কুরআন ও হাদীছের আলোকে হজ্জ, উমরাহ ও মদীনা যিয়ারত নবম অধ্যায় শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ১ টি

নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি কুরবানীর দিন সকাল বেলা জামরাহ আকাবায়, যা মক্কার দিকে মিনার শেষ প্রামেত্ম অবস্থিত, (যাকে বড় জামরাও বলা হয়) তাতে সাতটি পাথর মারতেন। আর প্রত্যেকটি পাথর মারার সময় তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করতেন। যেই কংকরগুলি বুঁটের দানার চেয়ে সামান্য বড় হত।

সুনানে নাসাঈতে ফাযল বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি মুযদালিফা থেকে মিনা যাওয়ার পথে নাবী (সা.)-এর বাহনের পেছনে বসেছিলেন। তিনি বলেন, নাবী (সা.) মুহস্সির নামক স্থানে (হস্তি বাহিনী ধ্বংস হওয়ার জায়গা) অবতরণ করেন এবং তিনি লোকজনকে সম্বোধন করে বলেন: তোমরা ক্ষুদ্র কংকর দ্বারা জামরায় পাথর নিক্ষেপ করবে। ফাযল (রা.) বলেন, নাবী (সা.) নিজ হাত দ্বারা ইংগিত করছিলেন যে, যেমন মানুষ হাতের আঙ্গুলে ধরে ক্ষুদ্র কংকর নিক্ষেপ করে।

আর মুসনাদে আহমাদে আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সা.) আমাকে জামরাহ আকাবায় পাথর নিক্ষেপের দিন সকালে বলেন, আমার জন্য কংকর কুড়িয়ে নিয়ে আসো। তিনি বলেন, তখন আমি তাঁর জন্য ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এসে তাঁর হাতে দিলাম। তখন তিনি হাত উপরে করে বললেন:

إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِالْغُلُوِّ فِي الدِّينِ

তোমরা বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাক; কারণ, তোমাদের পূর্বের লোকেরা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়েছে।[1]

উম্মে সুলায়মান (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নাবী (সা.)-কে কুরবানীর দিন মিনার উপত্যকা হতে জামরাহ্ আকাবাতে পাথর নিক্ষেপ করতে দেখেছি। তিনি সে সময় লোকদেরকে বলছিলেন: হে মানুষ! তোমরা পরস্পরকে খুন করিও না। আর যখন তোমরা জামরায় পাথর নিক্ষেপ করবে তখন ঠিকরের মত (ছোট) কংকর নিক্ষেপ করবে।[2]

আর ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি মিনার নিকটবর্তী জামরাকে (ছোট জামরা) সাতটি কংকর মারতেন এবং প্রত্যেকটি কংকর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করতেন। তারপর সামনে এগিয়ে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দু‘আ করেন। অতঃপর জামরাহ উসতায় (মধ্যবর্তী জামরা) পাথর নিক্ষেপ করে বাম দিকে এগিয়ে যান এবং সেখানে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দু‘আ করেন। তারপর উপত্যকা হতে জাম্রা আকাবায় (বড় জামরা) পাথর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সেখানে (দু‘আর জন্য) না থেমে ফিরে আসেন। অতঃপর বলেন, এভাবেই নাবী (সা.)-কে একাজগুলি সম্পাদন করতে দেখেছি।[3]

আর ইমাম আহমাদ ও ইমাম আবূ দাউদ (রহঃ) আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, প্রিয় নাবী (সা.) বলেছেন:

إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبِالصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْيُ الْجِمَارِ لِإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّهِ

নিশ্চয়ই বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সাঈ এবং জামরাগুলিতে কংকর নিক্ষেপ করা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিধি-বদ্ধ করা হয়েছে।[4]

এ ক্ষেত্রে কতিপয় হাজীগণ যে সব ভুল করে থাকে:

১। তাদের ভুল ধারণা যে, কংকরগুলি মুযদালিফা থেকেই নিতে হবে। তাই তারা দশই যিলহাজ্জর রাত্রে পাথর কুড়ায় এবং মিনার দিনগুলিতে তা সঙ্গে রাখায় নিজেকে কষ্ট দিয়ে থাকে। এমন কি দেখা যায় যে, তাদের কারো একটি পাথর যদি হারিয়ে যায় তাহলে তাতে বড়ই কষ্ট হয় এবং নিজ সঙ্গীদের সাথে মুযদলিফা থেকে কুড়ানো অতিরিক্ত পাথর থাকলে তাদের নিকট পাথর ভিক্ষা চায়। অথচ ইহা স্পষ্ট যে নাবী (সা.) থেকে এর কোন প্রমাণ নেই। বরং নাবী (সা.) বাহনে চেপে থেমে থাকা অবস্থায় আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.)-কে ঈদের দিন সকালে কংকর কুড়াতে বলেন। যাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি জামরার নিকট থেমে থাকা অবস্থায় এই নির্দেশ দেন। কারণ, নাবী (সা.) থেকে এর কোন প্রমাণ নেই যে, তিনি মুযদালিফা থেকে রওনা হওয়ার পর জামরা পৌঁছার পূর্বে কোথাও থেমেছেন। আরো একটি যুক্তি হচ্ছে যে, পাথরের প্রয়োজন জামরাতে এসেই হয়েছে। সুতরাং নাবী (সা.) তার পূর্বে পাথর কুড়াতে বলতে পারেন না, যাতে কোন লাভ নেই, বরং মুযদালিফা থেকে অনর্থক রাস্তায় বোঝা বয়ে নিয়ে আসতে হবে।

২। অনেক হাজীদের ভ্রান্ত ধারণা যে, তারা জামরায় পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে শয়তানকে পাথর মারে। এজন্যে তারা জামরাগুলিকে শয়তান বলে আখ্যায়িত করে। তাই তাদের বলতে শুনা যায় যে, আমরা বড় শয়তানকে পাথর মেরেছি বা ছোট শয়তানকে পাথর মেরেছি কিংবা বড় জামরাকে পাথর মারলে তারা অনেকে বলে যে, আমরা শয়তানের বাপকে পাথর মেরেছি। এধরণের অনেক কথায় তারা বলে থাকে, যা হজ্জের স্থানসমূহ ও কার্যাবলী সম্পর্কে বলা সমিচীন নয়। আরো দেখবেন যে, তারা পাথর মারার সময় তাদের ভ্রান্ত ধারণায় এ জমরাসমূহকে শয়তান মনে করে বড়ই কঠোরতা, নিষ্ঠুরতা, চিৎকার ও গালাগালি করে থাকে। বরং এমনও লোক দেখেছি যে, জামরার উপর চড়ে বড়ই ক্রোধ ও আবেগের সাথে জুতো-স্যান্ডেল ও বড় বড় পাথর দ্বারা পিটাচ্ছে এবং তার উপর লোকদের মারা কংকর পড়তে আছে, তবুও তার রাগ-গোস্সা ঠান্ডাও হচ্ছে না এবং তারা এ আচরণও ছাড়ছে না। আর লোকেরা তার চারপার্শ্বে অট্ট হাঁসী হাঁসছে। মনে হচ্ছে যেন এক নাটকের দৃশ্য। এ দৃশ্য জামরায় পুল তৈরী হওয়ার এবং তার পিলার উঁচু করার পূর্বে দেখেছি। আর এসমস্ত ঘটনার কারণ হচ্ছে, তাদের বদ আকীদা যে, হাজীরা শয়তানকে পাথর মারে। অথচ ইহা এক ভিত্তিহীন কথা। আর পূর্বে জামরায় পাথর মারার তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছেন যে, তা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে বিধি-বদ্ধ করা হয়েছে। এজন্যই নাবী (সা.) প্রত্যেকটি পাথর নিক্ষেপ করার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন।

৩। অনেক হাজীরা জামরাতে বড় বড় পাথর, জুতো, স্যান্ডেল এবং লকড়ি মারে। ইহা একটি বড় ভুল, যা নাবী (সা.) তাঁর উম্মাতকে নিজ নির্দেশ ও আমল দ্বারা যে শরিয়াতী দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তার পরিপন্থী। কারণ, তিনি ছোট ছোট ঠিকরের মত কংকর দ্বারা নিজেও জামরাতে রামী করেছেন এবং নিজ উম্মাতকেও তারই নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকে সতর্ক করেছেন। আর এ মারাত্মক ভুলের একমাত্র কারণ যা আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, তাদের ধারণা যে, তারা না কি শয়তানকে পাথর মারে।

৪। তাদের আর একটি ভুল হচ্ছে যে, তারা অনেকে জামরাতে যাওয়ার সময় বড় গরম মেযাজ ও নিষ্ঠুরতার সাথে এগিয়ে যায়, তাদের মধ্যে আল্লাহর ইবাদাতে কোন বিনয়ও থাকে না এবং আল্লাহর বান্দাহদের প্রতি কোন দয়ার আচরণও করে না। আর অন্যান্য হাজীদের কষ্ট দেয় এবং নানা রকমের গালিগালাজ করে। ফলে ইহা নাবী (সা.)-এর আদর্শ এবং ইসলামের আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে ইবাদাত না হয়ে মারপীট ও গালিগালাজের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।

তাই মুসনাদে আহমাদে কুদামা বিন আব্দুল্লাহ বিন আম্মার (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আমি নাবী (সা.)-কে কুরবানীর দিন হলুদবর্ণ উষ্ট্রীতে চেপে জামরাহ আকাবায় (বড় জামরা) পাথর মারতে দেখেছি। সেই সময় না কারো সাথে মারপীট, না কাউকে তাড়ানো আর না রাস্তা ছাড়ো রাস্তা ছাড়ো বলে কোন হৈ চৈ।[5]

৫। অনেক হাজীদের আরো একটি ভুল হচ্ছে যে, তারা তাশরীকের দিনগুলিতে (১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্জ) প্রথম ও দ্বিতীয় জামরায় কংকর নিক্ষেপের পরে সেখানে দু‘আ করে না। অথচ নাবী (সা.) এ দুই জায়গায় পাথর মারার পর কিবলামুখী হয়ে দু’হাত তুলে দীর্ঘক্ষণ দু‘আ করতেন। অনেক হাজীদের এ দু‘আর জন্য অবস্থানকে পরিত্যাগ করার কারণ হচ্ছে, সুন্নাত সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা তাড়াহুড়া করে দায়সাড়া ইবাদাত করা।

তাই কতই না ভাল হতো যদি হাজীগণ হাজ্জ করার পূর্বে হাজ্জের বিধি-বিধান শিখে মহান আল্লাহর ইবাদাত জ্ঞান সহকারে সম্পাদন করতো এবং তাতে নাবী (সা.)-এর সুন্নাতের বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হত। দুনিয়ার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন দেশের ভ্রমণ করে তাহলে দেখা যায় যে, সেখানে ভালভাবে পৌঁছার জন্য সেই দেশের রাস্তা-পথ সম্পর্কে খুটি-নাটি জিজ্ঞেস করে। তাহলে যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির এবং তাঁর জান্নাতের পথে চলতে চায়, তার কেমন সতর্কতা অবলম্বণ করা উচিত? তাহলে গন্তব্য স্থানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে এপথে চলার পূর্বে সে সম্পর্কে ভালভাবে জেনে নেয়া তার জন্য কি উচিৎ নয়?

৬। আরো একটি ভুল হচ্ছে, তাদের অনেকে সাতটি পাথর এক মুষ্টিতে নিয়ে একবারেই মেরে দেয়। ইহা বড় মারাত্মক ভুল। কারণ, আলিমগণ বলেছেন যে, একসাথে একাধিক পাথর মারলে তা একটি বলে গণ্য হবে। আর মনে রাখবেন যে, নাবী (সা.)-এর সুন্নাত মুতাবেক এক একটি করে পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।

৭। জামরায় কংকর মারার সময় বাড়তি কিছু দু‘আ পাঠ করা, যা নাবী (সা.) থেকে মোটেই প্রমাণিত নয়। যেমন তারা অনেকে বানোয়াট দু‘আ বলে,

‘আল্লাহুম্মা ইজ্‌আলহা রিযান লিররাহমান, ওয়া গাযাবান লিশশায়তান’

অনেকে এ বিদআতী দু‘আ পড়ে কিন্তু নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত তাকবীর ছেড়ে দেয়। অথচ বাড়তি বা ঘাটতি না করে নাবী (সা.) থেকে বর্ণিত তাকবীরেই খ্যান্ত করা আবশ্যক।

৮। আরো একটি ভুল হচ্ছে, জামরায় পাথর নিজ হাতে মারার ক্ষেত্রে অনেকের অবহেলা করা। তারা নিজে কংকর মারতে সক্ষম হলেও অপর ব্যক্তিকে উকীল বানিয়ে ভীড়ের অবস্থায় কংকর মারার কষ্ট থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়। অথচ ইহা মহান আল্লাহর এ বাণীর পরিপন্থী, যাতে তিনি হাজ্জ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন:

وَأَتِمُّواْ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلّهِ

তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হাজ্জ ও উমরা সম্পূর্ণ কর।[6] তাই কষ্ট ও ক্লেশ বরদাশ্ত করে কংকর নিক্ষেপ করায় সক্ষম ব্যক্তির নিজ হাতে কংকর মারা আবশ্যক। কারণ, হাজ্জ এক প্রকারের জিহাদ, যাতে কষ্ট-ক্লেশ হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই হাজীগণ যেন আল্লাহকে ভয় করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী স্বয়ং নিজেই যথাসাধ্য হজ্জের কার্যাবলী সম্পাদন করেন।

>
[1]. মুসনাদ আহমাদ ৩২৪৮ ও নাসাঈ ৩০৫৭।

[2]. মুসনাদ আহমাদ

[3]. সহীহ বুখারী ১৭৫২।

[4]. যঈফ: মুসনাদ আহমাদ ২৪৩৫১।

[5]. তিরমিযী, হাদীসটিকে তিনি হাসান ও সহীহ বলেছেন

[6]. সূরা বাক্বারা ২ঃ ১৯৬