আর আমরা লাওহে মাহফুযে ঈমান রাখি, আরও ঈমান রাখি কলমের উপর। আর যা আল্লাহ লাওহে মাহফুযে লিখে রেখেছেন তার সবকিছুতেই আমরা বিশ্বাস করি।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَنُؤْمِنُ بِاللَّوْحِ وَالْقَلَمِ، وَبِجَمِيعِ مَا فِيهِ قَدْ رُقِمَ

আর আমরা লাওহে মাহফুযে ঈমান রাখি, আরও ঈমান রাখি কলমের উপর। আর যা আল্লাহ লাওহে মাহফুযে লিখে রেখেছেন তার সবকিছুতেই আমরা বিশ্বাস করি।

.............................................................

ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيدٌ فِي لَوْحٍ مَّحْفُوظٍ) ‘‘বরং এ কুরআন উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ’’ (সূরা বুরুজ: ২১-২২)।

হাফেয আবুল কাসেম আত্ তাবারানী স্বীয় সনদে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন,

إن الله خلق لوحا محفوظا من درة بيضاء دفتاه ياقوتة حمراء، قلمه نور وعرضه ما بين السماء والأرض ينظر فيه كل يوم ستين وثلاثمائة نظرة، يخلق بكل نظرة ويحيي ويميت، ويعز ويذل، ويفعل ما يشاء»

আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের মধ্য হতে অন্যতম একটি সৃষ্টি হচ্ছে লাওহে মাহ্ফুয। সাদা মুক্তা দিয়ে তিনি এটি তৈরী করেছেন। তার উভয় পার্শ্ব তৈরী করা হয়েছে লাল রং এর হিরা দিয়ে। কলমটি হচ্ছে নূরের তৈরী, কালিও নূরের। উহার প্রশস্ততা হচ্ছে আসমান-যমীনের মধ্যকার প্রশস্ততার সমপরিমাণ। আল্লাহ্ তা‘আলা তাতে দৈনিক তিনশ ষাট বার দৃষ্টি দেন। প্রত্যেকবার দৃষ্টি দেয়ার সময় কাউকে জীবিত রাখেন (কোনো না কোনো বস্তু সৃষ্টি করেন), কারো মৃত্যু ঘটান, কাউকে সম্মানিত করেন, কাউকে অপমানিত করেন এবং তিনি যা চান তাই করেন’’।[1]

লাওহে মাহফুয বলতে সে বিশাল সৃষ্টি উদ্দেশ্য, যাতে তিনি সমস্ত সৃষ্টির তাকদীর লিখে রেখেছেন। এখানে কলম বলতে সেই কলম উদ্দেশ্য, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং তা দ্বারা লাওহে মাহফুযে সৃষ্টিকূলের তাকদীর লিখেছেন। সুনানে আবু দাউদে উবাদাহ বিন সামেত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,

إن أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فقَالَ لَهُ: اكْتُبْ قَالَ: يا رب مَا ذا أَكْتُبُ؟ قَالَ: اكْتُبْ مَقادير كل شيئ حتى تقوم الساعة

আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে কলমকে আদেশ করলেন যে, লিখো। কলম বললো, হে আমার রব! আমি কী লিখবো? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিসের তাকদীর লিখে ফেলো’’।[2]

[1]. হাদীছটি যঈফ, দেখুন: শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহর তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২৭০।

[2]. হাদীছটি ছহীহ। দেখুন: শাইখ আলবানী রাহিমাহুল্লাহুর তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২৭১।
কলম সর্বপ্রথম সৃষ্টি কি না এ ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ

কলম সর্বপ্রথম সৃষ্টি না কি আরশ সর্বপ্রথম সৃষ্টি এ ব্যাপারে আলেমগণ থেকে দু’টি কথা বর্ণিত হয়েছে। হাফেয আবুল আলা আল-হামাদানী এ মত দু’টি উল্লেখ করেছেন। এ মত দু’টির মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হচ্ছে কলমের পূর্বে আরশ সৃষ্টি করা হয়েছে।

ছহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة قال: وعرشه على الماء

‘‘আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সমস্ত সৃষ্টির তাকদীর লিপিবদ্ধ করেছেন। তখন তার আরশ ছিল পানির উপর’’।[1]

এখানে সুষ্পষ্টরূপে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আরশ সৃষ্টির পর তাকদীর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আর কলম সৃষ্টি করার সময় তাকদীর লিখা হয়েছে। উবাদাহ বিন সামেত রাদ্বিয়াল্লাহুর হাদীছ দ্বারা এটি সাব্যস্ত।

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ ‘‘আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন...’’ পুরো হাদীছ মিলে বাক্য মাত্র একটি হতে পারে আবার দু’টিও হতে পারে। বাক্য যদি একটি হয়, তাহলে অর্থ হবে আল্লাহ তা‘আলা কলম সৃষ্টি করে তাকে প্রথম আদেশ দিলেন, লিখো।

এ হাদীছের শব্দ থেকে বুঝা যায়। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ এখানে اولَ শব্দের লাম বর্ণের উপর যবর এবং القلم শব্দের মীম বর্ণের উপর যবর দিয়ে পড়া থেকে বুঝা যায় বাক্য মাত্র একটি। আর যদি বাক্য দু’টি হয়, তাহলে এখানে اولَ শব্দের লাম বর্ণের উপর পেশ এবং القلم শব্দের মীম বর্ণের উপরও পেশদিয়ে পড়তে হবে। এতে করে অর্থ হবে কলএ প্রথম সৃষ্টি । এতে করে উবাদাহ ইবনে সামেত এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীছের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব হয়। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদীছে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে, তাকদীর সৃষ্টির আগেই আরশ ছিল। আর তাকদীর ও কলম একসাথেই সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে,

«لما خلق الله القلم قال له: اكتب»

‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন কলম সৃষ্টি করলেন, তখন কলমকে বললেন, লিখো’’।[2]

সুতরাং কলএ হলো প্রথম কলম, সর্বোত্তম কলম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কলম। একাধিক মুফাস্সির বলেন, এটি হলো সেই কলম, যার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা সূরা কলমের শুরুতেই শপথ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ن وَالْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ

‘‘নূন, শপথ কলমের এবং লেখকরা যা লিখে চলেছে তার’’। (সূরা কালাম: ১-২)

দ্বিতীয় কলম হলো, অহী লিখার কলম। এর মাধ্যমে নাবী-রসূলদের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর অহী লিখা হয়। এ কলমের ধারকরাই সৃষ্টিজগতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। দুনিয়ার সমস্ত কলম তাদের কলমের সেবক।

মিরাজের রাতে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এত উপরে উঠানো হয়েছিল যে, তিনি কলম দিয়ে অহী লিখার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন। এ কলমগুলো দিয়েই আল্লাহ তা‘আলার ঐসব অহী লিখা হয়, যার মাধ্যমে তিনি সৃষ্টিজগতের সবকিছু পরিচালনা করেন। উর্ধ্বজগৎ ও নিমণণজগতের যাবতীয় বিষয়ের অহী এ কলমগুলো দিয়েই লিখা হয়।[3]

[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৯১।

[2]. ত্ববারানী, মু‘আজুম কাবীর

[3]. পরবর্তীদের মধ্যে ইমাম আলবানী (রহি.) এমতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তারা নিমেণর ছহীহ হাদীছগুলো দিয়ে দলীল গ্রহণ করেছেন। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

إن أول شيء خلقه الله تعالى القلم وأمره أن يكتب كل شيء يكون

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম যে জিনিসটি সৃষ্টি করেছেন, তা হচ্ছে কলম। অতঃপর কলমকে কিয়ামত পর্যন্ত যা হবে তা লিখতে বললেন’’। {(আবু ইয়ালা (১/১২৬) আল-আসমা ওয়াস সিফাত লিল-বায়হাকী ২৭১), সিলসিলা সাহীহা, হাদীছ নং- ১৩৩)} তিনি আরো বলেন,

«إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ»

‘‘আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে বললেন, লিখো। কলম বলল, হে আমার প্রতিপালক! কী লিখব? আল্লাহ বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী প্রতিটি বস্তুর তাকদীর লিখো’’। (দেখুন: আবু দাউদ, তিরমিজী, বায়হাকী এবং অন্যান্য) মালেকী মাযহাবের বিখ্যাত আলেম ইবনুল আরাবী বলেন, قبل القلم لم يكن شيء إلا هو سبحانه কলমের পূর্বে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। (দেখুন আরেযাতুল আহওয়াযী) অপর পক্ষে আরেক দল আলেমের মতে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর আরশ। আল্লামা ইবনে তাইমীয়া এবং অন্যান্য আলেম থেকে এই মত পাওয়া যায়। তাদের দলীল হচ্ছে, ইমরান বিন হুসাইন থেকে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَىْءٌ غَيْرُهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ ، وَكَتَبَ فِى الذِّكْرِ كُلَّ شَىْءٍ وَخَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ»

আদিতে একমাত্র আল্লাহ-ই ছিলেন। তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার আরশ ছিল পানির উপর। তারপর তিনি প্রত্যেক জিনিস লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করলেন এবং তিনি আসমান ও যমিন সৃষ্টি করলেন। (বুখারী, হাদীছ নং- ৩১৯১) উপরের হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করে আবার কেউ কেউ পানি সর্বপ্রথম সৃষ্টি বলে মত প্রকাশ করেছেন। এটিই সর্বাধিক শক্তিশালী মত। কারণ এ ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট হাদীছ হলো, আবু রাযীন বলেন, আমি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম,

«أَيْنَ كَانَ رَبُّنَا قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ خَلْقَهُ قَالَ كَانَ فِي عَمَاءٍ مَا تَحْتَهُ هَوَاءٌ وَمَا فَوْقَهُ هَوَاءٌ وَخلق عرشهُ عَلَى الْمَاءِ»

সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করার পূর্বে আমাদের রব কোথায় ছিলেন? তিনি বললেন, বাদলের উপর ছিলেন। যার উপর-নীচে কোনো বায়ু ছিল না। অতঃপর তিনি পানির উপর আরশ সৃষ্টি করেছেন। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, ثم خلق عرشه على الماء ‘‘অতঃপর তিনি তার আরশকে পানির উপর সৃষ্টি করেছেন। (আহমাদ ২৬/১০৮) উপরোক্ত হাদীছকে ইমাম তাবারী, তিরমিযী, ইমাম যাহাবী ও ইমাম ইবনে তাইমীয়া বিশুদ্ধ বলেছেন। (আল্লাহই অধিক অবগত রয়েছেন)।

প্রথম পর্যায়ের কতিপয় মাখলুক বা সৃষ্টি: بعض الأمثلة من أوائل المخلوقات

এ কথা সত্য যে, আরশ, কুরসী, লাওহে মাহফুয, পানি, আসমান, ফেরেশতা, জিন ইত্যাদি প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। মানুষ কোনো ক্রমেই উপরোক্ত সৃষ্টিসমূহের পূর্বে সৃষ্টি হয়নি। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নন। কলমও প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টি। তবে আমরা যে কলম দিয়ে লেখি সেই কলম সর্বপ্রথম সৃষ্টি নয়; বরং যে কলম দিয়ে লাওহে মাহফুয লেখা হয়েছে সেটিই সর্বপ্রথম সৃষ্টি। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বপ্রথম সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল না থাকায় তা মুসলিমের আকীদাহ হতে পারে না। তাই উপরোক্ত হাদীছগুলো এবং অন্যান্য সহীহ হাদীছের শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরী। ইমাম মালেক (রহি.) বলেন,

«ما منا من أحد إلا يؤخذ من قوله أو يرد عليه إلا صاحب هذا القبر ويشير إلى قبر النبي صلى الله عليه وسلم»

আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সকল কথাই গ্রহণ করা হবে অর্থাৎ আমাদের কারো কথা গ্রহণ করা যেতে পারে আবার প্রত্যাখ্যানও করা যেতে পারে। তবে এই কবরের অধিবাসী ব্যতীত। এই কথা বলে তিনি নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবরের দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে