কুরআন ও হাদীছের আলোকে হজ্জ, উমরাহ ও মদীনা যিয়ারত প্রথম অধ্যায় শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ১ টি
সফরের কতিপয় আদব-কায়দা এবং বিধি-বিধান (في السفر وشيء من آدابه وأحكامه)

সফরের সংজ্ঞা: পরিবার ও জন্মভূমী ত্যাগের নাম হচ্ছে সফর।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: সফর অনেক রকমের উদ্দেশ্যে হতে পারে, সে উদ্দেশ্য দ্বীনের (ইসলামের) জন্যও হতে পারে এবং দুনিয়াবী সংক্রান্তও হতে পারে।

সফরের হুকুম বা বিধান: যে উদ্দেশ্যে সফর করা হয় তার যা হুকুম (বিধান) তাই হবে সেই সফরের হুকুম।

  • অতএব সফর যদি কোন ইবাদাতের উদ্দেশ্যে শুরু করা হয় তবে উক্ত সফরও ইবাদাত বলে গণ্য হবে। যেমন, হাজ্জ, উমরা ও জিহাদের সফর।
  • আর যদি সফর কোন জায়েয (বৈধ) কাজের উদ্দেশ্যে শুরু করা হয় তবে উক্ত সফরও জায়েয বলে গণ্য হবে। যেমন, বৈধ ব্যবসার উদ্দেশ্যে সফর করা।
  • পক্ষান্তরে যদি কোন হারাম কাজের উদ্দেশ্যে সফর করা হয় তাহলে সফরের হুকুমও (বিধান) হারাম হবে। যেমন, কোন পাপ কাজ বা ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সফর করা।

আর যে ব্যক্তি হাজ্জ বা অন্য কোন ইবাদাতের উদ্দেশ্যে সফর করবে তার জন্য নিম্নের বিষয়সমূহের প্রতি গুরুত্বারোপ করা আবশ্যক:

১। মহান আল্লাহর জন্য নিয়্যাতকে বিশুদ্ধ/নিখুঁত করা:

আর তা এভাবে যে, সর্বাবস্থায় আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের সৎ উদ্দেশ্য রাখবে। যাতে করে তার যাবতীয় কথা, কাজ এবং খরচ-খরচা তার জন্য মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের উপায় হতে পারে। তার নেকী বৃদ্ধি পাবে, গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে এবং তার মর্যাদা সুউচ্চ হবে।

নাবী (মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন:

وَإِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ بِهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ

তুমি যে কোন খরচে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর তাহলে তাতে তোমাকে তার নেকী দেয়া হবে, এমন কি যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে তাতেও নেকী রয়েছে (ছহীহ বুখারী হা/১২৯৫, ছহীহ মুসলিম হা/১৬২৮)।

২। আল্লাহ যেসব সৎ কাজ ফরয করেছেন তা পালন করার এবং যে সব কথা ও কাজ হারাম করেছেন তা হতে বিরত থাকার জন্য আগ্রহী হওয়া।

  • সুতরাং যথা সময়ে জামা‘আত সহকারে পাঁচ ওয়াক্ত সলাত কায়েম করায়, নিজ সফর সঙ্গীদের কল্যাণ কামনায়, সৎ কাজের উপদেশ দানে ও অন্যায় কাজে বাধা দানে এবং কৌশলের সাথে ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে আহবান করায় যত্নবান হবে।
  • অনুরূপ হারাম কথা ও হারাম কাজ হতে বিরত থাকায় তৎপর হবে। সুতরাং মিথ্যা, গীবত (পরনিন্দা), চুগোলখোরী, প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও অন্যান্য আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণের কাজ থেকে বেঁচে থাকবে।

৩। উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হবে। যেমন: দৈহিক শ্রম, জ্ঞান ও অর্থ দ্বারা দানশীলতার প্রমাণ পেশ করবে।

  • তাই সাহায্য-সহযোগিতার মুখাপেক্ষী ব্যক্তিকে সাহায্য করবে,
  • জ্ঞানপিপাষু ও শিক্ষার মুখাপেক্ষী ব্যক্তিকে জ্ঞান দান করবে এবং
  • নিজ ধন-সম্পদ নিজ প্রয়োজনে এবং মুসলিম ভাইদের প্রয়োজনে ব্যয় করে দানশীলতার বাস্তব রূপ দান করবে।
  • আর সফরে বের হওয়ার পূর্বে কিছুটা বেশী করে টাকা-পয়সা এবং সফর সম্বল নিয়ে নেয়া উচিৎ; কারণ, হঠাৎ তার প্রয়োজন হতে পারে অথবা অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
  • আর সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবসময় যেন আপনি হাঁসিমুখে থাকেন, মনে উদারতা রাখেন, সন্তুষ্ট চিত্তে সময় কাটান, নিজ সাথী-সঙ্গীদেরকে খুশী রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং আপনি যেন তাদেরকে ভালবাসেন যাতে করে তারাও আপনাকে ভালবাসে। আর যদি সাথী-সঙ্গীদের পক্ষ হতে আপনার সাথে কোন রকম দুর্ব্যবহার করা হয় বা আপনার মতের উল্টো কাজ হয় তাহলে তাতে ধৈর্য ধারণ করা এবং ভাল পন্থায় তার সমাধান করা আবশ্যক। যাতে করে আপনি তাদের মাঝে মান সম্মান নিয়ে চলতে পারেন এবং তাদের মন জয় করতে সক্ষম হন।

৪। সফরের শুরুতে ও সফরকালীন যে সব দু‘আ-যিকির পাঠ করা নাবী (সা.) হতে প্রমাণিত, তার প্রতি আমল করবেন।

  • যার একটি হচ্ছে যানবাহনে পা রেখে (بِسْمِ الله) বিসমিল্লাহ পাঠ করবে।
  • যানবাহনে ভালভাবে বসে আল্লাহ পাকের নিয়ামত স্মরণ করবে যে, তিনি এ বাহন আমার জন্য সহজলভ্য করেছেন। অতঃপর নিম্নোক্ত দু‘আটি পাঠ করবে:

اللهُ أكْبَر، اللهُ أكْبَر، اللهُ أكْبَر، سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ ، وَإنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ . اللّهُمَّ إنا نسألكَ في سفرنا هذا البرّ والتَّقوى ، ومنَ العملِ ما ترضى ، اللَّهُمَّ هَوِّن عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا ، وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَهُ . اللَّهُمَّ أنْتَ الصَّاحِبُ في السَّفَرِ ، والخَلِيفَةُ في الأهْلِ . اللَّهُمَّ إنِّي أعُوذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ ، وَكَآبَةِ المَنْظَرِ وَسُوءِ المُنْقَلَبِ في المالِ وَالأَهْلِ

[আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, সুবহা-নাল্লাযী সাখখারা লানা হাযা, ওয়ামা কুন্না লাহু মুক্বরিনীন, ওয়া ইন্না ইলা রব্বিনা লামুন ক্ব-লিবূন। আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্আলুকা ফী সাফারিনা হাযাল বিররা ওয়াত্তাক্বওয়া, ওয়া মিনাল আমালি মা তারযা, আল্লাহুম্মা হাওয়িন আলাইনা সাফারানা হাযা, ওয়াত্‌য়ি আন্না বু’দাহু, আল্লাহুম্মা আন্তাস্ সাহিবু ফিস্‌সাফারি, ওয়াল খলীফাতু ফিল আহলি। আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিন ওয়া-সাইস্ সাফারি, ওয়া কাআ-বাতিল মানযারি, ওয়া সুইল মুনক্বালাবি ফিল মালি ওয়াল আহ্‌ল]

আল্লাহ সর্বাধিক মহান, আল্লাহ সর্বাধিক মহান, আল্লাহ সর্বাধিক মহান, আমি পবিত্রতা ঘোষনা করি তাঁর যিনি, এগুলোকে আমাদের (ব্যবহারের) জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন, অথচ আমরা এগুলোকে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না। আর আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের দিকে ফিরে যেতে হবে। হে আল্লাহ! আমরা আমাদের এই সফরে আপনার নিকট সৎ কর্ম ও পাপমূক্ত জীবন কামনা করি এবং এমন কাজ-কর্ম কামনা করি যাতে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। হে আল্লাহ! আমাদের জন্য এই সফরকে সহজ করে দাও এবং তার দূরত্ব সঙ্কুচিত করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি সফরের সঙ্গী এবং পরিবারে স্থলাভিসিক্ত। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট সফরের কষ্ট হতে, খারাপ দৃশ্য দর্শন হতে এবং ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজনের অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে আশ্রয় গ্রহণ করছি (ছহীহ মুসলিম হা/১৩৪২, ছহীহ: আবূ দাউদ হা/২৫৯৯, মুসনাদে আহমাদ হা/৬৩৭৪।)।

  • আর কোন উঁচু জায়গায় উঠার সময় তাকবীর (اَللهُ أَكْبَرُ আল্লাহু আকবার) পাঠ করবে এবং কোন নীচু জায়গায় অবতরণের সময় তাসবীহ (سُبْحَانَ اللهِ সুবহানাল্লাহ) পাঠ করবেন (ছহীহ বুখারী হা/২৯৯৩, সুনানে দারিমী হা/২৭১৬, সুনানুল কুবরা বাইহাকী হা/১০৩৬)।
  • আর কোন স্থানে অবস্থানের সময় বলবে:

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

[আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত্ তা-ম্মা-তি মিন শার্‌রি মা খলাক্বা]

আমি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ বাণী দ্বারা আশ্রয় গ্রহণ করছি তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট হতে (ছহীহ মুসলিম হা/২৭০৮, সুনানে দারিমী হা/২৭২২, ইবনে মাজাহ হা/৩৫৪৭, তিরমিযী হা/৩৪৩৭)।

এ দু‘আ পাঠ করলে অন্যত্র না যাওয়া পর্যন্ত কোন কিছু তাকে ক্ষতি করতে পারবে না।