তিনি স্বীয় জ্ঞানে সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করেছেন।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, (خَلَقَ الْخَلْقَ بِعِلْمِهِ) তিনি স্বীয় জ্ঞানে সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করেছেন।

........................................

ব্যাখ্যা: অর্থাৎ তিনি সৃষ্টিকে অস্তিত্বশীল করেছেন, তৈরী করেছেন এবং উদ্ভাবন করেছেন। خَلَقَ শব্দটি قدر অর্থাৎ নির্ধারণ করা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। الخلق শব্দটি মাসদার হলেও ইহা এখানে المخلوق (সৃজিত বস্তু) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। بعلمه বাক্যাংশটি হাল বা অবস্থা জ্ঞাপক শব্দ হিসাবে নসবের অবস্থানে রয়েছে। মূল বাক্যটি এরূপ, خلقهم عالمابهم অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের সম্পর্কে অবগত থাকা অবস্থায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ

‘‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না? অথচ তিনি সুক্ষ্মদর্শী ও সব বিষয় ভালভাবে অবগত’’। (সূরা মূলক: ১৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُم بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُم بِالنَّهَارِ ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ فِيهِ لِيُقْضَىٰ أَجَلٌ مُّسَمًّى ثُمَّ إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ ثُمَّ يُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ

‘‘গায়েব বা অদৃশ্যের চাবিকাঠি তারই নিকট রয়েছে। তিনি ছাড়া আর কেউ তা অবগত নয়, জল ভাগের সবকিছুই তিনি অবগত রয়েছেন। তার অবগতি ব্যতীত বৃক্ষ হতে একটি পাতাও ঝরে না এবং ভূ-পৃষ্ঠের অন্ধকারে এমন একটি শস্য দানাও নেই, যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন। এমনিভাবে শুষ্ক ও আদ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ‘‘তিনিই রাত্রিকালে তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং দিবসে তোমরা যা কিছু করো তা জানেন। আবার পরদিন তোমাদের সেই কর্মজগতে ফেরত পাঠান, যাতে জীবনের নির্ধারিত সময়কাল পূর্ণ হয়। অবশেষে তারই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি জানিয়ে দেবেন তোমরা কী আমল করছিলে’’। (সূরা আল আন‘আম: ৫৯-৬০)

এ আয়াত দু’টিতে আল্লাহর সিফাতে অবিশ্বাসী মুতাযেলাদের প্রতিবাদ রয়েছে। কেননা তারা আল্লাহর ইলমসহ অন্যান্য সিফাতকে অস্বীকার করে থাকে।

ইমাম শাফেঈর শিষ্য ইমাম আব্দুল আযীয মাক্কী রহিমাহুল্লাহ যখন আল্লাহ তা‘আলার ইলম সম্পর্কে মুতাযেলী আলেম বিশর আল-মুরাইসীকে জিজ্ঞেস করলেন, তখন বিশর বললেন, আমি আল্লাহর ইলম সম্পর্কে এ কথা বলছি যে, তিনি অজ্ঞ নন। উল্লেখ্য খলীফা মামুনের উপস্থিতিতে আব্দুল আযীয আল-মাক্কী এবং বিশর আল-মুরাইসীর মাঝে যেই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে তিনি বিশরকে এ প্রশ্ন করেছিলেন। ইমাম আব্দুল আযীযের অন্যতম কিতাব ‘আলহাইদা’তে এ বিতর্কের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম আব্দুল আযীয আল্লাহর সিফাত ইলম সম্পর্কে প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলেন এবং তার কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বিশর বলেই যাচ্ছিল, আল্লাহ তা‘আলা অজ্ঞ নন। বিশর এ কথা স্বীকার করছিলেন না যে, আল্লাহ তা‘আলার এমন ইলম রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি সবকিছু সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। ইমাম আব্দুল আযীয তখন বললেন, আল্লাহ তা‘আলা থেকে মূর্খতা নাকোচ করা তার প্রশংসার বিশেষণ হতে পারে না। কেননা তুমি যদি কোনো জড় পদার্থের প্রতি ইঙ্গিত করে বলো এটি অজ্ঞ নয়, তাহলে এ কথার মাধ্যমে তার প্রশংসা সাব্যস্ত হয় না এবং এটিও সাব্যস্ত হয় না যে, তার ইলম রয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী-রসূল, ফেরেশতা এবং মুমিন বান্দাদের ইলম রয়েছে বলে তাদের প্রশংসা করেছেন। সুতরাং মুসলিমদের উচিত হলো, আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, তা সাব্যস্ত করা এবং তার নিজের সত্তা থেকে যা নাকোচ করেছেন, তা বিদূরিত করা ও তিনি যা সাব্যস্ত কিংবা নাকোচ করা থেকে বিরত রয়েছেন, তা থেকে বিরত থাকা।

আল্লাহ তা‘আলা সকল বস্তু সম্পর্কে অবশ্যই অবগত রয়েছেন, -এ ব্যাপারে বিবেক-বুদ্ধির দলীল হলো, বিনা ইলমে বস্তুসমূহ সৃষ্টি করা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি স্বীয় ইচ্ছার মাধ্যমে সবকিছু সৃষ্টি করেন। সৃষ্টি করার ইচ্ছা করার জন্য উদ্দিষ্ট বস্তুর আকৃতি সম্পর্কে কল্পনা করা আবশ্যক। উদ্দিষ্ট বস্তু সম্পর্কে এ কল্পনার নাম ইলম। সুতরাং সৃষ্টি করার জন্য ইচ্ছা করা জরুরী। আর ইচ্ছার জন্য ইলম আবশ্যক। একই সঙ্গে সৃষ্টি করার জন্যও ইলম থাকা জরুরী।

এ কথা সকলের জানা আছে যে, সৃষ্টিজগতের মধ্যে এমন এমন বলিষ্ঠ ও সুনিপুণ সৃষ্টি রয়েছে, যা সৃষ্টি করার জন্য ইলম থাকা জরুরী। কেননা সুনিপুণ ও বলিষ্ঠ কাজ ইলম ছাড়া সম্পাদন করা অসম্ভব। এমন সৃষ্টি রয়েছে, যিনি আলেম বা জ্ঞানী। ইলম পূর্ণতার অন্যতম বিশেষণ। সুতরাং স্রষ্টার ইলম না থাকা অসম্ভব। দু’টি পদ্ধতিতে এ কথা সাব্যস্ত করা যেতে পারে। প্রথম পদ্ধতি হলো, আমরা বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা অবশ্যই জানতে পারি যে, স্রষ্টা সৃষ্টির চেয়ে অধিক পরিপূর্ণ এবং যিনি নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল, তিনি অন্যের দ্বারা অস্তিত্বশীল বস্তুর চেয়ে অধিক পরিপূর্ণ। বোধশক্তির দলীলের মাধ্যমে আমরা আরো জানতে পারি যে, আমরা যদি এমন দু’টি সৃষ্টিকে সামনে রাখি, যাদের একটি জ্ঞানী এবং অন্যটি জ্ঞানী নয়, তাহলে আমাদের বিবেচনায় উভয়ের মধ্যে জ্ঞান সম্পন্ন সৃষ্টিটিই হবে অধিক পরিপূর্ণ। সুতরাং স্রষ্টা যদি ইলমের সিফাতে বিশেষিত না হন, তাহলে মাখলুকই খালেকের চেয়ে অধিক পরিপূর্ণ হওয়া আবশ্যক হয়। আর এটি অসম্ভব।

দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো সৃষ্টির মধ্যে যত ইলম রয়েছে তার সবই স্রষ্টার পক্ষ হতে এসেছে। আর এটি অসম্ভব যে, কামালিয়াতের স্রষ্টা ও উদ্ভাবক তা থেকে খালী বা শুণ্য থাকবেন। বরং তিনিই তা দ্বারা বিশেষিত হওয়ার আরো বেশী হকদার। আল্লাহ তা‘আলার জন্যই রয়েছে সর্বোত্তম উদাহরণ। তিনি এবং সৃষ্টি সমান নন। কিয়াসে তামছীলি কিংবা কিয়াসে শুমুলী কোনো দিক থেকেই সৃষ্টি ও স্রষ্টা সমান নয়।[1]

সুতরাং মাখলুকের জন্য কামালিয়াতের যে বিশেষণ সাব্যস্ত সৃষ্টিকর্তা তা দ্বারা বিশেষিত হওয়ার আরো বেশী উপযুক্ত এবং সৃষ্টি অপূর্ণতার যে বিশেষণ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চায়, স্রষ্টা তা থেকে পবিত্র হওয়ার আরো বেশী হকদার।[2]

[1]. কিয়াসে তামছিলী ও কিয়াসে শুমুলীর ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ কিয়াসে তামছিলী এবং যুক্তিবিদগণ তাদের কথা কিয়াসে শুমুলী কথাটি অহরহ ব্যবহার করে থাকেন।

[2]. তবে এর জন্য শর্ত রয়েছে। দলীল দ্বারা কামালিয়াতের সে বিশেষণটি সাব্যস্ত হতে হবে অথবা দলীল দ্বারা অপূর্ণতার সেই বিশেষণটির নাকোচ থাকতে হবে।