এক: ইমামরা সকলে কুরআন-সুন্নাহর বরখেলাফ করার উপর ঐক্যমত করেছেন এধরনের দাবীর পক্ষে কোনো প্রমাণ নাই। প্রথম পরিচ্ছেদে আমি এ ব্যাপারে আলোকপাত করেছি এবং একটু পর –ইনশাআল্লাহ্‌- ইমামদের আরো কিছু বাণী উল্লেখ করব যা প্রমাণ করে যে ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে, কোনো হুকুম বর্ণনার ক্ষেত্রে তারা কুরআন ও সুন্নাহ্‌কে কত কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে ছিলেন।

আর সাহাবীদের মতের বরখেলাফ করার যে অভিযোগ রাফেযীরা চার ইমামের বিরুদ্ধে উত্থাপন করেছে সে ব্যাপারে বলতে হয়- রাফেযীরা তো সাহাবীদেরকে কাফের ও ভ্রান্ত মনে করে। তারা কিভাবে অন্যদেরকে সাহাবীদের মতের খেলাফ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে!!

এটা বড় তাজ্জব ও অদ্ভুত ব্যাপার। নিঃসন্দেহে এটা তাদের ধোঁকাবাজি ও ছলনা। “তারা ছলনা করে, আল্লাহ্‌ও ছলনা করেন। আল্লাহ্‌র ছলনা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম।” [আনফাল: ৩০]

এ প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়া বলেন, “সাহাবীদের মতের বরখেলাফ করা, তাদের সিদ্ধান্তকে বর্জন করা ইমামিয়াদের কাছে কবে খারাপ কাজ ছিল?! আর যারা সাহাবীদেরকে ভালোবাসে, তাদেরকে আপনজন মনে করে, তাদের যুগকে শ্রেষ্ঠ যুগ মনে করে এবং তাদের ঐকমত্যকে অকাট্য দলীল মনে করে এবং ইত্যাদি…বিষয়ে তারা সকলে একমত; তাদের প্রতি কিভাবে ইমামিয়ারা সাহাবীদের মতের খেলাফ করার অভিযোগ তোলে। যে ইমামিয়ারা সাহাবীদের ঐকমত্যকে দলীল মনে করে না, বরং সাহাবীদেরকে কাফের ও যালেম মনে করে।”[1]

দুই: বারো ইমামী শিয়া ইমামিয়াদের এ অভিযোগের মধ্যেই তো স্ববিরোধিতা। তারা একবার বলে সুন্নী ইমামরা সাহাবীদের খেলাফ করেছেন এবং এটা তাদের বড় অপরাধ। আবার তারাই সাব্যস্ত করে যে, সুন্নী ইমামদের ইলমের ভিত্তি হল সাহাবীদের ইলম।

আসুন আমরা শুনি এ ব্যাপারে ইমামিয়াদের আল্লামা এবং তাদের মাঝে তার যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম ইবনুল মুতাহ্হির আলহিল্লি কি বলেন। তিনি তার মিনহাজুল কারামাহ্‌ গ্রন্থে বলেন, “মালেক পড়েছেন রবী‘আ’র[2] কাছে, আর রবী‘আ’ পড়েছেন ইকরিমার[3] কাছে, ইকরিমা পড়েছেন ইবনে আব্বাসের কাছে, আর ইবনে আব্বাস তো আলীর ছাত্র[4] ছিলেন।”[5]

এর কয়েক পৃষ্ঠা আগে বলেন, “ফিকহবিদ সবার রেফারেন্স হলেন তিনি”[6] উদ্দেশ্য হচ্ছে –আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু।

প্রকৃতপক্ষে এ সকল ফিকহের ইমামদের ইলম ও ফিকহের উৎস হল সাহাবীদের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ইলম ও ফিকহ। ইমাম আবু হানীফার রাহিমাহুল্লাহ ইলম ও ফিকহের খাস ওস্তাদ ছিলেন হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান। হাম্মাদ ছিলেন নাখ‘য়ীর[7] ছাত্র। নাখ‘য়ী ছিলেন আলকামার[8] ছাত্র। আলকামা ছিলেন আব্দুল্লাহ্‌ ইবন মাসউদের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ছাত্র।

মালেকের কথা সবাই জানে, তিনি ইলম গ্রহণ করেছেন মদীনার আলেমদের কাছ থেকে, যারা প্রসিদ্ধ সাতজন ফকীহর[9] কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন। যে ফকীহরা যায়েদ ইবন সাবেত, আব্দুল্লাহ্‌ ইবন উমর প্রমুখ সাহাবীদের কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন।

ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ মক্কার আলেমদের কাছ থেকে ফিকহের ইলম গ্রহণ করেছেন। যারা ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার ছাত্রদের কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন এবং তিনি পরবর্তীতে মালেকের কাছ থেকেও ইলম গ্রহণ করেছেন।

ইমাম আহমাদ ছিলেন হাদীসবিশারদদের মতাদর্শের উপরে। তিনি ইলম গ্রহণ করেছেন সুফিয়ান ইবন ‘উয়াইনা ও আমর ইবন দিনারের[10] কাছ থেকে এবং এ দুজন ইলম গ্রহণ করেছেন ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর ও অন্যান্য সাহাবীদের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কাছ থেকে।[11]

অতএব এ ধরনের ব্যক্তিবর্গকে সাহাবীদের সাথে খেলাফ করার অভিযোগ অভিযুক্ত করাকে কার বিবেকে সায় দিবে?তিন: তাদের আরেকটি অভিযোগ হল যে, সুন্নী মাযহাবের ইমামরা আলী ইবন আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর দেওয়া কিছু কিছু ফতোয়া ও হুকুমের সাথে দ্বিমত করেছেন। আমরা বলব, কোনো একটা মাসয়ালায় একজন সাহাবীর সাথে দ্বিমত করা এবং এর বিপরীতে অধিকাংশ সাহাবীর সাথে একমত হওয়া অবান্তর কিছু নয়। বিশেষতঃ এ দ্বিমত যদি কুরআন-সুন্নাহ নির্ভর সঠিক নীতিমালার আলোকে হয়ে থাকে। কারণ সঠিক মতানুযায়ী কোনো সাহাবীর সাথে যদি অপরাপর সাহাবীরা দ্বিমত পোষণ করেন তাহলে ঐ সাহাবীর কথা অকাট্য দলীল হবে না। এটাই উসুলুল ফিকহের সিদ্ধান্ত।[12]

[1] মিনহাজুস সুন্নাহ্‌ (৩/৪০৫-৪০৬)।

[2] তাকে বলা হয় রাবীআ’তুর রায়।

[3] তিনি হচ্ছেন ইবনে আব্বাসের আযাদকৃত দাস ‘ইকরিমা’। তিনি ছিলেন তাবেয়ী এবং মক্কার ফকীহদের অন্যতম। তার মূল বংশ বারবারী। হাদীয়া হিসেবে তিনি ইবনে আব্বাসের কাছে আগত হয়েছিলেন। ইবনে আব্বাস অত্যন্ত পরিশ্রম করে তাকে আলেম বানান এবং ফতোয়া দেয়ার অনুমতি দেন। তার মৃত্যুর সাল ১০৪ হিঃ, মতান্তরে ১০৫ হিঃ, মতান্তরে ১০৬ হিজরী। [আশ শাজারাত (১/১৩০]

[4] এটা ইমামিয়াদের মিথ্যাচারের একটি। ইবনে তাইমিয়া ‘আল মিনহাজে’ বলেন, “ইবনে আব্বাস আলীর (রাঃ) ছাত্র ছিলেন এটা ডাহা মিথ্যা কথা। কারণ আলী (রাঃ) থেকে ইবনে আব্বাসের (রাঃ) রেওয়ায়েত একেবারে কম। তার অধিকাংশ রেওয়ায়েত হচ্ছে- উমর, যায়েদ ইবন সাবেত ও আবু হুরায়রা প্রমুখ সাহাবী (রাঃ) থেকে।”

[5] ‘মিনহাজুল কারামাহ্‌’ (পৃষ্ঠা: ১৭৯), মাধ্যম রেফারেন্স: মিনহাজুস সুন্নাহ আননাবাওয়্যিয়্যাহর (পৃষ্ঠা: ৭/৫৩৫)।

[6] মিনহাজুল কারামাহ্‌’ (পৃষ্ঠা: ১৭৮) মাধ্যম রেফারেন্স: মিনহাজুস সুন্নাহ আননাবাওয়্যিয়্যাহর (পৃষ্ঠা: ৭/৫২৯)।

[7] তিনি হচ্ছেন- ইব্রাহীম ইবন ইয়াযিদ আননাখায়ী’, তার উপনাম: আবু ইমরান (ইমরানের বাবা)। মহান ইমাম, ইরাকের ফকীহ। তিনি মাসরুক, আলআসওয়াদ ও আলকামার ছাত্র ছিলেন। মৃত্যু: ৯৫ হিঃ। [আশ শাজারাত (১/১১১)]

[8] তিনি হচ্ছেন- আলকামা ইবন কায়স আননাখায়ী আলকুফী; ফিকাহবিদ। তিনি ইবনে মাসউদের (রাঃ) ছাত্র ছিলেন এবং তাকে ইবনে মাসউদের (রাঃ) সাথে সাদৃশ্য দেওয়া হত। একাধিক সাহাবী তার কাছ থেকে ফতোয়া গ্রহণ করেছেন। মৃত্যু: ৬২ হিঃ। [আশ শাজারাত (১/৭০)]

[9] সে সাতজন ফকীহ হচ্ছেন- সাঈদ ইবন আলমুসাইয়্যেব, উরউয়া ইবন আয-যুবাইর, খারিজা ইবন যায়েদ, আল-কাসেম ইবন মুহাম্মদ, আবু বকর ইবন আব্দুর রহমান, সুলাইমান ইবন ইয়াসার, উবাইদুল্লাহ্‌ ইবন আব্দুল্লাহ্‌ ইবন উতবাহ্‌ ইবন মাসউদ। [দেখুন: ইবনুল কাইয়্যেমের ই‘লামুল মুওয়াক্কিয়ীন’ (১/২৩)]

[10] তিনি হচ্ছেন- আমর ইবন দিনার, তার উপনাম হচ্ছে: আবু মুহাম্মদ (মুহাম্মদের পিতা)। তিনি আলজামহী গোত্রের আযাদকৃত দাস ছিলেন। ইয়ামেনের ছানয়ার বাসিন্দা ছিলেন। ইবনে আব্বাস ও জাবের (রাঃ) থেকে হাদীস শুনেছেন। শু‘বা বলেন: “হাদীস শাস্ত্রে আমি তার চেয়ে মজবুত কাউকে দেখিনি”। ১২৬ হিজরীতে তিনি মক্কাতে মারা যান। [আশ শাজারাত (১/১৭১)]

[11] দেখুন: মিনহাজুস সুন্নাহ্‌ (৭/৫২৯-৫৩০), ই’লামুল মুওয়াক্কিয়ীন (১/২৩)।

[12] এ ক্ষেত্রে যে খেলাফ বর্ণনা করা হয় তা ঐ ক্ষেত্রে যদি কোন সাহাবীর মতের বিপক্ষে অন্য কোন সাহাবীর মত আছে বলে জানা না যায়। মুহাম্মদ আমীন আশ শানকিতী তার ‘মুযাক্কিরা’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা: ১৬৪) এ কথাকেই সাব্যস্ত করেছেন। দেখুন: ‘মারাকিস ছু-উদ ইলা মারাকিস সু-উদ’, লেখক: মুহাম্মদ আলআমীন ইবন আহমাদ আলজিনকী (পৃঃ ৪০১), তাহকীক: মুহাম্মদ মুখতার আশশানকিতী, এছাড়াও দেখুন: শায়খুল ইসলামের ‘মাজমুউ ফাতাওয়া’ (১/২৮৩-২৮৪)।