‘আর এটাই হচ্ছে ঈমানের দৃঢ়তা, মারেফতের মূলবস্তু এবং আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও রুবুবিয়াত সম্পর্কে স্বীকৃতি দান। যেমন আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে ঘোষণা করেছেন, তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে যথাযথ অনুপাত অনুসারে পরিমিতি প্রদান করেছেন। (সূরা আল ফুরকান ২৫:২) আল্লাহ রাববুল আলামীন অন্যত্র বলেছেন, ‘‘আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত’ (সূরা আল আহযাব ৩৩:৩৮)

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَذَلِكَ مِنْ عَقْدِ الْإِيمَانِ وَأُصُولِ الْمَعْرِفَةِ وَالِاعْتِرَافِ بِتَوْحِيدِ اللَّهِ تَعَالَى وَرُبُوبِيَّتِهِ، كَمَا قَالَ تَعَالَى فِي كِتَابِهِ: (وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا). وَقَالَ تَعَالَى: (وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا) [الْأَحْزَابِ: 38]

‘‘আর এটাই হচ্ছে ঈমানের দৃঢ়তা, মারেফতের মূলবস্তু এবং আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও রুবুবিয়াত সম্পর্কে স্বীকৃতি দান। যেমন আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে ঘোষণা করেছেন, তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে যথাযথ অনুপাত অনুসারে পরিমিতি প্রদান করেছেন। (সূরা আল ফুরকান ২৫:২) আল্লাহ রাববুল আলামীন অন্যত্র বলেছেন, ‘‘আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩:৩৮)

......................................................................

ব্যাখ্যা: এখানে তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন এবং সবকিছু সৃষ্টি করার পূর্বেই সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার ইলম-জ্ঞান থাকার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ঈমান সম্পর্কে প্রশ্নকারীর জবাবে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

(أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ)

‘‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তার ফেরেস্তাদের উপর (৩) তার কিতাব সমূহের উপর (৪) তার রসূলদের উপর (৫) আখেরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) তাকদীরের ভালো-মন্দের উপর’’।[1]

হাদীছের শেষাংশে এসেছে, নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে উমার! তুমি কি জানো প্রশ্নকারী কে? উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আল্লাহ এবং তার রসূলই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তিনি হলেন জিবরীল। তিনি তোমাদের কাছে এসেছিলেন তোমাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য’’।[2]

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও রুবুবিয়াত সম্পর্কে স্বীকৃতি দানের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সিফাতসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন না করলে তাওহীদের প্রতি কারো ঈমান এবং আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াতের প্রতি কারো স্বীকৃতি দান পরিপূর্ণ হবে না। যে ব্যক্তি বিশ্বাস করলো যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো স্রষ্টা আছে সে শির্ক করলো। সুতরাং যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, তার প্রত্যেকটি কর্মের স্রষ্টা সে নিজেই তার অবস্থা কী হতে পারে? এ জন্যই কাদারীয়ারা এ উম্মতের অগ্নিপূজক। এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলো সুনানের কিতাবসমূহে রয়েছে। ইমাম আবু দাউদ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, কাদারীয়ারা এ উম্মতের অগ্নিপূজক।[3] তারা যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তাদেরকে দেখতে যেয়ো না। আর তারা যদি মৃত্যু বরণ করে, তাদের জানাযায় শরীক হয়ো না।[4]

ইমাম আবু দাউদ রহিমাহুল্লাহ হুযায়ফা বিন ইয়ামান থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই অগ্নিপূজক রয়েছে। এ উম্মতের অগ্নিপূজক হলো ঐসব লোক, যারা বলে তাকদীর বলতে কিছু নেই। এদের কেউ মারা গেলে তার জানাযা পড়তে যেয়ো না। এদের কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যেয়ো না। এরা দাজ্জালের বাহিনী। আল্লাহ তা‘আলা এদেরকে দাজ্জালের সাথে মিলিয়ে দিবেন।[5]

ইমাম আবু দাউদ রহিমাহুল্লাহ উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কাদারীয়াদের সাথে বসো না এবং তাদেরকে আগে সালাম দিয়ো না।[6]

ইমাম তিরমিযী আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বনী আদমের দুই শ্রেণীর লোকদের জন্য ইসলামের কোনো অংশ নেই। এরা হলো মুরজিয়া ও কাদারীয়া।[7] তবে কাদারীয়াদের ব্যাপারে বর্ণিত মারফু হাদীছগুলো যঈফ। কিন্তু তাদের ব্যাপারে মাওকুফ হিসাবে বর্ণিত হাদীছগুলো ছহীহ।

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, তাকদীরের প্রতি ঈমান বান্দার তাওহীদকে সুশৃঙ্খল করে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাওহীদের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে, কিন্তু তাকদীরকে মিথ্যায়ন করবে, তার তাওহীদ ছুটে যাবে।[8] কেননা তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আল্লাহ তা‘আলার অনাদি-অবিনশ্বর ও চিরন্তন ইলমের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং তিনি তার কালাম ও সৃষ্টিসমূহের তাকদীর লিখার মাধ্যমে যেই ইলম প্রকাশ করেছেন তার প্রতি ঈমান আনয়নের নামান্তর।

মুশরিক, বেদ্বীন, দার্শনিক এবং আরো অনেকেই মুতাকাল্লিমীনদের বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে। যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে অবগত নয়, তারাও বিভ্রান্ত হয়েছে। এ সবকিছুই তাকদীর অস্বীকার করার মধ্যে শামিল। কাদারীয়ারা সকল বিষয়ের উপর আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা থাকার কথা অস্বীকার করে। তারা মনে করে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের কর্মসমূহ সৃষ্টি করেন না। বান্দাদের কাজ-কর্মকে তারা আল্লাহর ক্ষমতা ও সৃষ্টি থেকে বের করে দিয়েছে।তাকদীরের বিষয়টি কুরআন, সুন্নাহ এবং উম্মতের ইজমার দলীল দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। যারা তাকদীরকে অস্বীকার করে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ঐক্যমতে তারাই ভ্রান্ত কাদারীয়া। কাদরীয়াদের নিন্দায় ছাহাবী এবং তাবেঈদের থেকে যেসব কথা এসেছে, তা দ্বারা এসব লোকই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তাকদীরকে অস্বীকারকারী বিদ‘আতী লোক উদ্দেশ্য। ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে যখন বলা হলো, এক শ্রেণীর লোক রয়েছে, যারা বলে তাকদীর বলতে কিছু নেই। সবকিছুই নতুনভাবে হয়। আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কোনো কাজই পূর্বে নির্ধারণ করেননি। ইবনে উমার বললেন, তাদেরকে বলে দাও যে, আমি তাদের থেকে মুক্ত। তারাও আমাদের থেকে মুক্ত। অর্থাৎ তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

[1]. ছহীহ মুসলিম ৮, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।

[2]. ছহীহ মুসলিম ৮, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।

[3]. অগ্নিপূজকরা দু’স্রষ্টায় বিশ্বাসী। তাদের মতে কল্যাণের স্রষ্টা একজন এবং অকল্যাণের স্রষ্টা অন্যজন। এই উম্মতের কাদারীয়ারা যেহেতু বান্দাকে তার কর্মের স্রষ্টা মনে করে, তাই তাদেরকে অগ্নিপূজকের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

[4]. হাদীছের সনদ দুর্বল। তবে অনেক সনদে হাদীছটি বর্ণিত হওয়ার কারণে শক্তিশালী হয়েছে। সে হিসাবে হাদিছটি হাসান। দেখুন ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহর তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং ২৮৪।

[5]. হাদীছের সনদ দুর্বল। দেখুন: ইমাম আলবানী রাহিমাহুল্লাহুর তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া টিকা নং- ২৮৫।

[6]. হাদীছের সনদ দুর্বল। দেখুন, ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহর তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২৮৬।

[7]. হাদীছের সনদ দুর্বল, দেখুন, শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহর তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া টিকা নং- ২৮৭। তবে ইমাম তিরমিযী হাদীছের সনদকে হাসান বলেছেন।

[8]. যঈফ, দেখুন, শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহর টিকাসহ শারহুল আকীদাহ আত্-ত্বহাবীয়া, টিকা নং- ২৮৮।