ইতোপূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, সহীহাইনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে,

«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ».

“যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমযানের সাওম পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়”।[1]

মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে, «وما تأخر» এ হাদীসের সনদ হাসান। আরও এসেছে,

«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ».

“যে ব্যক্তি রমযানে ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় সাওম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়”।[2]

নাসাঈ আরও বৃদ্ধি করেছেন,

«غفر له ما تقدم من ذنبه وما تأخر»

তার পূর্ব ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়।[3]

ইমাম আহমাদ লাইলাতুল কদর সম্পর্কে মারফু‘ সূত্রে বর্ণনা করেছেন,

«فَمَنْ قَامَهَا ابْتِغَاءَهَا إِيمَانًا، وَاحْتِسَابًا، ثُمَّ وُفِّقَتْ لَهُ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ».

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করবে, অতঃপর সে রাত লাভ করার তাওফীকপ্রাপ্ত হবে, তার পিছনের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে”।[4]

...

গুনাহ ক্ষমা হওয়া বা গুনাহের কাফফারা হওয়ার শর্ত হলো, সাওম অবস্থায় যা কিছু থেকে বিরত থাকা জরুরি সে সব জিনিস থেকে বিরত থাকা ও নিজেকে সংরক্ষিত রাখা। জমহুরের মতে, এখানে কাফফারা বলতে সগীরা গুনাহ মাফ হবে। কেননা মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«الصَّلَوَاتُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ».

“পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমু‘আ থেকে আরেক জুমু‘আ পর্যন্ত এবং এক রমযান থেকে অপর রমযান পর্যন্ত এসব তাদের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কাফফারা হয়ে যাবে, যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে”।[5] এ হাদীসের ব্যাখ্যা দু’ধরণের:

প্রথমত: গুনাহের কাফফারার জন্য শর্ত হলো কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা।

দ্বিতীয়ত: হাদীসে বর্ণিত এসব ফরযসমূহ বিশেষ করে সগীরা গুনাহর কাফফারা।

ইবন মুনযির রহ. বলেন, লাইলাতুল কদরে কবীরা ও সগীরা উভয় ধরণের গুনাহ মাফের আশা করা যায়।

কেউ কেউ বলেছেন: এর মতো সাওমের দ্বারাও কবীরা ও সগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

তবে অধিকাংশ আলেমের মতে, কবীরা গুনাহ খাটি তাওবা ব্যতীত মাফ হয় না। অবশ্য আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীস প্রমাণ করে যে, উক্ত তিনটি কারণ (সালাত, জুমু‘আ ও রমযান) প্রতিটি তার পূর্ববর্তী গুনাহের কাফফারা। অতএব, লাইলাতুল কদরে সালাত আদায়ের দ্বারা পূর্বের গুনাহের কাফফারা হবে, যখন সে তা প্রাপ্ত হবে, যদিও ব্যক্তি সে দিনটি অনুভব করতে পারে নি। অন্যদিকে রমযানের সাওম পালন ও তারাবীহর সালাত আদায় দ্বারা গুনাহের কাফফারা হওয়ার বিষয়টি পুরো রমযান মাস পূর্ণ করে সেগুলো আদায় করার সাথে সম্পৃক্ত।

কেউ কেউ বলেন, রমযানের শেষ দিনের রাতে ক্ষমা করা হয়।

....

মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ وَصَلَّى الصَّلَوَاتِ وَحَجَّ البَيْتَ - لَا أَدْرِي أَذَكَرَ الزَّكَاةَ أَمْ لَا - إِلَّا كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ أَنْ يَغْفِرَ لَهُ ».

“যে ব্যক্তি রমযানের সাওম পালন করল, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করল –বর্ণনাকারী বলেন, তিনি যাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন কী-না জানি না- আল্লাহর ওপর কর্তব্য হলো তাকে ক্ষমা করে দেওয়া”।[6]

ইমাম যুহরী রহ. বলেন, ঈদের দিন মানুষ যখন সালাতের জন্য ঈদগাহে বের হয় তখন আল্লাহ তাদের সম্মুখে বের হয়ে বলেন, হে আমার বান্দা তোমরা আমার জন্য সাওম পালন করেছ, আমার জন্য সালাতে দাঁড়িয়েছ। আজ তোমরা ক্ষমাকৃত হয়ে ফিরে যাও। মুওয়াররিক্ব বলেন, সেদিন (ঈদের) কতিপয় লোক এমনভাবে ফিরে আসে যেমন একজন সন্তান তার মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়।

...

সাওম ও অন্যান্য ইবাদত যে কেউ পুরোপুরি হক আদায় করে পালন করবে সে আল্লাহর প্রতিদানপ্রাপ্ত উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হক আদায় না করে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গাফলতিসহ আদায় করবে তার জন্য দুর্ভোগ। দুনিয়ার পরিমাপেই যদি তাদের জন্য দুর্ভোগ হয় তাহলে আখিরাতের পরিমাপে তাদের জন্য কী পরিমাণ দুর্ভোগ হবে তা কল্পনাই করা যায় না। কবি বলেছেন:

ويحصدُ الزَّارعُونَ ما زرعوا
    

غدًا توفّى النفوسُ ما عَمِلت

وإن أساءُوا، فبئْسَما صنعوا
    

إِن أحسنوا أحسنوا لأنفسِهمُ

আগামী দিন সব আত্মাকে তাদের কৃতফল দেওয়া হবে। শস্য বপনকারী যা বপন করেছে তা সে তুলবে। তারা যদি নিজের জন্য উত্তম কাজ করে থাকে তাহলে সে উত্তমই পাবে। আর যদি নিজের জন্য খারাপ কিছু করে থাকে তাহলে কতই না নিকৃষ্ট কাজ সে করল।

সৎপূর্বসূরীগণ কোনো কাজ পরিপূর্ণ ও নিঁখুতভাবে করতে কঠোর পরিশ্রম করতেন। কাজটি সুন্দরভাবে করার পরে তা কবুল করানোর জন্য তৎপর ছিলেন এবং আল্লাহ কর্তৃক ফেরত দেওয়ার ভয় করতেন। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, তোমরা আমল করার সাথে আমল কবুল হওয়ার ব্যাপারেও খুব গুরুত্ববান হও। কেননা তাকওয়া ব্যতীত আমল কবুল হয় না।[7] তোমরা কি শুনো নি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلۡمُتَّقِينَ٢٧﴾ [المائ‍دة: ٢٧]

“আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের থেকে গ্রহণ করেন”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ২৭]

ফুদালাহ রহ. বলেন, আল্লাহ আমার থেকে এক শস্যদানা পরিমাণ আমল কবুল করা আমার কাছে দুনিয়া ও এর মধ্যকার সবকিছুর চেয়ে উত্তম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلۡمُتَّقِينَ٢٧﴾ [المائ‍دة: ٢٧]

“আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের থেকে গ্রহণ করেন।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ২৭]

মালিক ইবন দীনার রহ. বলেন, আমল কবুল না হওয়ার ভয় আমল করার চেয়ে অধিক কঠিন।

‘আতা আস-সুলামী রহ. বলেন, ভালো আমল কবুল না হওয়ার মারাত্মক ভয় হচ্ছে তা একমাত্র আল্লাহর জন্য না হওয়া।

আব্দুল আযীয ইবন আবী রাওয়াদ রহ. বলেন, আমি তাদেরকে (আলিমদেরকে) এমন পেয়েছি যে তারা সৎ আমলের ব্যাপারে কঠোর পরিশ্রম করত। যখন তারা ভালো কাজটি সম্পন্ন করত তখন তারা চিন্তা করত আমলটি কি কবুল হলো নাকি কবুল হয় নি?

কোনো এক সৎপূর্বসূরী বলেন, তারা (আলিমগণ) ছয় মাস রমযান মাস পাওয়ার জন্য দো‘আ করতেন আর ছয় মাস তাদের আমল কবুল হওয়ার জন্য দো‘আ করতেন।

কোনো এক সৎপূর্বসূরীর চেহারায় ঈদের দিন দুশ্চিন্তা দেখা গেল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এটি তো আনন্দ ও খুশির দিন। তিনি বললেন, তোমরা ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি তো আল্লাহর বান্দা মাত্র। তিনি আমাকে আমল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমার আমল কবুল হয়েছে কি হয় নি তা তো আমি জানি না।

উহাইব রহ. একদল লোককে ঈদের দিন হাসতে দেখে তাদেরকে তিনি বললেন, ঐসব সাওম পালনকারীদের আমল যদি কবুল করা হয় তাহলে তাদের আনন্দ-হাসি আল্লাহর শুকর আদায়কারীদের কাজ নয়। আর যদি তাদের আমল কবুল করা না হয় তাহলে তাদের এ কাজ তো ভীতি-সন্ত্রস্ত লোকদের কাজ নয়। (অর্থাৎ কবুল হলে শুকরিয়া আদায় করা, আর কবুল না হলে কান্নাকাটি করা উচিত, হাসা-হাসি করা নয়)হাসান রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলা রমযানকে বান্দার জন্য প্রতিযোগিতার ময়দান হিসেবে দিয়েছেন। তারা এ মাসে আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতিযোগিতা দিয়ে থাকেন। সুতরাং যারা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে তারা সফলকাম আর যারা পিছিয়ে থাকবে তারা ব্যর্থ ও অকৃতকার্য হবে। তাই যেদিন সৎকর্মশীলকে সফলতার পুরস্কার ও ব্যর্থদেরকে তিরস্কার করা হবে সেদিন (ঈদের দিন) প্রতিযোগী হাসি-তামাশা করবে এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়।

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৮।

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০১৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬০।

[3] সুনান নাসাঈ আল-কুবরা, হাদীস নং ২৫২৩।

[4] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২৭১৩, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন; তবে দুটি ইবারত ব্যতীত। সে দুটি ইবারত হলো (أَوْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ) এবং (وَمَا تَأَخَّرَ)।

[5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩৩।

[6] তিরমিযী, হাদীস নং ২৫৩০, আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[7] হিলইয়াতুল আওলিয়া, ১/৭৫।