গুনাহ মাফের উপায় প্রথম অধ্যায় : গুনাহ পরিচিতি শাহাদাৎ হুসাইন খান ফয়সাল (রহ.) ১ টি

দুনিয়ার প্রত্যেকটি শিশুই ফিতরাত বা স্বভাব-ধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। আবার মানুষ মাত্রই কোন না কোনভাবে কখনো না কখনো প্রবৃত্তির তাড়নায় বা শয়তানের ধোঁকায় ভুল-ত্রুটি, গুনাহ-খাতা করে বসে; তা সে গুনাহ ছোট হোক বা বড় হোক, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, জেনে হোক বা না জেনে হোক। শয়তান আল্লাহর নিকট প্রতিজ্ঞা করেই দুনিয়ায় এসেছে যে, সে আদমসন্তানকে আল্লাহর সরল পথ থেকে বিপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করবেই। যা আল্লাহ তা‘আলা এভাবে বর্ণনা করেছেন,

قَالَ أَنْظِرْنِىْ إِلٰى يَوْمِ يُبْعَثُوْنَ 14- قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِيْنَ -15 قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِىْ لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيْمَ 16- ثُمَّ لَآتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِيْنَ 17

‘‘সে (শয়তান) বলল, ‘সেদিন (ক্বিয়ামাত) পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন, যেদিন তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে’। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত’। সে বলল, ‘যেহেতু আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন (সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন), সে কারণে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আপনার সোজা পথে বসে থাকব। ‘তারপর অবশ্যই তাদের নিকট উপস্থিত হব তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান দিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’।’’[1]

তাই তো দেখা যায় অধিকাংশ মানুষই জীবনের কখনো না কখনো শয়তানের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে গুনাহ অর্জন করে।

গুনাহ করাটা মানুষের জন্য স্বাভাবিক। যেমনটা আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

كُلُّ بَنِي آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ

‘‘প্রত্যেক আদম সন্তানই চরম গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে তাওবাকারীগণ।’’[2]

মু’মিন ব্যক্তি গুনাহকে মনে করে পাহাড়ের মত, যার নিচে সে বসে আছে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি গুনাহকে মনে করে মাছির মত, যা তার নাকের ডগায় বসে উড়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَرٰى ذُنُوبَه كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَرٰى ذُنُوبَه كَذُبَابٍ مَرَّ عَلٰى أَنْفِه

‘‘ঈমানদার ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে এত বড় মনে করে, যেন সে একটা পাহাড়ের নীচে বসা আছে, আর সে আশংকা করছে যে, কখন যেন পাহাড়টা তার উপর ধসে পড়বে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে মাছির মত মনে করে, যা তার নাকের উপর দিয়ে চলে যায়।’’[3]

গুনাহ করাটা যেহেতু মানুষের জন্য স্বাভাবিক সেহেতু গুনাহ হয়ে যেতেই পারে। মানুষ যদি গুনাহ না করতো তাহলে আল্লাহ তাদের বদলে অন্য কোন জাতিকে সৃষ্টি করতেন, যারা গুনাহ করতো এবং পরক্ষণেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতো। এ কথাই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন এভাবে,

وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِه لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللهُ بِكُمْ وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ فَيَسْتَغْفِرُونَ اللهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ

‘‘সেই স্বত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা যদি গুনাহ না করতে তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে বিলীন করে দিয়ে নতুন এমন এক জাতিকে সৃষ্টি করতেন যারা গুনাহ করতো আবার পরক্ষণেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতো। তারপর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন।’’[4]

উল্লেখ্য যে, এই হাদীসের উদ্দেশ্য কখনই পাপের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা বা উৎসাহ দেয়া নয়; বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর অসীম ক্ষমার ইচ্ছা ও অপার দয়ার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং আল্লাহর কাছে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করার অভ্যাস গড়ে তোলার তাকিদ দেয়া। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, বান্দার গুনাহ হয়ে গেলে সে যেন অহংকার করে বা লজ্জায় পরে কিংবা হীনমন্যতায় ভুগে তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত না থাকে; বরং সাথে সাথে যেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

পাপ থেকে ক্ষমা চাওয়ার সময় কান্নাকাটি করলে তা মাফ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ জন্যই গুনাহগারের উচিত গুনাহ হয়ে গেলে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। এই আদেশই নীচের হাদীসে দেয়া হয়েছে :

قَالَ عُقْبَةُ بْنُ عَامِرٍ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ مَا النَّجَاةُ قَالَ أَمْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ وَابْكِ عَلٰى خَطِيئَتِكَ

‘উক্ববাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) বলেছেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! মুক্তির উপায় কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: ‘‘তুমি নিজের জিহবাকে আয়ত্তে রাখ, নিজের ঘরে পড়ে থেকে নিজের পাপের জন্য কান্না কর’’।[5]

জীবন চলার পথে শয়তানের কুমন্ত্রণায় কখনো গুনাহ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এমন অবস্থায় একজন মুমিনের কর্তব্য হলো আল্লাহর কাছে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া, তাওবাহ্ করা এবং ‘আমলে সালেহ (সৎকর্ম) করতে থাকা।

স্বাভাবিকভাবে গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ও তাওবাহ্ করা উচিত। আবূ উমামাহ্ (রাঃ) থেকে একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

إِنَّ صَاحِبَ الشِّمَالِ لِيَرْفَعُ الْقَلَمَ سِتَّ سَاعَاتٍ عَنِ الْعَبْدِ الْمُسْلِمِ الْمُخْطِئِ أَوِ الْمُسِيءِ، فَإِنْ نَدِمَ وَاسْتَغْفَرَ اللهَ مِنْهَا أَلْقَاهَا، وَإِلا كُتِبَتْ وَاحِدَةً

‘‘বামপাশের ফেরেশতা গুনাহকারী মুসলিম বান্দার গুনাহ লেখার পূর্বে ছয় ঘণ্টা (একটি নির্ধারিত সময়) কলম তুলে রাখেন (গুনাহ লেখেন না)। (এই সময়ের মধ্যে) গুনাহকারী ব্যক্তি যদি (তার গুনাহের কারণে) লজ্জিত হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে ফেরেশতা তা না লিখে ছুঁড়ে ফেলে দেন। কিন্তু (এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই যদি গুনাহকারী লজ্জিত হয়ে) ক্ষমা প্রার্থনা না করে তাহলে তার ‘আমলনামায় একটি গুনাহ লেখা হয়।’’[6]

ক্ষমা চাইতে বা তাওবাহ্ করতে দেরি করা মারাত্মক অন্যায় ও ভুল। কারণ কখন যে মৃত্যু এসে যাবে তা আমরা কেউ জানি না। তাই প্রথমবার গুনাহ করে শয়তানকে খুশি করলেও আল্লাহ ইস্তিগফার ও তাওবার সুযোগ দেয়ার পরও তা না করে দ্বিতীয়বার শয়তানকে খুশি করা কোন মুসলিমের জন্য কখনো উচিত নয়। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত গুনাহ হয়ে যাওয়ার পরপরই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, তাওবাহ্ করা ও অন্যান্য সুন্নাহ্সম্মত ‘আমল করার মাধ্যমে কৃত গুনাহসমূহ মাফ করিয়ে নেয়া।

কুরআন ও হাদীসে গুনাহ মাফের জন্য ইস্তিগফার ও তাওবার পাশাপাশি আরও কিছু ‘আমল বর্ণিত হয়েছে যেগুলো করলে অনেক গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা সে ‘আমলগুলো না জানার কারণে এবং না করার কারণে আমাদের গুনাহগুলো মাফ করাতে পারি না। অথচ সেগুলো খুবই সহজ ‘আমল। এই ‘আমলগুলো করলে আমাদের গুনাহগুলো মাফ হয়ে যেতে পারে, ইনশা-আল্লা-হ। সেদিকে দৃষ্টি রেখে সকল গুনাহগারের জন্য এই বইয়ে শরীয়ত অনুযায়ী গুনাহ মাফের বেশকিছু পদ্ধতি ও ‘আমল বর্ণনা করা হয়েছে।

[1]. সূরা আল আ‘রাফ ০৭ : ১৪-১৭।

[2]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ২৪৯৯, সুনান ইবনু মাজাহ : ৪২৫১, হাদীসটি হাসান।

[3]. সহীহুল বুখারী : ৬৩০৮।

[4]. সহীহ মুসলিম : ৭১৪১।

[5]. মুসনাদ আহমাদ : ২২২৩৫; সুনান আত্ তিরমিযী : ২৪০৬; মিশকাত : ৪৮৩৭, হাদীসটি সহীহ।

[6]. আল মু‘জামুল কাবীর : ৭৭৬৫, হাদীসটির সদন সহীহ, সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সহীহাহ্ : ১২০৯।