প্রশ্ন: এক ব্যক্তি বৃহৎ দীনের (ইসলামের) মূলনীতি সংক্ষেপে জানতে প্রশ্ন করেছেন।
উত্তর: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনেক বড় প্রশ্ন। এর উত্তরও অনেক বড়। কেননা এ প্রশ্নের উত্তরে ইসলামী শরী‘আত ও ঈমানের হাকীকত যেসব মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গঠিত সেসব মূলনীতির সবগুলো আলোচনা করা প্রয়োজন। উত্তর প্রদানের আগে আমি একটি বিষয় পাঠককে বলতে চাই যে, এ প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত ও দলীল উল্লেখের প্রয়োজনীয়তা থাকায় এর উত্তর সংক্ষেপে আমি যথাযথভাবে দিতে পারব না। তবে কায়েদায় আছে, কোনো জিনিসের পুরোটা অনুধাবন করা না গেলেও তার পুরোটা চলে যায় না (অর্থাৎ কিছুটা হলেও বুঝা যায়)। তাই এখানে আমি ইশারায় ও সংক্ষেপে মহান দীন ইসলামের উসূল আলোচনা করব। এ দীনের অনেক উসূল রয়েছে; তবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উসূলগুলো আমি নিম্নে বর্ণনা করব।
প্রথম উসূল: তাওহীদ
তাওহীদের সব প্রকার সন্নিবেশিত পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা হলো, পরিপূর্ণ গুণের সমন্বয়ে রবের একত্বতা সম্পর্কে বান্দার বিশ্বাস ও ঈমান এবং সব ধরণের ইবাদত একমাত্র তাঁর জন্যই করা। তাহলে এ সংজ্ঞায় তাওহীদের সব প্রকারই শামিল করেছে। তা হলো, তাওহীদুর রুবুবিয়্যাত তথা রবকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পরিচালনাকারী ও লালন পালনকারী হিসেবে স্বীকার করা। তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাত তথা আল্লাহ নিজের জন্য যেসব নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন বা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য যেসব নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন এবং তা কোনো সাদৃশ্য ও উপমা ব্যতীত, বিকৃতি ও পবিরর্তন ব্যতিরেকে যেসব গুণাবলী এগুলোর ওপর প্রমাণ করে সেগুলো আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা। তাওহীদুল ইলাহিয়্যাত ওয়াল ইবাদাত তথা সব ধরণের ইবাদাতের জন্য আল্লাহকে এক ও একক করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করে তাঁকে একক করা এবং তাঁর পরিপূর্ণ ইলাহিয়্যাতের স্বীকৃতি দেওয়া।
অতএব, তাওহীদুর রুবুবিয়্যাতের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়। যথা: আল্লাহর ফয়সালা ও তাকদীরের ওপর বিশ্বাস সাব্যস্ত হওয়া, তিনি যা চান তাই হয়, আর তিনি যা ইচ্ছা করেন না তা হয় না, তিনি সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান, তিনি মুখাপেক্ষীহীন, প্রশংসিত আর তিনি ছাড়া সবাই সব দিক থেকে তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী।
তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়: কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত সব আসমাউল হুসনা তথা আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ, এসব নামসমূহের তিনটি স্তরের প্রতি ঈমান আনা, নামসমূহের প্রতি ঈমান, সিফাত তথা নামের গুণের প্রতি ঈমান ও এসব সিফাতের আহকামের প্রতি ঈমান আনা। যেমন, আল্লাহ আলীম তথা মহাজ্ঞানী, মহাজ্ঞানের অধিকারী। তিনি সব কিছু পূর্ণাঙ্গরূপে জানেন। তিনি কাদীর তথা সর্বশক্তিমান, মহাশক্তির অধিকারী, সব কিছুর ওপর তাঁর শক্তি রয়েছে। এভাবে বাকী আসমাউল হুসনা তথা আল্লাহর সুন্দরতম নামসমূহ, সিফাতসমূহ ও এর থেকে নির্গত গুণসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করা।
তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাতের মধ্যে আরও অন্তর্ভুক্তি করে, সমস্ত সৃষ্টির ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্ব, তাঁর আরশের উপর আসন গ্রহণ, তাঁর সম্মান ও বড়ত্ব তাঁর শান অনুযায়ী যেভাবে হওয়া দরকার সেভাবে থেকেই তিনি প্রতি রাতে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন।
এছাড়াও তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাতের মধ্যে শামিল হয়, যেসব যাতী সিফাত যা তাঁর থেকে কখনই আলাদা হয় না সেগুলো সাব্যস্ত করে। যেমন, শ্রবণ, দেখা, ঊর্ধ্বে থাকা ইত্যাদি। এছাড়াও আছে অন্তর্ভুক্ত করে তাঁর ফে‘লী সিফাত, তা হচ্ছে, তাঁর ইচ্ছা ও কুদরতের সাথে সম্পৃক্ত সিফাতসমূহ। যেমন, কালাম তথা কথা বলা, সৃষ্টি করা, রিযিক দেওয়া, রহমত করা, আরশে আসন গ্রহণ করা, তাঁর ইচ্ছানুযায়ী দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করা। তবে এসব গুণাবলী তাঁর সাথে কারো সাদৃশ্য না করে বা কোন রকম বিকৃতি ও পরিবর্তন ছাড়াই আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা। এসব গুণাবলী তাঁর জন্য নির্ধারিত এবং তিনি এসব গুণে গুণান্বিত। আল্লাহ সর্বদা কাজ ও কথা বলেছেন এবং তিনি সর্বদাই কাজ করবেন ও কথা বলবেন। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন। যখন ও যেভাবে ইচ্ছা কথা বলেন। তিনি সর্বদা কথা বলার গুণে গুণান্বিত এবং রহমাতের গুণে প্রসিদ্ধ।
তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাতের মধ্যে আরো অন্তর্ভুক্ত হয়, আল-কুরআন আল্লাহর নাযিলকৃত বাণী, এটি তাঁর সৃষ্টি নয়, এটি তাঁর থেকেই এসেছে এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাবে, তিনি এর শব্দ ও অর্থ উভয়ের কথক, তাঁর বাণী শেষ হবে না এবং পরিবর্তনও হবে না, এসবের ওপর ঈমান আনয়ন করা।
এতে আরও শামিল হয়, তিনি সর্বাধিক নিকটে ও সাড়াদানকারী, এতদসত্ত্বেও তিনি সুউচ্চ ও সবার ঊর্ধ্বে। তাঁর সর্বাধিক নিকটবর্তী হওয়া ও সর্বাধিক উপরে হওয়ার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। কেননা সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই তাঁর অনুরূপ নেই। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আল্লাহর নামসমূহ, সিফাতসমূহ, কর্মসমূহ ও এর আহকামসমূহ যেভাবে তাঁর মহান শানে যোগ্য সেভাবেই সেগুলো ওপর পরিপূর্ণ ঈমান না আনলে তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাতের ওপর পূর্ণাঙ্গ ঈমান আনা হবে না। এভাবে আরও দৃঢ়ভাবে জানা যে, তাঁর যাতের অনুরূপ যেমন কেউ নেই তেমনি তাঁর সিফাতের অনুরূপও কেউ নেই। কেউ তাঁর কোনো সিফাতকে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যাখ্যা করে অন্যের জন্য সাব্যস্ত করলে সে স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত।
তাওহীদুর রুবুবিয়্যাত ততক্ষণ পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ বান্দা বিশ্বাস করবে যে, বান্দার সমস্ত কাজ আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাদের ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগামী হয়, তবে কাজটি সংঘটিত হতে তাদের পূর্ণ সক্ষমতা ও ইচ্ছা থাকে। কাজের জন্য প্রশংসা, নিন্দা, আদেশ, নিষেধ, সাওয়াব ও শাস্তি বান্দার সাথেই সম্পৃক্ত। এখানে দু’টি বিষয় পরস্পর বিপরীতমুখী নয়, কেননা আল্লাহর যাত, কর্মসমূহ ও সিফাতের জন্য সর্বব্যপ্তি সাধারণ ইচ্ছা সাব্যস্ত করা আর কাজ ও কথা বাস্তবায়নে বান্দার সক্ষমতা ও শক্তি সাব্যস্ত করা।
এছাড়াও তাওহীদুর রুবুবিয়্যাত ততক্ষণ পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ বান্দা তার সমস্ত কথা ও কাজে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও একনিষ্ঠতা না করবে; এমনকি তাওহীদের সম্পূর্ণ বিপরীত শির্কে আকবর তথা বড় শির্ক ছেড়ে দিলেও সে যদি কোনা ইবাদত আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য করে তাহলেও তাওহীদুর রুবুবিয়্যাত পূর্ণ হবে না। এ তাওহীদের বাস্তবায়ন করতে হলে সব ধরণের ছোট শির্ক ছেড়ে দিতে হবে। আর ছোট শির্ক হলো যেসব শির্ক বড় শির্কের দিকে ধাবিত করে। যেমন, আল্লাহ ব্যতীত কারো নামে শপথ করা, লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদাত করা ইত্যাদি।
তাওহীদের ক্ষেত্রে আল্লাহকে জানা, তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ইবাদত-বন্দেগী করার ভিত্তিকে মানুষ কয়েক শ্রেণিতে বিভক্ত। তাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন তারা যারা আল্লাহর নামসমূহ, তাঁর সিফাতসমূহ, কাজসমূহ ও তাঁর নি‘আমতসমূহ, তিনি তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে যা বলেছেন, কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত কিয়ামত দিবস ও প্রতিদান ইত্যাদি বিস্তারিত জানে, এর সঠিক অর্থ জানে ও বুঝে, অতঃপর আল্লাহকে ও তাঁর মহাত্ব, বড়ত্ব, ভালোবাসা, তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করা ইত্যাদি জেনে তার অন্তর ঈমানে ভরে যায় এবং তার অন্তর আল্লাহর প্রতি আকর্ষিত ও বিমুগ্ধ হয়। এছাড়াও সে একমাত্র আল্লাহর দিকে ফিরে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে না, তার সমস্ত কাজ-কর্ম, চলাফেরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হয়ে থাকে, এর দ্বারা পার্থিব কোন কিছু প্রত্যাশা করে না। ফলে আল্লাহকে জানা, তাঁর সমীপে বিনয়ী হওয়া, কোনো কাজ করা বা ছেড়ে দেওয়া সব ক্ষেত্রেই তার অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। এতে তার অন্তরে ইখলাস পরিপূর্ণ হয়, সে অনুযায়ী সে চলতে থাকে এবং অন্যকেও এ মূলনীতির দিকে দাওয়াত দিয়ে তাকেও পরিপূর্ণ করে।
ঈমানদার ও তাওহীদে বিশ্বাসীদেরকে ভালোবাসা, তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা, শির্ক ও মুশরিকদদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, আল্লাহর জন্যই কাউকে বন্ধু করা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই কারে সাথে শত্রুতা করা, তার ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসার অনুগামী হওয়া ব্যতীত কারো তাওহীদ পরিপূর্ণ হবে না। আমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছি তিনি যেন তাঁর অনুগ্রহ ও দয়ায় আমাদেরকে তাওহীদের নি‘আমত দান করেন।
দ্বিতীয় উসূল: সমস্ত নবীদের প্রতি সাধারণভাবে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিশেষভাবে ঈমান আনয়ন করা
এ উসূলের মূল হলো, বান্দা স্বীকার করবে ও বিশ্বাস করবে যে, সমস্ত নবীদেরকে আল্লাহ অহী ও রিসালাত দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, তাদেরকে তিনি তাঁর শরী‘আত ও দীন পৌঁছানোর জন্য তাঁর ও সৃষ্টিকুলের মধ্যে মধ্যস্থ বানিয়েছেন এবং তাদের সত্যায়ন ও তাদের আনিত বিষয়গুলোর সঠিকতা প্রমাণের জন্য তিনি তাদেরকে মু‘জিযা দিয়ে সাহায্য করেছেন। তারা সৃষ্টিগত, বিদ্যা-বুদ্ধি ও আমলের দিক থেকে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মানব। তারা সর্বাধিক সৎ ও নেককার, চরিত্র ও কর্মের দিক থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তি। আল্লাহ তাদেরকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিশিষ্ট করেছেন, তাদেরকে এমন সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন যা তিনি অন্যদেরকে দেন নি, সমস্ত অসচ্চরিত্র ও নোংরামী থেকে আল্লাহ তাদেরকে পবিত্র রেখেছেন, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে যা পৌঁছে দিয়েছেন সে ব্যাপারে নিষ্পাপ, আল্লাহ তাদের দেওয়া সংবাদ ও দাওয়াত শুধু হক ও সঠিক হওয়ার উপর স্থির থাকেন, আল্লাহ তাদেরকে ভুলের ওপর স্থায়ী রাখেন না। তাদের সকলের ওপর ও তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন সেগুলোর উপর ঈমান আনা, তাদেরকে ভালোবাসা ও সম্মান করা ফরয। এসব কিছু আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে আরও অধিক পূর্ণরূপে সাব্যস্ত ও প্রমাণিত। তিনি শরী‘আতের যা কিছু নিয়ে এসেছেন সেগুলো সাধ্যানুযায়ী সংক্ষিপ্তাকারে ও বিস্তারিত জানা, এসবের উপর ঈমান আনা, এগুলোকে আঁকড়িয়ে ধরা, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত সংবাদের ওপর সর্বদা ঈমান রাখা, তার আদেশ মান্য করা ও তার নিষেধ থেকে বিরত থাকার ওপর সুদৃঢ় থাকা।
আরও ঈমান রাখা যে, তিনি খাতামুন নাবীয়্যীন তথা সর্বশেষ নবী, তার শরী‘আত পূর্ববর্তী সব শরী‘আতকে রহিত করেছে, তার নবুওয়াত ও শরী‘আত কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে, তার পরে আর কোন নবী আসবেন না, দীনের মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখার ব্যাপারে তার শরী‘আত ছাড়া আর কোনো শরী‘আত থাকবে না।
রাসূলগণের প্রতি ঈমানের মধ্যে তাদের আনিত কিতাবের প্রতি ঈমান আনয়ন করাও অন্তর্ভুক্ত। অতএব, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেস উপর ঈমান আনয়ন করলে তার আনিত কিতাব আল-কুরআন ও সমস্ত সুন্নাহের প্রতি শব্দ ও অর্থ উভয় দিক থেকে ঈমান আনা অত্যাবশ্যকীয়। তাই এ দুয়ের প্রতি ঈমান না আনলে তার ঈমান পূর্ণ হবে না। যে ব্যক্তি এসবের প্রতি সর্বোচ্চ পরিমাণে ইলম লাভ, বিশ্বাস, স্বীকৃতি অর্জন ও আমল করতে পরবে সে ব্যক্তি ততবেশি পরিপূর্ণ ঈমানদার।
এ মহা মূলনীতির মধ্যে ফিরিশতাদের প্রতি সাধ্যানুযায়ী ঈমান আনাও শামিল। ঈমানের পূর্ণতার মধ্যে হলো, এ কথা জানা যে, তারা নবীদের কাছে যা কিছু নিয়ে এসেছেন সেগুলো সত্য, আক্বলী বা ইন্দ্রিয় কোনো প্রমাণ এর বিপরীত হতে পারে না, এমনিভাবে নকলী তথা বর্ণনাভিত্তিক দলীলও এর বিপরীত হতে পারে না। অতএব, সুস্থ বিবেক ও ইন্দ্রিয় কুরআন ও সুন্নাহ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসার প্রমাণ বহন করে, এগুলোর উপর আমল করতে উৎসাহিত করে, তাছাড়া কুরআন ও সুন্নাহে ক্ষতিকর কোনো বিষয় উল্লেখ নেই তাও সুস্থ বিবেক ও ইন্দ্রিয় প্রমাণ করে; যদিও শর‘ঈ দলীল কুরআন ও সুন্নাহ- এ ক্ষতিকর কিছু থাকা নিষেধ করেছে ও এ ব্যাপারে নিন্দা করেছে।
তৃতীয় উসূল: কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান
কুরআন ও হাদীসে মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে যা কিছু এসেছে সেগুলো ইয়াওমুল আখিরাত তথা কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়নের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, বারযাখের অবস্থা, কিয়ামতের অবস্থা, এ দিবসের হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান, শাস্তি, শাফা‘আত, মীযান, আমলনামা, ডান ও বাম হাতে আমলনামা গ্রহণ, জান্নাত ও জাহান্নামের অবস্থা, জান্নাতী ও জাহান্নামীদের বর্ণনা, আল্লাহ উভয় দলের জন্য যেসব নি‘আমত ও আযাব তৈরি করে রেখেছেন সেগুলোর সংক্ষিপ্ত ও বিশদ বর্ণনা ইত্যাদি পরকালের প্রতি ঈমানের শামিল।
চতুর্থ উসূল: ঈমান সম্পর্কে মাসআলা
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে, কুরআন ও হাদীসে ঈমান সম্পর্কে যা এসেছে তা হলো, অন্তরের স্বীকৃতি যা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা বহিঃপ্রকাশ হয় তাই ঈমান। তারা বলেন, অন্তরের বিশ্বাস ও কাজ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা তা সম্পাদন ও মুখে উচ্চারণকে ঈমান বলে। এ তিনটি কাজই ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে তা পরিপূর্ণ করবে সে ব্যক্তি ঈমান পূর্ণ করল, আর যে ব্যক্তি এর কোন কিছুতে ত্রুটি করল সে তার ঈমানে অপূর্ণ থাকল।
ঈমানের সত্তরেরও বেশি শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর সর্বোচ্চ শাখা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং সর্বনিম্ন শাখা হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস তুলে ফেলা। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ।
এ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তারা (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আম) মানুষকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করেন। তারা হলেন, মুকাররাবূন তথা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তরা, ডানপন্থী ও দীন ও ঈমানের অবস্থা ভেদে যালিমগণ। ঈমান বাড়ে ও কমে। যে ব্যক্তি হারাম কাজ করে বা ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় তার তাওবা না করা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ঈমান কমে যায়।
এ উসূলের ওপর ভিত্তি করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আম মানুষকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তারা হলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের হক পুরোপুরি আদায় করেছে সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন। আর যে ব্যক্তি ঈমানের হক পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে সে কাফির। আর তৃতীয় প্রকার হলো, যে ব্যক্তির মধ্যে ঈমান ও কুফুরী, ঈমান ও নিফাক, ভালো-মন্দ উভয়ই বিদ্যমান। তার জন্য রয়েছে আল্লাহর অভিভাবকত্ব এবং এ কারণে সে তার ঈমান অনুযায়ী সম্মানিত হবে। আবার তার জন্য আল্লাহর ক্রোধও রয়েছে, তাই তার ঈমানের দুর্বলতা ও ঈমানের চাহিদা হারানোর কারণে সে আল্লাহর আযাব ভোগ করবে।
এ কথার ওপর ভিত্তি করে তারা (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আম) বলেন যে, কবীরা গুনাহকারী ও সগীরা গুনাহকারী কুফুরীর স্তরে পৌঁছে না, তবে তাদের মধ্যে ঈমানের কমতি দেখা দেয়, কিন্তু এ কারণে তারা ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে না এবং তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামীও হবেন না। তাদের ব্যাপারে কাফির শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, যেমন খাওয়ারিজরা করে থাকেন অথবা তাদেরকে ঈমানহারাও বলা যাবে না, যেমনটি ‘মুতাজিলারা করে থাকেন; বরং তারা ঈমানের কারণে মুমিন আর কবীরা গুনাহের কারণে ফাসিক। অতএব, তাদের মধ্যে সাধারণ ঈমান বিদ্যমান। আর যার মধ্যে সাধারণ ঈমান বিদ্যমান তাকে কাফির বলা যাবে না। যখন আপনি এ উসূলটি এভাবে জানবেন তখন আপনার কুরআন ও সুন্নাহের উপর পুরোপুরি ঈমান অর্জিত হবে।
এ উসূলের ভিত্তিতে বলা হয় যে, ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে পূর্বের সব গুনাহ মোচন হয়ে যায়, তাওবার কারণে পূর্বের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়, কেউ মুরতাদ হলে তার সব আমল নষ্ট হয়ে যায় এবং যে ব্যক্তি তাওবা করে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন।
এ উসূলের ভিত্তিতে তারা ঈমানের ব্যাপারে ইনশাআল্লাহ বলাও সহীহ মনে করেন। তারা বলেন, ‘আমি মুমিন ইনশাআল্লাহ’ বলা বৈধ। কেননা এর দ্বারা সে আল্লাহর পক্ষ্য থেকে ঈমান পরিপূর্ণ হওয়া আশা করেন। তাই সে ইনশাআল্লাহ বলেছে। আবার, মৃত্যু পর্যন্ত ঈমানে ওপর অটল থাকার আশা করেছে, তাই সে মূল ঈমানের ব্যাপারে সন্দেহ ছাড়াই এভাবে ইনশাআল্লাহ বলেছে।
এ উসূলের ওপর ভিত্তি করে তারা বলে থাকেন যে, কাউকে ভালোবাসা ও ঘৃণা করার ভিত্তি ও পরিমাণ নির্ধারিত হয় প্রকৃতপক্ষে ঈমান থাকা ও না থাকা এবং পরিপূর্ণ হওয়া বা অপরিপূর্ণ থাকা অনুসারে। অতঃপর, এ অনুযায়ী বন্ধুত্ব ও শত্রুতার পরিমাণ নির্ধারিত হয়। এ কারণেই ঈমানের অঙ্গ হলো, কাউকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা আবার কারো সাথে আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করা, বন্ধুত্ব শুধু আল্লাহর জন্য এবং শত্রুতাও একমাত্র তার জন্যই। কেউ নিজের জন্য যা ভালোবাসে তা তার অন্য ভাইয়ের জন্যও ভালো না বাসলে তার ঈমান পরিপূর্ণ হবে না।
এ উসূলের ওপর ভিত্তি করে আরও বর্তাতে, মুমিনদের মাঝে ভালোবাসা, তাদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করতে উৎসাহিত করা এবং পরস্পরে বিছিন্ন না হওয়া ইত্যাদি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরস্পর পক্ষপাতিত্ব, নানা দলে বিভক্ত ও একে অপরকে হিংসা-বিদ্বেষ করা থেকে মুক্ত। তারা এ ভিত্তিকে ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ উসূল মনে করেন। যে সব মাসআলায় বিভেদের কারণে বিদ‘আত ও কুফুরীর দরজায় পৌঁছায় না সে সব মাস’আলার ব্যাপারে তারা মতানৈক্য করা সমীচীন মনে করেন না।
ঈমানের উসূলের ওপর আরও শামিল করবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের স্তর অনুসারে তাদেরকে ভালোবাসা, তাদের আগে ও পরে ইসলাম গ্রহণ অনুযায়ী সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে যা সমস্ত উম্মাতের ঊর্ধ্বে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত সাহাবীদের ভালোবাসা সংরক্ষণ করেন ও তা প্রচার করেন; তাদের মধ্যকার ভুল বুঝা-বুঝির ব্যাপারে সমালোচনা থেকে বিরত থাকে। তারা বিশ্বাস করেন যে, সাহাবীগণ সমস্ত উত্তম গুণে গুণান্বিত ও উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি, সব কল্যাণ কাজে তারা অগ্রগামী ও অসৎ কাজ থেকে তারা সবচেয়ে দূরবর্তী। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আরও বিশ্বাস করেন যে, উম্মতের দীন ও দুনিয়ার সংশোধন ও পরিচালনার জন্য একজন ইমামের প্রয়োজন, তিনি তাদের থেকে সীমা-লঙ্ঘনকারীদেরকে প্রতিহত করবেন, আর আল্লাহর নাফরমানি বাদে ভালো কাজে ইমামের আনুগত্য ছাড়া ইমামত পরিপূর্ণ হয় না।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে, সাধ্যানুযায়ী শক্তি, মুখের ভাষা ও অন্তরের দ্বারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা ব্যতীত ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। সর্বোপরি, তারা মনে করেন, শরী‘আতের উসূলসমূহ শর‘ঈ পদ্ধতিতে পালন করাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা।
পঞ্চম উসূল: ইলম ও আমলের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পদ্ধতি
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত দৃঢ় বিশ্বাস করেন ও জানেন যে, উপকারী ইলম ও সৎ আমল ব্যতীত আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও তাঁর পক্ষ থেকে পুরস্কার লাভ করা বিকল্প কোন পথ নেই।
ইলমে নাফে‘ তথা উপকারী ইলম হলো: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন ও সুন্নাহ-এর যেসব ইলম নিয়ে এসেছেন সেগুলোই ইলমে নাফে‘ তথা উপকারী ইলম। তারা কুরআনের অর্থ জানা, এর উসূল ও ফুরু‘ (মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখা) অনুধাবন করা, তারা শব্দের দালালাতুল মুতাবিকা[1], দালালাতুত তাদাম্মুন[2], দালালাতুল ইলতিযাম[3] অনুযায়ী সব পদ্ধতিতে কুরআন ও হাদীসের অর্থ গ্রহণ করে। আল্লাহ তাদেরকে যে জ্ঞান দান করেছেন সে জ্ঞানানুযায়ী তারা এসব কিছু জানতে ও অনুধাবন করতে চেষ্টা করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, এসব কিছু ইলমে নাফ‘ তথা উপকারী ইলম। এগুলো এবং এগুলোর সহযোগী সব ইলমসমূহও শর‘ঈ ইলম। আর প্রত্যেক ক্ষতিকর বা এসব ইলমের বিপরীত ইলম হলো বাতিল ইলম। এটি হলো তাদের ইলমের পদ্ধতি।
আর তাদের আমলের পদ্ধতি হলো: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, পূর্ণ স্বীকৃতি ও মজবুত ঈমানের মাধ্যমে নৈকট্য তালাশ করে, যে ঈমান ইবাদতের মূল ও এর ভিত্তি। এ ব্যাপারে কোনো ধরণের দ্বিধা সংশয় থাকে না। অতঃপর তারা আল্লাহর হক ও সৃষ্টিকুলের হক সম্পর্কিত ফরয আদায়, বেশি বেশি নফল আদায়, সৃষ্টিকুলের প্রতি নানা ভাবে দয়া প্রদর্শন, হারাম কাজ বর্জন ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। তারা দৃঢ়ভাবে জানেন যে, আল্লাহ একনিষ্ঠার সাথে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর নবীর সুন্নাত অনুযায়ী কাজ না করলে তা কবুল করেন না।
তারা উপকারী ইলম ও সৎ আমল যা দুনিয়া ও আখিরাতের সব ধরণের কল্যাণ ও সফলতায় পৌঁছায়, এসবের দ্বারা আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।এ বড় উসূলগুলোই হলো মূল উসূল, এ উসূলের মধ্যেই উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব সংক্ষিপ্তাকারে দেওয়া হয়েছে ও মূল পয়েন্টগুলো আলোচনা করা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি বিস্তারিত আলোচনা ও দলীলসহ উল্লেখ করলে এ সম্পর্কে আরও বিস্তর আলোচনা করা দরকার হবে এবং বড় কিতাব লিখতে হবে। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীদের ওপর।
>[2] শব্দকে যে অর্থে গঠন করা হয়েছে সে অর্থের আংশিক উদ্দেশ্য হলে তাকে দালালাতুত তাদাম্মুন বলে। যেমন, (الخالق) সৃষ্টিকারী শব্দটি শুধু আল্লাহর যাত অথবা শুধু সৃষ্টির গুণের উপর আলাদাভাবে বুঝানো।
[3] শব্দকে যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছে সে অর্থে না বুঝিয়ে তার অত্যাবশ্যকীয় অর্থে বুঝালে তাকে দালালাতুল ইলতিযাম বলে। যেমন, (الخالق) সৃষ্টিকারী শব্দটি আল্লাহর যাত বা সৃষ্টির গুণের উপর না বুঝিয়ে ইলম ও কুদরাতের উপর বুঝানো।
দালালাতের সংজ্ঞা ও প্রকারভেত আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন, আত-তা‘রিফাত, জুরজানী, পৃষ্ঠা ১১০, তিনি এর উদাহরণ (الإنسان) তথা মানুষ দিয়ে দিয়েছেন। এ শব্দটি কথা বলতে সক্ষম প্রাণী তথা মানুষের ওপর পুরোপুরি ব্যবহৃত হয়, আবার এর আংশিক অর্থেও ব্যবহৃত হয় এবং ইলম গ্রহণ করার ক্ষমতার অর্থে অত্যাবশ্যকীয় অর্থেও ব্যবহৃত হয়।