিশুদ্ধ ইসলাম। আর সেটা হল সালাফিয়াত বা সালাফী জীবন-পদ্ধতি। এ পথ ও পদ্ধতিই হল সঠিক ও শুদ্ধ। এটাই হল মহান আল্লাহর সরল পথ। এটাই মহানবী ও তাঁর সাহাবাবর্গ (রাঃ)-এর পথ। এ পথের পথিকরাই হল ইহকালে সাহায্যপ্রাপ্ত এবং পরকালে মুক্তিপ্রাপ্ত। এটাই হল ৭৩ দলের মধ্যে একমাত্র পরিত্রাণ লাভকারী দল। এটাই হল। ইসলামের মূল স্রোতধারা। এই দলটির পরিচয় হয়তো সকলের জানা নাও থাকতে পারে। অথবা জানার মধ্যে কোন গোলমাল থাকতে পারে, তাই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

পাঠকের খিদমতে বক্ষমাণ পুস্তিকাটির মূল আরবী হল মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের প্রণয়ন। অনুবাদ আমার এবং এর শেষে সংযোজিত পরিশিষ্ট আমার। আশা করি পাঠক উপকৃত হবেন। এবং সালাফিয়াত সম্বন্ধে তার অনেক সন্দেহ ও বিরোধী মনোভাবের অবসান ঘটবে। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সত্যিকারার্থে ‘সালাফী’ হওয়ার তওফীক দিন। আমীন।

বিনীত-

আব্দুল হামীদ আল-ফাইযী আল-মাদানী

২১/২/৪১, ২০/১০/১৯


إن الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره ونعود بالله من شرور أنفسنا وسيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادی له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمد عبده ورسوله

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا * يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا

أما بعد : فإن أصدق الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمي، وشر الأمور محدثاتها، وكل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة، وكل ضلالة في النار

অতঃপর মহান আল্লাহর প্রশংসার সাথে শুরু করি এবং তার সকল কল্যাণের উপর তার স্তুতি বর্ণনা করি। যেহেতু এমন কোন কল্যাণ নেই, যা তার সাহায্য ছাড়া লাভ করা যায়। আর আমার এবং আপনাদের প্রতি তার পরিপূর্ণ অনগ্রহ ও নিয়ামতের অন্যতম বিষয়। এই যে, তিনি আমাদের জন্য এই বৰ্কতময় শহর মক্কা মুকার্‌রামায় এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যেখানে আল্লাহর গৃহসমূহের একটি গৃহে সমবেত হয়ে আমরা আল্লাহর যিকর করার সুযোগ লাভ করেছি। অতএব আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের সকলকে তাদের দলভুক্ত করেন, যারা কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করে এবং তার মধ্যে সর্বোত্তম কথার অনুসরণ করে। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা দুআ কবুলকারী।[১]

ব্রাদারানে ইসলাম!

মুহাম্মাদ (সা.) রসূল হয়ে প্রেরিত হওয়ার পূর্বে মানুষ অজ্ঞতা ও অন্ধতায় ছিল। ছিল শির্ক, যুলম ও ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত। অতঃপর আল্লাহ সৃষ্টির সর্দার মুহাম্মাদ (সঃ)-কে রসূলগণের আগমন বন্ধ থাকার পর বাঁকা মিল্লতকে সোজা করার লক্ষ্যে প্রেরণ করলেন।

যাতে তারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' (আল্লাহ ছাড়া সত্য উপাস্য নেই) বলে এবং সফলতা লাভ করে। সুতরাং তার সাথে হক আগমন করল এবং বাতিল বিলীন হল। তার সাথে হিদায়াত আগমন করল, আগমন করল জীবন, আগমন করল ন্যায়পরায়ণতা। আল্লাহ তার মাধ্যমে শির্ককে নিশ্চিহ্ন করলেন। আল্লাহ (জাল্লা ফী উলাহ) তাকে সারা বিশ্ববাসীর জন্য করুণা স্বরূপ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করলেন। প্রেরণ করলেন তার প্রতি বিশ্বাসীর জন্য সুসংবাদদাতারূপে এবং যে। তার অবাধ্য হয় ও তার আদর্শে বাধা সৃষ্টি করে তার জন্য সতর্ককারীরূপে। তিনি তার মাধ্যমে হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করলেন। আল্লাহ (জাল্লা ফী উলাহ) বলেছেন,

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ ۚ قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ * يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ وَيُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

“হে ঐশীগ্রন্থধারিগণ! আমার রসূল তোমাদের নিকট এসেছে, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে, সে তার অনেক অংশ তোমাদের নিকট প্রকাশ করে এবং অনেক কিছু (প্রকাশ না করে) উপেক্ষা করে থাকে। অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর নিকট হতে জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এ (জ্যোতির্ময় কুরআন) দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে (কুফরীর) অন্ধকার হতে বার করে (ঈমানের) আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন।” (মায়িদাহঃ ১৫-১৬)।

মুফাসসিরগণের ইমাম, ইমাম হাফেয আবু জাফর বিন জারীর ত্বাবারী তার তফসীরে (৬/ ১৬১) উক্ত আয়াতের আলোচনায় বলেছেন, 'নূর মানে মুহাম্মাদ (সা.), যার মাধ্যমে আল্লাহ হক আলোকিত করেছেন, ইসলামকে বিজয়ী করেছেন, শির্ককে নিশ্চিহ্ন করেছেন। সুতরাং তিনি তার জন্য নূর (আলো), যে তার মাধ্যমে আলোকিত হতে চায়, যার দ্বারা হক স্পষ্ট করতে চায়।

ইমাম বুখারী ‘সহীহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, আত্বা’ বিন ইয়াসার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রাঃ)-এর সাক্ষাতে বললাম, 'তাওরাতে উল্লিখিত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গুণাবলী সম্পর্কে আমাকে বলুন। তিনি বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহর কসম! তিনি কুরআনে বর্ণিত কিছু গুণে তাওরাতেও গুণান্বিত। (যেমন,) “হে নবী! আমি তো তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে” (আহযাবঃ ৪৫) এবং নিরক্ষর (আরব)দের জন্য নিরাপত্তারূপে। তুমি আমার দাস ও রসূল। আমি তোমার নাম রেখেছি ‘আল-মুতাওয়াক্কিল’ (আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল)। তিনি রূঢ় ও কঠোর নন। হাটে-বাজারে হৈ-হুল্লোড়কারীও নন। তিনি মন্দকে মন্দ দ্বারা প্রতিহত করেন না। বরং তিনি ক্ষমা ও মার্জনা করে দেন। আল্লাহ তাঁর কখনোই তিরোধান ঘটাবেন না, যতক্ষণ না তিনি তার দ্বারা বাকা (কাফের) মিল্লাতকে সোজা করেছেন তথা তারা “লা ইলাহা। ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার দ্বারা বহু অন্ধ চক্ষু, বধির কর্ণ ও বদ্ধ হৃদয়কে উন্মুক্ত করেছেন। (বুখারী ২১২৫, ৪৮৩৮নং)

ইমাম তিরমিযী জামে’ ও ‘শামায়েল’ গ্রন্থে এবং ইমাম ইবনে মাজাহ সুনান গ্রন্থে সহীহ সুত্রে বর্ণনা করেছেন, আনাস (রাঃ) বলেছেন, যখন সেই দিন এল, যে দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় প্রবেশ করলেন, তখন তার সব কিছু আলোকিত হয়ে উঠল। অতঃপর যখন সেই দিন এসে উপস্থিত হল, যে দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন, তখন তার সব কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর (দাফনকার্য সেরে) আমাদের (ধুলাময়) হাত না ঝাড়তেই আমরা আমাদের হৃদয়কে ভিন্নরূপে পেলাম![২] এই অভিব্যক্তি, রসূলগণের সর্দার-কে হারিয়ে ফেলার অন্তর্জালা এবং তাঁদের সেই কঠিন সন্ধিক্ষণ সম্বন্ধে অভিব্যক্তি ও মনের ভাব প্রকাশ এমনই ছিল যে, তার চির বিদায় এবং অহী বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুঃখে নিজেদেরকে ভিন্ন মানুষ ভাবতে লাগলেন।[৩]

ইমাম বুখারী ‘সহীহ’ (৩৫৮ ৪নং)এ জাবের (রাঃ) কর্তৃক বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) জুমআর দিন একটি বৃক্ষের উপর অথবা খেজুর বৃক্ষের একটি কান্ডের উপর খুতবা দেওয়ার জন্য দাঁড়াতেন। এমতাবস্থায় একজন আনসারী মহিলা অথবা পুরুষ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনার জন্য কি একটি মিম্বর বানিয়ে দেব?’ নবী (সা.) বললেন, “তোমাদের ইচ্ছে হলে দিতে পারো।” অতঃপর তারা একটি কাঠের মিম্বর বানিয়ে দিলেন। যখন জুমআর দিন এল, নবী (সা.) মিম্বরে বসলেন, তখন কান্ডটি শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। নবী (সা.) মিম্বর থেকে নেমে এসে ওটাকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু কান্ডটি শিশুর মতো আরো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল।

বর্ণনাকারী বলেন, 'কান্ডটি এ জন্য কাঁদছিল, যেহেতু সে খুতবাকালে নিজে কাছে থেকে যিকর শুনতে পেত।

ইমাম হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন উক্ত হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন কেঁদে ফেলতেন এবং বলতেন, 'ওহে মুসলিমগণ! রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাতের আগ্রহে কাঠ গুনগুনিয়ে কেঁদে ওঠে! সুতরাং তোমরা এ কথার বেশি হকদার যে, তোমরা তাঁর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবে।”[৪]

এই ভূমিকার পর এবার মূল বক্তব্যের দিকে যাই, যার শিরোনাম আপনারা শুনেছেন, সালাফিয়াত কী?

এই স্থানে যখন বিষয়টির সকল দিক নিয়ে আলোচনা করার জন্য সময় পর্যাপ্ত নয়, তখন এর কয়েকটি পয়েন্ট নির্বাচন করে আলোচনা শুরু করছি।

প্রথম পয়েন্টঃ “সালাফ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ

দ্বিতীয় পয়েন্টঃ পরিভাষায় ‘সালাফ’ কারা?

তৃতীয় পয়েন্টঃ সালাফে সালেহ’ এর কতিপয় প্রতিনাম।

চতুর্থ পয়েন্টঃ সালাফিয়াতের অনুসরণ করা ও তার সাথে সম্বন্ধ জোড়ার বিধান।

পঞ্চম পয়েন্টঃ সালাফ ও সালাফিয়াতের অনুসরণ করার মাহাত্ম্য

যষ্ঠ পয়েন্টঃ সালাফী মানহাজের (মতাদর্শের) চিহ্ন ও পথনির্দেশিকা

সপ্তম পয়েন্টঃ উপক্রমণিকা, আর তাতে থাকবে আলোচ্য বিষয়ের উপর আলোকপাত।

[১]. এই লেকচারটি মক্কা মুকারামা (শারাফাহাল্লাহ) এর আযীযিয়াহ সেকশনের জামে’ ফকীহ মসজিদে রোজ বৃহস্পতিবার ১০ম শাবান ১৪৩১ হিজরীতে পেশ করা হয়। যা সেখানকার ‘আস-সাবীল’ মসজিদে অনুষ্ঠিত সংস্কারক ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) অধিবেশনের সক্রিয়তার একটি অংশ হিসাবে কার্যক্রমভুক্ত করা হয়।

[২]. তিরমিযী ৩৬ ১৮, শামায়েল ৩৭৫, ইবনে মাজাহ ১৬৩ ১, আহমাদ ১৩৩ ১২, ইবনে হিব্বান, ইহসান ৬৬৩৪নং, হামে ৩/৫৭, আল্লামা আলবানী সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ (১৩২২নং)এ এবং তার আরো অন্য গ্রন্থসমূহে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[৩]. আল্লামা আলবানীর টীকা দ্রঃ সংক্ষিপ্ত শামায়েল মুহাম্মাদিয়াহ ১৯৭পৃঃ

[৪]. সিয়ারু আ'লামিন নুবালা’ ৪/৫৭০, সংক্ষিপ্ত তারীখে দিমাশ্‌ক ১/ ১৮৪