নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি, আর আমাদের প্রবৃত্তির যাবতীয় ক্ষতি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। সুতরাং আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই, আর যাকে তিনি পথহারা করেন, তাকে পথ প্রদর্শনকারীও কেউ নেই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِۦ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٠٢﴾ [ال عمران: ١٠٢]

“হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোনোভাবেই মারা যেও না।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০২]

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا ٗا كَثِيرٗا وَنِسَآءٗۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيۡكُمۡ رَقِيبٗا ١ ﴾ [النساء: ١]

“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন, আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে নিজ নিজ হক দাবী কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারেও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর পর্যবেক্ষক।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১]

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَقُولُواْ قَوۡلٗا سَدِيدٗا ٧٠ يُصۡلِحۡ لَكُمۡ أَعۡمَٰلَكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۗ وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ فَازَ فَوۡزًا عَظِيمًا ٧١﴾ [الاحزاب: ٧٠، ٧١]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সঠিক কথা বল; তাহলে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭০, ৭১]

অতঃপর.......

হজ ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম একটি রুকন, আর তাতে রয়েছে সকল শ্রেণির ইবাদতের সমাবেশ- আন্তরিক ইবাদত, শারীরিক ইবাদত ও আর্থিক ইবাদত।

আর তা হলো ইসলামী মহাসমাবেশ, তাতে মুসলিমগণের পারস্পরিক সংঘবদ্ধতা ও ঐক্যের বিষয়টি ফুটে উঠে, আরও ফুটে উঠে অন্যদের ওপর তাদের গৌরবের দিকটি এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রতি তাদের বিনয় ও নম্রতার বিষয়টি।

আর মুসলিম সম্প্রদায়ের আলিম সমাজ হজের মতো এ মহান রুকনটির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন এবং তারা এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। যাঁরা ‘মক্কা’, মদীনা মুনাওয়ারা এবং ‘মানাসিক বা হজ’ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে[1] গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত। যেমন,

প্রথমত: এমন গ্রন্থপঞ্জি, যা ফিকহী বিধিবিধানের সাথে সম্পর্কিত; আর তার সংখ্যা অনেক এবং এগুলো এত বেশি প্রসিদ্ধ যে, তার দৃষ্টান্ত পেশ করার কোনো প্রয়োজন নেই।

দ্বিতীয়ত: এমন গ্রন্থপঞ্জি, যা (হজের প্রতি) উৎসাহ দান ও তার ফযীলতের সাথে সম্পর্কিত এবং তার সংখ্যাও অনেক। যেমন,

১. ‘মুছীরুল ‘আযম আস-সাকিন ইলা আশরাফিল আমাকেন’ (مثير العزم الساكن إلى أشرف الأماكن ), ইমাম আবদুর রাহমান ইবন ‘আলী ইবন আল-জাওযী (৫১০-৫৯৭ হি.)।

২. আল-ইতহাফ ফী ফাদলিত তাওয়াফ (الإتحاف في فضل الطواف), আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ‘ইল্লান সিদ্দিকী (৯৯৬-১০৫৭ হি.)।

৩. ‘আল-আহাদীস আল-ওয়ারেদা ফী ফাদায়েলিল মাদীনা জাম‘আন ওয়া দিরাসাতান’ (الأحاديث الواردة في فضائل المدينة جمعاً و دراسة), ড. সালেহ ইবন হামিদ আর-রেফা‘য়ী।

তৃতীয়ত: এমন গ্রন্থপঞ্জি, যা ভ্রমণ, হাজীদের পথ ও হারামাইনের ভৌগলিক বিবরণের সাথে সম্পর্কিত, আর এ জাতীয় গ্রন্থের সংখ্যা সীমিত। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

১. ‘কিতাবুল মানাসিক ওয়া আমাকিনু তুরুকিল হজ ও মা‘আলিমুল জাযীরাহ’ (كتاب المناسك وأماكن طرق الحج ومعالم الجزيرة), ইমাম ইবরাহীম ইবন ইসহাক আল-হারবী (১৯৮-২৮৫ হি.)।

২. ‘আদ-দুরার আল-ফারায়েদ আল-মুনায্যামা ফী আখবার আলহজ ওয়া ত্বরিকু মাক্কাতা আল-মু‘আয্যামা’ (الدرر الفرائد المنظمة في أخبار الحاج وطريق مكةَ المعظمة ), ‘আল্লামা আবদুল কাদের ইবন মুহাম্মাদ আল-জাযায়েরী (৯১১-৯৭৭ হি.)।

৩. গবেষক প্রফেসর ‘আতেক ইবন গিয়াছ আল-বিলাদী’র গ্রন্থসমূহ এবং এ গ্রন্থগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ‘আওদিয়াতু মাক্কা’ (أودية مكة ), ‘‘আলা ত্বরিক আল-হিজরাত’ (على طريق الهجرة), ‘মা‘আলেম মাক্কাতা আত-তারিখিয়্যা ওয়াল আছারিয়্যা’ (معالم مكة التاريخية والأثرية), ‘মু‘জাম আল-মা‘আলিম আল-জুগরাফিয়্যা ফিস্ সীরাত আন-নবওয়িয়্যাহ’ (معجم المعالم الجغرافية في السيرة النبويَّة )।

চতুর্থত: এমন গ্রন্থপঞ্জি, যা ‘হারামাইন শরীফাইন’-এর ইতিহাস সম্পর্কিত, এ জাতীয় গ্রন্থের সংখ্যা অনেক। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুই একটি নিম্নরূপ:

১. ‘তারিখ আল-মাদীনা’ (تاريخ المدينة), ইমাম উমার ইবন শাব্বাহ (১৭৩-২৬২ হি.)।

২. ‘ইতহাফুল ওয়ারা বি আখবারে উম্মিল কুরা’ (إتحاف الورى بأخبار أم القرى ), ইমাম আন-নাজম উমার ইবন ফাহাদ আল-কুরাশী (৮১২-৮৮৫ হি.)।

আর ইসলামে এ রুকনটির এত গুরুত্ব সত্ত্বেও আমরা মুসলিমদের মধ্যে এমন ব্যক্তিকে দেখতে পাই যে এ বিধিবিধানগুলো জানা ও বুঝার ব্যাপারে চেষ্টা করে না, আর চেষ্টা করে না হজের পবিত্র ভূমিতে, মক্কায় ও মদীনায় কোন কোন কাজ করা বৈধ সে ব্যাপারে ব্যাপকভাবে জানতে ও বুঝতে, যাতে সে হজের কাজসমূহ পালনে শরী‘আত বিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত না হয়ে যায়; আর শরী‘আত পরিপন্থী বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো আকীদা-বিশ্বাসগত ভুল-ভ্রান্তি, যা ঈমানে ঘাটতি সৃষ্টি করে অথবা তাকে বিলকুল ঈমানহারা করে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ ঐ ব্যক্তির কথা বলা যায়, যে ব্যক্তি সম্মানিত বাইতুল্লাহতে হজ করার ইচ্ছা করে, অথচ সে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের নিকট সাহায্য চায় অথবা প্রার্থনা (দো‘আ) করে।

আর এ বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য করেই আমি অত্যন্ত জরুরি মনে করেছি যে, আমি এ ভুল-ভ্রান্তিগুলো পর্যবেক্ষণ করব এবং তার শরী‘আতসম্মত বিধান বর্ণনা করব। হাজীগণ এবং তাদের পরিচালনা ও তত্ত্ববধানের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারী বা বেসরকারী এজেন্সী বা কর্তৃপক্ষকে তা অবহিত ও সতর্ক করার উদ্দেশ্যে, যাতে সেসব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা যায়, যা তাদের হজকে ত্রুটিপূর্ণ বা বাতিল করার মত অবস্থায় নিপতিত করে কিংবা তাতে আঘাত করে, আর এটাই হলো এ গবেষণা-কর্মটি সম্পাদনের মূল লক্ষ্য।

তারপর আমার জানা মতে, ইসলামী গ্রন্থাগারসমূহ বিশেষ করে হজ সংশ্লিষ্ট আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তি প্রসঙ্গে লিখিত স্বতন্ত্র গ্রন্থশূণ্যতার দুর্বলতায় আক্রান্ত, যদিও তা ফিকহ শাস্ত্রের বৃহদাকার গ্রন্থসমূহ ও আকায়েদ বিষয়ক গ্রন্থসমূহের কোনো কোনো গ্রন্থে এবং কোনো কোনো ছোট্ট প্রবন্ধে বিক্ষিপ্ত আকারে আলোচিত হয়েছে; আর আমি এমন কাউকে দেখিনি, যিনি তা পৃথকভাবে স্বতন্ত্র আলোচনায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

এ গবেষণার চিন্তাকে আমার কাছে যে বিষয়টি জোরদার করেছে, তা আমি তার মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ! আর তা হলো- এমন কিছু বিষয় সংকলন করা, যা বিশেষভাবে হজের সাথে আকীদাগত বিরোধের সাথে সুনির্দিষ্ট, আর পাশাপাশি তার বিধান বর্ণনা করা এবং সাথে সাথে এ আকীদাগত বিরোধের সাথে কার্যত জড়িত ব্যক্তির বিধান বর্ণনা করা।

আর আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট আবেদন করছি, যাতে আমি এ বিষয়টিকে সাজাতে, তার বিক্ষিপ্ত বিষয়গুলোকে একত্র করতে এবং তার মাসয়ালাসমূহকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হই এমন এক পদ্ধতিতে, যা ইনশাআল্লাহ আকীদা-বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করার কাজে অংশগ্রহণ করবে, যে আকীদা-বিশ্বাসের সাথে অনেক দোষত্রুটি ও ভেজাল মিশে একাকার হয়ে গেছে।

والحمدُ لله رب العالمين

(আর সকল প্রশংসা জগতসমূহের রব আল্লাহ তা‘আলার জন্য নিবেদিত)!!

>
[1] অর্থাৎ ঐসব মাসআলা থেকে যা তার (হজের) সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে সম্পর্কিত, যেসব মাসআলা হজ বিষয়ে আলোচনার সময় আলোচিত হয়। যেমন, উমরা আদায়ের জন্য মক্কা যিয়ারত, ‘মসজিদে নববী’ যিয়ারত, যমযমের পানি পান, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর যিয়ারত ইত্যাদি ধরণের আলোচনা বা পরিচ্ছেদ, যা হজ অধ্যায়ের মধ্যে আলোচনা করা হয়, তার জায়গা মত আমি তার বিবরণ পেশ করব ইনশাআল্লাহ।