গায়েব বলতে মানব জাতির বাহ্য বা অবাহ্যেন্দ্রিয়ের আড়ালের কোন বস্ত্তকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ যা কোন ধরনের মানবেন্দ্রিয় বা মানব তৈরী প্রযুক্তি কর্তৃক উপলব্ধ বা জ্ঞাত হওয়া সম্ভবপর নয় তাই গায়েব।
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই গায়েব জানেন। তিনি ভিন্ন অন্য কেউ এতটুকুও গায়েব জানে না।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«قُلْ لاَ يَعْلَمُ مَنْ فِيْ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلاَّ اللهُ، وَمَا يَشْعُرُوْنَ أَيَّانَ يُبْعَثُوْنَ»
‘‘(হে নবী) আপনি বলে দিন: আকাশ ও পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কেউ গায়েব জানে না এবং তারা এও জানে না যে তারা কখন পুনরুত্থিত হবে’’। (নামল : ৬৫)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
«وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ، وَيَعْلَمُ مَا فِيْ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ، وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَّرَقَةٍ إِلاَّ يَعْلَمُهَا، وَلاَ حَبَّةٍ فِيْ ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ، وَلاَ رَطْبٍ وَلاَ يَابِسٍ إِلاَّ فِيْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ»
‘‘গায়েবের চাবিকাঠি একমাত্র তাঁরই হাতে। তিনি ছাড়া অন্য কেউ গায়েব জানে না। জল ও স্থলের সব কিছুই তিনি জানেন। কোথাও কোন বৃক্ষ থেকে একটি পাতা ঝরলেও তিনি তা জানেন। এমনকি ভূগর্ভের দানা বা বীজ এবং সকল শুষ্ক ও তরতাজা বস্ত্তও তাঁর অবগতির বাইরে নয়। বরং সব কিছুই তাঁর সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে’’। (আন্’আম : ৫৯)
তিনি আরো বলেন:
«إِنَّ اللهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ، وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ، وَيَعْلَمُ مَا فِيْ الْأَرْحَامِ، وَمَا تَدْرِيْ نَفْسٌ مَا ذَا تَكْسِبُ غَدًا، وَمَا تَدْرِيْ نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوْتُ، إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ»
‘‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই একমাত্র জানেন গর্ভবতী মহিলার জরায়ুতে কি জন্ম নিতে যাচ্ছে। কেউ জানেনা আগামীকাল সে কি অর্জন করবে। কেউ জানেনা কোথায় তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা সর্বজ্ঞ ও সর্ব বিষয়ে অবগত’’। (লোকমান : ৩৪)
তবে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) হাদীসের মধ্যে আমাদেরকে গায়েব সম্পর্কে যে সংবাদগুলো দিয়েছেন তা আল্লাহ্ তা’আলা ওহীর মাধ্যমে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন। অতএব তিনি নিজ পক্ষ থেকে গায়েবের কোন সংবাদ দেননি এবং কখনো তিনি গায়েব জানতেন না।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
« قُلْ لاَ أَقُوْلُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَآئِنُ اللهِ، وَلاَ أَعْلَمُ الْغَيْبَ »
‘‘(হে নবী!) আপনি তাদেরকে বলে দিন: আমি তোমাদেরকে এ কথা বলছি না যে, আমার নিকট আল্লাহ্’র ধন ভান্ডার রয়েছে। যাকে ইচ্ছা তাকে আমি ধনী বানিয়ে দেবো। আর এমনো বলছি না যে, আমি গায়েব জানি তথা অদৃশ্য জগতের কোন খবর রাখি’’। (আন’আম : ৫০)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
«قُلْ لاَ أَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعًا وَّلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَآءَ اللهُ، وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاَسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْـخَيْرِ، وَمَا مَسَّنِيَ السُّوْءُ، إِنْ أَنَا إِلاَّ نَذِيْرٌ وَّبَشِيْرٌ لِّقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ»
‘‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন: আমার ভালো-মন্দ, লাভ-ক্ষতি, মঙ্গল-অমঙ্গল ইত্যাদির ব্যাপারে আমার কোন হাত নেই। বরং আল্লাহ্ তা’আলা যাই ইচ্ছে করেন তাই ঘটে থাকে। আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে আমি প্রভূত কল্যাণ লাভ করতে পারতাম এবং কোন অমঙ্গল ও অকল্যাণ কখনো আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমি অন্য কিছু নই। বরং আমি শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদবাহী’’। (আ’রাফ : ১৮৮)
তিনি আরো বলেন:
«وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ رُوْحًا مِّنْ أَمْرِنَا، مَا كُنْتَ تَدْرِيْ مَا الْكِتَابُ وَلاَ الْإِيْمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُوْرًا نَّهْدِيْ بِهِ مَنْ نَّشَآءُ مِنْ عِبَادِنَا، وَإِنَّكَ لَتَهْدِيْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ»
‘‘এভাবেই আমি আপনার নিকট আমার প্রত্যাদেশ রূহ তথা কোর’আন পাঠিয়েছি। ইতিপূর্বে আপনি কখনোই জানতেন না কোর’আন কি এবং ঈমান কি? মূলতঃ আমি কোর’আন মাজীদকে নূর হিসেবে অবতীর্ণ করেছি। যা কর্তৃক আমার বান্দাহ্দের যাকে ইচ্ছে হিদায়াত দিয়ে থাকি। আর আপনিতো নিশ্চয়ই মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়ে থাকেন’’। (যুখরুফ : ৫২)
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা রাসূল (সা.) ঘর থেকে বের হলে জনৈক ব্যক্তি (জিব্রীল) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো, কিয়ামত কখন হবে? তখন তিনি উত্তরে বললেন:
مَا الْـمَسْؤُوْلُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ، وَلَكِنْ سَأُحَدِّثُكَ عَنْ أَشْرَاطِـهَا، إِذَا وَلَدَتِ الْأَمَةُ رَبَّهَا فَذَاكَ مِنْ أَشْرَاطِهَا، وَإِذَا كَانَتِ الْعُرَاةُ الْـحُفَاةُ رُؤُوْسَ النَّاسِ فَذَاكَ مِنْ أَشْرَاطِهَا، وَإِذَا تَطَاوَلَ رِعَاءُ الْبَهْمِ فِيْ الْبُنْيَانِ فَذَاكَ مِنْ أَشْرَاطِهَا
‘‘যাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তিনি কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাকারী চাইতে বেশি জানেন না। তবে আমি আপনাকে উহার আলামত সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দিতে পারি। যখন কোন দাসী তার প্রভুকে জন্ম দিবে তখন এটি কিয়ামতের একটি আলামত এবং যখন উলঙ্গ ও খালি পা ব্যক্তিরা মানুষের নেতৃস্থানীয় হবে তখন এটি কিয়ামতের আরেকটি আলামত। আর যখন পশু রাখালরা বিরাট বিরাট অট্টালিকা বানাতে প্রতিযোগিতা করবে তখন এটি কিয়ামতের আরেকটি আলামত’’। (বুখারী, হাদীস ৫০ মুসলিম, হাদীস ৯)
রাসূল (সা.) যদি সত্যিই গায়েব জানতেন তাহলে তিনি বিলাল (রা.) কে সাথে নিয়ে তায়েফে গিয়ে পাথর খেয়ে রক্তাক্ত হতেন না। কারণ, রাসূল (সা.) গায়েব জেনে থাকলে তিনি প্রথম থেকেই জানতেন তারা তাঁকে সংবর্ধনা জানাবে। না পাথর নিক্ষেপে রক্তাক্ত করবে।
রাসূল (সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে তিনি ক্বাবা শরীফের সামনে সিজ্দাহ্রত থাকাবস্থায় তাঁর পিঠে কাফিররা উটের ফুল চাপিয়ে দিতে পারতো না।
রাসূল (সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে হা’ত্বিব্ বিন্ আবু বাল্তা’আহ্ (রা.) যখন জনৈকা মহিলাকে মক্কার কাফিরদের নিকট এ সংবাদ লিখে পাঠালেন যে, রাসূল (সা.) অচিরেই তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসছেন। অতএব তোমরা নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য অতিসত্বর প্রস্ত্ততি নিয়ে নাও। তখন রাসূল (সা.) কে ওহীর মারফত তা জেনে অনেক দূর থেকে সে মহিলাকে ধরে আনার জন্য সাহাবাদেরকে পাঠাতে হতোনা। কারণ, তিনি গায়েব জেনে থাকলে প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে জানতেন।
রাসূল (সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে যখন তাঁর দাসী মারিয়াকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হলো তখন তিনি হযরত ’আলী (রা.) কে ব্যভিচারী গোলামকে হত্যা করার জন্য বহু দূর পাঠাতেন না। অথচ তার কোন লিঙ্গই ছিলোনা। যাতে ব্যভিচার সংঘটিত হতে পারে।
রাসূল (সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে যখন মক্কার কাফিররা ’উসমান (রা.) কে হত্যা করে দিয়েছে বলে গুজব ছড়ালো তখন তিনি ঐতিহাসিক ’হুদাইবিয়াহ্ এলাকায় মক্কার কাফিরদের থেকে ’উসমান হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সাহাবাদের থেকে দ্রুত বায়’আত গ্রহণ করতেন না। যা ইতিহাসের ভাষায় ‘‘বায়’আতুর্ রিযওয়ান’’ নামে পরিচিত।
রাসূল (সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে তাঁকে খায়বারে গিয়ে ইহুদী মহিলার বিষাক্ত ছাগলের গোস্ত খেয়ে দীর্ঘ দিন বিষক্রিয়ায় ভুগতে হতো না।
রাসূল (সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে মুনাফিকরা যখন ’আয়েশা (রাঃ)-কে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছিলো তখন তিনি ’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) কে এ ব্যাপারে সন্দেহ করে তাঁর সাথে সম্পূর্ণরূপে কথাবার্তা বন্ধ দিয়ে তাঁকে তাঁর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাসূল (সা.) যখন গায়েব জানেন না তখন তিনি ছাড়া অন্য কোন পীর বা বুযুর্গ গায়েব জানেন বলে বিশ্বাস করা সত্যিই বোকামি বৈ কি?
কাশ্ফ ও গায়েবের জ্ঞানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সূফীদের নিকটে কারোর কাশফ হয় বা কেউ কাশ্ফ ওয়ালা মানে, তার অলক্ষ্যে কিছুই নেই। সকল লুক্কায়িত বা দূরের বস্ত্তও সে খোলা চোখে দেখতে পায়। দুনিয়া-আখিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম, ’আর্শ-কুরসী, লাওহ্-ক্বলম সব কিছুই সে নির্দ্বিধায় দেখতে পায়। এমনকি মানব অন্তরের লুক্কায়িত কথাও সে জানে।
বরং কাশ্ফের ব্যাপারটি গায়েবের জ্ঞানের চাইতেও আরো মারাত্মক। কারণ, গায়েবের জ্ঞানের সাথে খোলা চোখে দেখার কোন শর্ত নেই। কিন্তু কাশফের মানে, খোলা চোখে দেখা।
অতএব যখন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া গায়েবের জ্ঞান আর কারোর নেই তখন কাশ্ফও একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই হবে। আর কারোর নয়। যদিও কাশ্ফ শব্দের অস্তিত্ব উক্ত অর্থে কোর’আন ও হাদীসের কোথাও পাওয়া যায় না। বরং তা সূফীদের নব আবিষ্কার।