দ্বিতীয় অধ্যায় - কা‘বার গেলাফ ও দৃশ্যমান পাথরসমূহ স্পর্শ করার দ্বারা স্বীয় শরীর মোছা

কা‘বা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ঘর, আর তা হচ্ছে দুনিয়ার মধ্যকার সর্বশ্রেষ্ঠ ঘর, আল্লাহ তা‘আলা তাকে মর্যাদাবান ও সম্মানিত করেছেন তা নির্মিত হওয়ার দিন থেকেই। আর মুসলিমগণের মনে-প্রাণে পৃথিবীর সকল আশা-আকাঙ্খার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র আকাঙ্খা ও কামনা হলো তাকে দেখা।

কিন্তু কোনো বস্তুর প্রতি আমাদের ঝোঁক ও ভালোবাসাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ‘কুরআন’ ও ‘সুন্নাহ’-এর মানদণ্ডে, যাতে কোনো রকম অতিরঞ্জন ও অবহেলার আশঙ্কা না থাকে।

একদল লোক অনেক বেশি অতিরঞ্জন করে ফেলেছে, ফলে তারা ‘কাবা’-এর ব্যাপারে অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করে; যার কারণে আমরা তাদেরকে তার গেলাফ ও দৃশ্যমান পাথরসমূহকে স্পর্শ করে স্বীয় শরীর মাসেহ করতে দেখি, তারা এ কাজটি করে বরকত হাসিলের আশায় এবং কল্যাণের ধারায় সিক্ত হওয়ার জন্য।[1]

এমনকি হাজীদের অজ্ঞতার কারণে বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা এমন কিছু ছেঁড়া-কাটা কাপড়ের টুকরা নিয়ে মক্কায় আগমন করে, যা তারা তাদের দেশের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে এবং তারা তাদেরকে শক্তভাবে বলে দিয়েছে যে, তারা যেন তা ‘কা‘বা’ ঘরের দেওয়ালের সাথে স্পর্শ করে, অতঃপর তাদের নিকট তা হাযির করে দেয়।[2]

আর এ কাজটি নিঃসন্দেহে দলীল-প্রমাণবিহীন উদ্ভাবিত এক নতুন বিদ‘আত। কারণ, এ কাজের পক্ষে কোনো দলীল বর্ণিত হয়নি; আর ‘কা‘বা’ ঘরের পাথর ও গেলাফের আলাদা কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হয়নি; আর যদি এ কাজটির মধ্যে কোনো বিশেষ কল্যাণ থাকতো, তাহলে আমাদের পূর্বে সাহাবীগণ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তার দিকে এগিয়ে যেতেন।

এ সব কিছু হলো (বিদ‘আত), যদি এ কাজের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিশ্বাস না করে যে, এসব পাথর ও গেলাফের নিজস্ব কোনো প্রভাব রয়েছে, কিন্তু যদি সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া এসব পাথর ও গেলাফ উপকার ও ক্ষতি করতে পারে, তার কাজটি আল্লাহর নিকট পৌঁছিয়ে দিতে পারে অথবা ‘কা‘বা’ তার জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে, তাহলে নিশ্চিত সে আল্লাহর সাথে শির্ক করলো- একেবারে বড় ধরণের শির্ক, যা তাকে দীন থেকে খারিজ (বহিষ্কার) করে দেবে (না‘উযুবিল্লাহ)।

আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ. বর্ণনা করেন: “বরকত লাভের আশায় ‘মাসজিদে হারাম’-এর সীমানা প্রাচীর অথবা ‘কা‘বা ঘর’ অথবা ‘মাকামে ইবরাহীম’ ইত্যাদি স্পর্শ করাটা বড় শির্ক -এর উপলক্ষসমূহের অন্যতম একটি উপলক্ষ বলে বিবেচিত হবে, বরং তা ছোট শির্ক তো বটেই)।[3]

আর এ অধ্যায়টি আমি শেষ করব আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ‘উসাইমীন রহ. এর দু’টি ফতোয়ার উদ্ধৃতি দেওয়ার মাধ্যমে; আর এ ফতোয়া দু’টি হলো এ বিষয়ে তাঁর নিকট উত্থাপিত দু’টি প্রশ্নের দু’টি জবাব।

[প্রথম ফতোয়া]: প্রশ্নের ভাষ্য:

তাওয়াফের মধ্যে কোনো কোনো মানুষকে কা‘বার দেওয়াল ও গেলাফ, মাকামে ইবরাহীম ও সাধারণ পাথর স্পর্শ করতে দেখা যায়; সুতরাং এ জাতীয় আমল বা কাজের বিধান কী হবে?

উত্তর: “মানুষ এ জাতীয় কাজ করে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল ও তাঁর ইবাদত করার উদ্দেশ্যে; আর এমন প্রতিটি আমল, যা আপনি আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল ও তাঁর ইবাদত করার উদ্দেশ্যে করবেন, অথচ তার সমর্থনে শরী‘আতের কোনো দলীল বা ভিত্তি নেই; তাহলে সে কাজটি বিদ‘আত বলে গণ্য হবে, যার থেকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক ও সাবধান করে বলেছেন:

«إِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ ؛ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ » .

“তোমরা দীনের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা থেকে দূরে থাকবে। কারণ, প্রত্যেকটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।”[4]

আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এমন কোনো হাদীস বর্ণিত হয়নি যে, তিনি ‘আল-হাজার আল-আসওয়াদ’ (الحجر الأسود) ও ‘আর-রুকন আল-ইয়ামানী (الركن اليماني) ছাড়া অন্য কোনো কিছু স্পর্শ করেছেন।

আর তার ওপর ভিত্তি করে মানুষ যখন ‘আল-হাজার আল-আসওয়াদ’ (الحجر الأسود) ও ‘আর-রুকন আল-ইয়ামানী (الركن اليماني) ব্যতীত কা‘বার যে কোনো রুকন অথবা পার্শ্ব স্পর্শ করবে, তখন সে বিদ‘আতকারী বলে বিবেচিত হবে।

তাছাড়া আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা যখন মু‘আবিয়া ইবন আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে কা‘বার উত্তরের রুকনদ্বয়কে স্পর্শ করতে দেখলেন, তখন তিনি তাকে নিষেধ করলেন; তারপর মু‘য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন: বায়তুল্লাহর কোনো কিছুই তো ফেলনা নয়। জবাবে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন আল্লাহর বাণীর কথা:

﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ﴾ [الاحزاب: ٢١]

“অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১] আর আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘ইমানিয়্যাইন রুকনদ্বয়’ (الركنين اليمانيين) তথা ‘রুকনে ইয়ামানী’ ও ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে স্পর্শ করতে দেখেছি, তারপর মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার কথার দিকে ফিরে আসলেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ﴾ [الاحزاب: ٢١]

“অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]

আর কোনো কোনো মানুষ কর্তৃক ‘মাকামে ইবরাহীম’-কে স্পর্শ করার মত কাজটি তো আরও উত্তমভাবেই বিদ‘আত বলে গণ্য হবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ জাতীয় কোনো কিছু বর্ণিত হয় নি যে, তিনি ‘মাকামে ইবরাহীম’-এর কোনো অঞ্চল স্পর্শ করেছেন, আর অনুরূপভাবে একই বিধান প্রযোজ্য হবে ‘যমযম কূপ’ স্পর্শ করা এবং কা‘বার বারান্দা বা উন্মুক্ত গ্যালারীর খুঁটিগুলো স্পর্শ করার ব্যাপারে।

আর এমন প্রত্যেক কাজই বিদ‘আত বলে গণ্য হবে, যা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণিত পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত নয়, আর প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা ও বিপথগামীতা বলে বিবেচিত”।[5]

[দ্বিতীয় ফতোয়া]: প্রশ্নের ভাষ্য:

যারা কা‘বা’র গেলাফ স্পর্শ করে এবং লম্বা দো‘আ করে, তাদের বিধান কী হবে?

উত্তর: “ঐ সব ব্যক্তিবর্গের কর্মকাণ্ডেরও সুন্নাতসম্মত কোনো ভিত্তি নেই এবং তা বিদ‘আত হিসেবে গণ্য, জ্ঞান পিপাসুদের জন্য আবশ্যক হলো তাদেরকে এ বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়া এবং এ কথা বলে দেওয়া যে, এটা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াত ও নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত নয়”।[6]

আর পাথরসমূহকে সম্মান করতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, আর স্পর্শ করার ব্যাপারে কোনো দলীল বর্ণিত হয় নি, আর যদি তাকে কোনো কল্যাণ থাকতো, তাহলে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তা করতেন।

এ অধ্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও দু’টি মাসআলা রয়েছে:

প্রথম মাসআলা: কা‘বা’র (আল্লাহ তাঁর মর্যাদা বাড়িয়ে দিন) গেলাফ খুলে ফেলার পর তার দ্বারা জনগণ কর্তৃক বরকত হাসিল করা: শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম কা‘বা’র গেলাফ দ্বারা বরকত অর্জন করার বিষয়টিকে হারাম বলে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর ফতোয়ার সারকথা হলো এই:

১. যাবতীয় দলীল ও প্রাচীন আসারসূহ প্রমাণ করে যে, কা‘বার পুরাতন গেলাফ খুলে ফেলা হয় এবং তা মক্কাবাসীর মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হয় পোশাক বা এ জাতীয় কোনো কিছু বানানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য, আর তা খুলে ফেলার পর তার জন্য পবিত্রতা ও গৌরবের কোনো কিছু নেই এবং তার দ্বারা বরকত হাসিলেরও কোনো ব্যাপার নেই, আর আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার উপস্থিতিতে তা খুলে ফেলা হলো এবং তা বণ্টন করে দেওয়া হল, অথচ তিনি তার প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেন নি।[7]

২. পূর্ববর্তী সৎব্যক্তিগণের কোনো একজন ব্যক্তিও কা‘বার পুরাতন গেলাফের দ্বারা বরকত অর্জনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন নি।

৩. আর যারা তা বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন, তারা শুধু তার দ্বারা অভাবীগণের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য এটা করে থাকেন।

৪. পরবর্তী যুগে তার টুকরাগুলো বিদেশি হাজীগণের নিকট মোটা অংকের টাকায় বিক্রি হতে থাকে তার দ্বারা বরকত হাসিলের জন্য, আর এটা জায়েয নয় এবং এর কারণে তাদেরকে সম্মান করা বৈধ নয়। কেননা তা পাপ ও সীমালংঘনের কাজে সহযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।

৫. আর পুরাতন গেলাফের দ্বারা বরকত অর্জনের জন্য তা কেনা-বেচার মধ্যে শির্কের উপলক্ষ্য বিদ্যমান রয়েছে।

দ্বিতীয় মাসআলা: বৃষ্টির সময়ে কা‘বার পাইপ থেকে পড়া পানি পান করা। আর এ বিষয়টি দৃষ্টিগোচরীভূত ও সর্বজন পরিচিত, আর তা মানুষের অজ্ঞতার কারণে; সুতরাং আমরা সাধারণ জনগণকে বৃষ্টির বর্ষণের সময়ে কা‘বার পাইপ থেকে পড়া পানি পান করার জন্য দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখতে পাই, এমনকি আমি এমন ব্যক্তিকেও দেখেছি, যিনি বৃষ্টির পানি মাটিতে পড়ার পর তার দিকে আসে, অতঃপর তা সংগ্রহ করে, তারপর তা পান করে; আর তাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে আমরা তাদেরকে এমন অবস্থায় পাই যে, তারা বিশ্বাস করে- এ পানিতে বরকত রয়েছে, আর এটা তাদের এ আকীদা-বিশ্বাসের কারণে যে, যে বস্তু কা‘বাকে স্পর্শ করবে, তার মধ্যে বরকত পাওয়া যাবে। আর আমি যদি বরকত অর্জনের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে কা‘বা’র (আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করুন) দেওয়াল চুম্বন করা শরী‘আত সম্মত না হওয়ার কথা বলি, তাহলে আরও উত্তমভাবেই বলার কথা- কাপড়, গেলাফ ও পনির মত যেসব বস্তু তাকে স্পর্শ করে, তার দ্বারা বরকত অর্জনের চিন্তা করা শরী‘আতসম্মত নয়।

>
[1] দেখুন: ‘আল-বিদ‘উ ওয়াল মুহদাছাত ওমা লা আসলা লাহু’: (পৃ. ৩৯৬-৩৯৮); ‘শিফা আস-সুদুর ফী যিয়ারাত আল-মাশাহেদ ওয়াল কুবূর’: (পৃ. ১২৩); ‘আত-তামহীদ লি-শরহে কিতাব আত-তাওহীদ’: (পৃ. ৬০৯)।

[2] আর এ কাজটি খুবই পরিচিত ও স্বচক্ষে দেখা।

[3] এ তথ্যটি মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ. এর নাতি তার থেকে ‘আত-তামহীদ লি-শরহে কিতাব আত-তাওহীদ’ নামক গ্রন্থে (পৃ. ৬১০) বর্ণনা করেছেন, আরও দেখুন: ফাতাওয়া ইবন ইবরাহীম: (১/১০১-১০৩)।

[4] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে ‘ইরবাদ ইবন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ১৭১৪৪; ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ৪২; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ৪৬০৭; তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীস নং ২৬৭৬।

[5] দেখুন: ‘আল-বিদ‘উ ওয়াল মুহদাছাত ওমা লা আসলা লাহু’: (পৃ. ৩৯৬-৩৯৭)।

[6] দেখুন: ‘আল-বিদ‘উ ওয়াল মুহদাছাত ওমা লা আসলা লাহু’: (পৃ. ৩৯৭-৩৯৮)।

[7] দেখুন: আযরাকী, ‘আখবারু মাক্কা’: (১/২৫৮-২৬২)।