সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার ধারণা

জাহমিয়াদের থেকেই এ কথার উৎপত্তি হয়েছে। তারা বলেছে, সূচনাহীন সৃষ্টির অস্তিত্ব এবং তার চিরস্থায়িত্ব অসম্ভব। সৃষ্টির জন্য একটি সূচনা থাকা জরুরী। এমন কোনো সৃষ্টি নেই, যা সূচনাহীন। তাদের মতে এটি অসম্ভব যে, মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা সর্বদাই কর্ম সম্পাদন করা, কথা বলা এবং ইচ্ছা করার বিশেষণে বিশেষিত রয়েছেন; বরং এ গুলোর উপর তিনি ক্ষমতাবানই ছিলেন না। কেননা অসম্ভব কিছু করাও ক্ষমতা রাখাও অসম্ভব!!

তাদের এসব কথা সম্পূর্ণ বাতিল। কারণ এ কথা প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। অথচ তা সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টির অস্তিত্ব না থাকার পর যেহেতু সৃষ্টি হয়েছে, তাই বুঝা গেল, সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি হওয়া মোটেই অসম্ভব ছিল না। যা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, তা সৃষ্টি হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যে কোনো সময় তা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষে ক্রিয়া-কর্ম সম্পাদন করা এবং তার জন্য তা সম্ভব হওয়ার নির্দিষ্ট ও সীমিত কোনো সময় নেই।

সুতরাং নিশ্চিতভাবে জানা গেল যে, সবসময় তার জন্য কাজ-কর্ম করা সম্ভব, বৈধ ও সঠিক। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা সর্বদাই সৃষ্টি করতে ক্ষমতাবান। যখন তিনি কোনো কিছু সৃষ্টি করেননি, তখনো তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম ছিলেন। এতে প্রমাণিত হলো, এমন সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকা সম্ভব, যা শুরু হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু সবসময় সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন, তাই তার পক্ষে অতীতের যে কোনো সময় সৃষ্টি করা সম্ভব। নির্দিষ্ট এমন কোনো সময়সীমা নেই, যেখান থেকেই কেবল তিনি সৃষ্টি করার বিশেষণে বিশেষিত হয়েছেন এবং সৃষ্টি করা শুরু করেছেন।

জাহমিয়া এবং তাদের অনুসারীরা বলেছে, আমরা এ কথা স্বীকার করিনা যে, এমন সৃষ্টি থাকার সম্ভাবনা আছে, যার কোনো সূচনা নেই। তবে আমরা বলি, সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে যে বস্তুর অস্তিত্ব ছিল না, তার কোনো সূচনা না থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা বলে, আমাদের মতে অনাদি সৃষ্টি থাকা অসম্ভব। বরং এ শ্রেণীর সৃষ্টি হওয়া যেমন আবশ্যক এবং তা অনাদি ও সূচনা বিহীন হওয়াও অসম্ভব। তবে নির্দিষ্ট কোনো সময়ে সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক নয়। সৃষ্টির সূচনা হওয়ার পূর্বে তা সৃষ্টি হওয়ার কোনো প্রারম্ভ না থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু একক সৃষ্টিগুলো এর ব্যতিক্রম। এগুলো সৃষ্টির সূচনা অবশ্যই রয়েছে।

তাদেরকে বলা হবে, তোমরা উপরোক্ত কথা বলে থাকো। তবে তোমাদের মতে সৃষ্টির শ্রেণী ও ধরণের জন্য একটি সময়সীমা রয়েছে। কেননা সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি হওয়ার শ্রেণী বিশেষ তৈরী হওয়া অসম্ভব হওয়ার পর সম্ভব হয়েছে। তবে এটি কখন সম্ভব হয়েছে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। অতীতে কোনো একটি সৃষ্টি অস্তিত্বে আসার যে কোনো সময়ই নির্ধারণ করা হোক না কেন, তার পূর্বে আরেকটি সময় সাব্যস্ত করা বৈধ।[1]

সুতরাং সব সময় সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। এমনটি না হলে সৃষ্টির শ্রেণী বিশেষ কোনো কিছু সৃষ্টি হওয়া ছাড়াই অসম্ভব থেকে সম্ভবে পরিবর্তিত হওয়া আবশ্যক।

বুদ্ধিমানদের নিকট এটি জানা বিষয় যে, সৃষ্টি হওয়ার প্রকৃতি, কিংবা সৃষ্ট বস্তুর প্রকৃতি অথবা ক্রিয়া-কর্মের প্রকৃতি অথবা সৃষ্টি করার প্রকৃতি অথবা অনুরূপ বিষয়ের প্রকৃতি অসম্ভব থেকে সম্ভবের দিকে পরিবর্তিত হওয়ার অর্থ হলো বিনা কারণে অসম্ভবকে সম্ভব ও বৈধ করে দেয়ার শামিল। বিবেক-বুদ্ধি সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে যে, ইহা অসম্ভব। সেই সঙ্গে এটি অসম্ভব সত্তাকে সম্ভব সত্তায় পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক করে।

সুতরাং তাদের মতে অসম্ভব সৃষ্টির সত্তা সম্ভাব্য সত্তায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। এ পরিবর্তন নির্দিষ্ট কোনো সময়ের সাথে সীমিত নয়। কেননা অতীতের যে কোনো সময়কে সৃষ্টির সূচনার জন্য নির্ধারণ করা হলে সেই সম্ভাব্য সময়ের পূর্বে আরেকটি সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা বৈধ। এতে আবশ্যক হয় যে সব সময়ই এ পরিবর্তন সম্ভব। এতে আরো আবশ্যক হয় যে, সবসময়ই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করা সম্ভব। সবসময় সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, -এ কথার চেয়ে সবসময়ই অসম্ভব বস্তু সম্ভবে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব বলাই অধিক পরিপূর্ণ। এতে করে তাদের জন্য তাই অধিক আবশ্যক হয়েছে, যা থেকে তারা বাঁচতে চেয়েছিল। কেননা সৃষ্টিজগৎ অস্তিত্বে আসার বিষয়টি বোধগম্য। আর এটিও বোধগম্য যে সবসময়ই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। কিন্তু অসম্ভব বস্তু সম্ভব হওয়া মূলত অসম্ভবই থেকে যায়।[2]

সুতরাং কিভাবে বলা যেতে পারে যে, সবসময়ই অসম্ভব বস্তু সৃষ্টি হচ্ছে? মূলতঃ এ কিতাবটি এ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনার স্থান নয়। যথাস্থানে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।[3]

উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো সৃষ্টির সাধারণ ধারাবাহিকতা কি বিরামহীনভাবে ভবিষ্যৎ ও অতীতের দিকে অব্যাহত? এর কি কোনো সূচনা বা পরিসমাপ্তি নেই? না কি অতীতের দিকে এর একটা সূচনা রয়েছে; কিন্তু ভ্যবিষ্যতের দিকে এর কোনো সময়সীমা নেই? না কি সমাহীন অতীত থেকেই সৃষ্টির ধারাবাহিকতা চলে আসছে এবং ভবিষ্যতের দিকে এর জন্য সময়সীমা নির্ধারিত রয়েছে?

এ মাস‘আলায় মুসলিম কালামশাস্ত্রবিদ এবং অন্যদের তিনটি মত রয়েছে।

(১) সবচেয়ে দুর্বল মত হলো ঐ ব্যক্তির কথা যে বলে অতীত ও ভবিষ্যতের কোনো সময়ই সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা সম্ভব নয়। এটি জাহাম বিন সাফওয়ান এবং ইবনুল হুযাইল আল্লাফের কথা।

(২) ভবিষ্যতে সম্ভব হতে পারে; কিন্তু অতীতে অনাদি সৃষ্টির ধারণা অবৈধ। এটিই অনেক মুতাকাল্লিম এবং তাদের মাযহাবের অনুসারী ফিকাহবিদ ও অন্যদের মত।[4]

(৩) অতীত ও ভবিষ্যৎ উভয় কালেই সৃষ্টির ক্রমধারা অব্যাহত থাকা সম্ভব। মুহাদ্দিছগণ এ কথাই বলেছেন। এটি একটি বিরাট মাস‘আলা। সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা অতীতে সম্ভব ছিল, ভবিষ্যতে সম্ভব নয়, -এ কথা কেউ বলেনি।

সকল ফির্কার অধিকাংশ মানুষ বলে থাকে যে, আল্লাহ ছাড়া যা আছে, তা সবই মাখলুক। এগুলো প্রথমে ছিল না। পরে সৃষ্টি হয়েছে। রসূলদের কথাও তাই। নাবী-রসূলদের অনুসারী মুসলিমগণ, ইহুদী, খৃষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও তাই বলেছে।

বিবেক-বুদ্ধির নিকট এটি একটি জানা বিষয় যে, কর্তার সাথে সাথে সদাসর্বদা কর্মযুক্ত থাকা এবং কাজকর্ম চলতে থাকা অসম্ভব। তবে কর্মসম্পাদন করার ক্ষমতা ও ইচ্ছা সবসময় কর্তার বিশেষণ হিসাবে তার সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে থাকা বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা সমর্থিত। ভবিষ্যতে সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহতভাবে চলতে থাকা এ কথার পরিপন্থী নয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সর্বশেষ, তার পরে আর কিছুই নেই।[5] কারণ আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুই স্বনির্ভর ও স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। জান্নাতের নেয়ামতকে আল্লাহ তা‘আলা অনন্তকাল রাখবেন বলেই তা অনন্তকাল বিদ্যমান থাকবে, কখনো ধ্বংস হবে না। জান্নাতের নেয়ামত ধ্বংসের আওতামুক্ত থাকা প্রমাণ করে না যে, তা আল্লাহর মতই চিরন্তন ও অবিনশ্বর। অনুরূপ অতীতের সবসময়ও সৃষ্টির ধারাবাহিকতা চলতে থাকা এ কথার পরিপন্থী নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম এবং তার পূর্বে আর কিছুই ছিল না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সর্বদা আছেন। সবসময়ই স্বীয় ইচ্ছায় কর্ম সম্পাদনকারী, যা ইচ্ছা, তাই করেন এবং যখন ইচ্ছা কথা বলেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَالَ كَذَٰلِكَ اللَّهُ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ ‘‘এমনটিই হবে। আল্লাহ যা চান তাই করেন’’। (সূরা আলে-ইমরান: ৪০)

অর্থাৎ তোমার বার্ধক্য ও তোমার স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব সত্ত্বেও আল্লাহ তোমাকে পুত্র সন্তান দান করবেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ

‘‘কিন্তু আল্লাহ যা চান, তাই করেন’’। (সূরা বাকারা: ২৫৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ ذُو الْعَرْشِ الْمَجِيدُ

‘‘আরশের মালিক, মর্যাদাবান এবং তিনি যা চান তাই করেন’’। (সূরা বুরুজ: ১৫-১৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِن شَجَرَةٍ أَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِن بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘‘পৃথিবীর সমস্ত বৃক্ষ যদি কলম হয় এবং সমুদ্রের সাথে আরো সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয় তবুও আল্লাহর বাণী লিখা শেষ হবে না’’। (সূরা লুকমান: ২৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا

‘‘হে মুহাম্মাদ! বলো, যদি আমার রবের কথা লেখার জন্য সমুদ্র কালিতে পরিণত হয় তাহলে সেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমার রবের কথা শেষ হবে না। বরং যদি এ পরিমাণ কালি আবারও আনয়ন করি তাহলে তাও যথেষ্ট হবে না’’। (সূরা কাহাফ: ১০৯)[6]

পূর্ণতার যেসব গুণাবলী আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা সম্ভব, তা আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত। তা এমন যে, আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা তাই করেন এবং যা ইচ্ছা বলেন। কোনো কালের সাথে তার কাজ বা কথা সীমিত নয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যে কোনো সময়ের ক্ষেত্রেই এটি সম্ভব। এর বিপরীত কিছু সাব্যস্ত করা হলে আল্লাহর পূর্ণ গুণের পরিপন্থী হবে।

সৃষ্টি করা যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার চিরন্তন ও অনাদি বিশেষণ, তাই তার পূর্ণতম স্তর অনাদি ও সূচনাহীন। প্রত্যেক সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তা‘আলার জন্য তা এভাবে সাব্যস্ত যে, সৃষ্টির কোনো অংশই কোনোভাবেই স্রষ্টার সমপর্যায়ের নয়। অর্থাৎ মূল সৃষ্টি আল্লাহ তা‘আলার মতই অনাদি ও চিরন্তন নয়। একক সৃষ্টিগুলো অনাদি ও সূচনাহীন নয়। বরং তার এমন শুরু ও সূচনা রয়েছে, যেখান থেকে একক সৃষ্টিগুলো অস্তিত্বে এসেছে।

ভবিষ্যতের সবসময় আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকাও তার পূর্ণ গুণের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কর্ম সম্পাদনকারী হওয়া যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতার বিশেষণ, তাই সবসময়ই সৃষ্টি করতে থাকাও পূর্ণতার বিশেষণ।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ বলেছেন, التسلسل (সৃষ্টির ধারাবাহিকতা) কথাটি সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট। কুরআন ও হাদীছে এ শব্দটির নাকচ করা বা সাব্যস্ত করা কোনোটিই করা হয়নি। সুতরাং এ শব্দটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক নয়। তাসালসুল বা সৃষ্টির ধারাবাহিকতা তিন প্রকার।

(১) আবশ্যক,

(২) অসম্ভব এবং

(৩) বৈধ।

সৃষ্টির মধ্যে তাসালসুল বা বিরতিহীনভাবে সৃষ্টির প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা অসম্ভব ও নিষিদ্ধ। এটি এভাবে হতে পারে যে, প্রত্যেকে সৃষ্টিই তার পূর্ববর্তী বস্তুর মাধ্যমে প্রভাব অর্জন করেছে, যা সীমাবদ্ধ নয়।

যে ধারাবাহিকতা আবশ্যক, বিবেক-বুদ্ধি ও শরীয়াতের দলীল দ্বারা তা সাব্যস্ত। স্রষ্টা ও প্রভুর ক্রিয়াসমূহ অতীতে যেভাবে চালু ছিল, ভবিষ্যতেও সেভাবে চলতেই থাকবে। জান্নাতীদের একটি নেয়ামত যখন শেষ হয়ে যাবে, তখনই আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য আরেকটি নেয়ামত তৈরী করবেন। জান্নাতীদের নেয়ামত কখনো শেষ হবে না। এমনি অতীত ও অনাদির দিকেও আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি ধারাবাহিকভাবে চালু ছিল। অতীতে আল্লাহ তা‘আলা যেসব ক্রিয়া-কর্ম সৃষ্টি করেছেন, তার পূর্বে আরেকটি ক্রিয়া ছিল। আল্লাহর কালাম বিশেষণের ক্ষেত্রেও একই কথা। তিনি যখন ইচ্ছা তখনই কথা বলেছেন। নির্দিষ্ট কোনো একটি সময়ে তার কালাম সৃষ্টি হয়নি। এমনি তার বাকিসব কাজ তার হায়াতের জন্য আবশ্যক। অর্থাৎ তিনি যেহেতু চিরজীবন্ত, তাই তার কর্ম বা সৃষ্টি করার ক্ষমতাও চিরবিদ্যমান। কেননা প্রত্যেক জীবিতই সক্রিয়। জীবিত ও মৃতের মধ্যে পার্থক্য হলো ক্রিয়া সম্পাদন করা। জীবিত ব্যক্তি কাজ করতে পারে, মৃত ব্যক্তি তা সম্পাদন করতে পারে না। এ জন্যই সালাফদের অনেকেই বলেছেন, প্রত্যেক জীবন্তই কর্ম সম্পাদনে সক্ষম। উছমান বিন সাঈদ বলেছেন, প্রত্যেক জীবন্তই কর্ম সম্পাদনকারী। আর আমাদের প্রভু কখনোই কর্ম করতে অক্ষম ছিলেন না। তিনি সবসময়ই কথা বলা, ইচ্ছা করা এবং কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম ছিলেন ও থাকবেন।

সৃষ্টির যে ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা বৈধ ও সম্ভব, তা আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির মধ্যে হয়ে থাকে। অনন্তকাল পর্যন্ত ভবিষ্যতে সৃষ্টির ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে। যেহেতু তিনি চিরজীবন্ত, চির সক্ষম, সর্বদাই ইচ্ছা পোষণকারী এবং কথা বলতে সক্ষম, আর এটি যেহেতু তার সত্তার জন্য আবশ্যক, তাই এ বিশেষণগুলোর দাবি হলো আল্লাহ তা‘আলার জন্য সবসময়ই সক্রিয় থাকা সম্ভব। কাজ না করার চেয়ে তা করার মধ্যেই তার অধিক পূর্ণতা রয়েছে। কথা না বলার চেয়ে বলাই তার অধিকতর পূর্ণতার প্রমাণ এবং ইচ্ছা করাই না করার চেয়ে পূর্ণতম। এ বিশ্বাস পোষণ করা আবশ্যক করে না যে, এ সৃষ্টিগুলোও আল্লাহর সাথে সাথে অনাদি এবং সূচনাহীনভাবেই বিদ্যমান। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তার সকল সৃষ্টির পূর্বে রয়েছেন। এমনভাবে তিনি প্রথমে রয়েছেন, যার পূর্বে আর কেউ নেই। প্রত্যেক মাখলুকেরই একটি সূচনা রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার কোনো সূচনা নেই। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া বাকিসবই সৃষ্টি। সৃষ্টি এক সময় ছিল না, পরে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে ধারাবাহিকতা নিষিদ্ধ। অবশ্যই সৃষ্টির একটি পরিসীমা রয়েছে। আল্লাহ পর্যন্ত গিয়ে এ সীমা শেষ হয়।[7]

এ কথা ছাড়া আর যত মত রয়েছে, বিবেক-বুদ্ধির সুস্পষ্ট দলীল সেগুলো বাতিল করে দেয় এবং সেগুলো বাতিল হওয়ারই দাবি রাখে। যারা বিশ্বাস করে আল্লাহ তা‘আলা সবসময় ক্রিয়াশীল তাদের প্রত্যেকেই দু’টি বিষয়ের যে কোনো একটি স্বীকার করতে বাধ্য। এ দু’টি বিষয় স্বীকার করা ব্যতীত আর কোনো পথ নেই। তাকে স্বীকার করতেই হবে যে, সবসময় ক্রিয়া সম্ভব অথবা এটি স্বীকার করতে হবে যে, সবসময়ই বাস্তবে আল্লাহর কাজ-কর্ম সংঘটিত হয়েছে। অন্যথায় তার কথার মধ্যে পারস্পরিক অসংগতি দেখা দিবে। অসংগতিটি এভাবে হবে যে, সে ধারণা করবে যে সবসময় আল্লাহ তা‘আলা কর্ম সম্পাদন করার ক্ষমতা রাখেন, অথচ ক্রিয়া সম্পাদন করা তার সত্তার জন্য অসম্ভব। যদি তিনি তা করার ইচ্ছা করেন, তাহলে উহা অস্তিত্বশীল হয় না; বরং তার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব, অথচ তিনি তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখেন। এটি এমন কথা, যার এক অংশ অন্য অংশের সাথে সাংঘর্ষিক।

উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, শরীয়াত ও বিবেক-বুদ্ধির দলীল প্রমাণ করে যে, আল্লাহ ছাড়া যা আছে, তা সবই মাখলুক-সৃষ্ট। সৃষ্ট বস্তুর অস্তিত্ব ছিল না। পরে অস্তিত্ব লাভ করেছে। আর এ ধারণা করা যে, আল্লাহ তা‘আলা এক সময় কাজশূণ্য ছিলেন, অতঃপর সক্রিয় হয়েছেন, শরীয়াত ও বিবেক-বুদ্ধির এমন কোনো দলীল নেই, যা এ কথা সাব্যস্ত করে। বরং শরীয়াত ও বোধশক্তির দলীল এ কথার বিপরীত।

ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল জুআইনী তার ‘আল-ইরশাদ’ নামক কিতাবে এবং অন্যান্য কালাম শাস্ত্রবিদ উল্লেখ করেছেন যে, অতীতে আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির ধারাবাহিকতা থাকা অসম্ভব।

তারা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন যে, আপনি যদি বলেন, لَا أُعْطِيكَ دِرْهَمًا إِلَّا أُعْطِيكَ بَعْدَهُ دِرْهَمًا ‘‘আমি তোমাকে এক দিরহাম দেয়ার পর আরেক দিরহাম দিবো’’, এ ওয়াদা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু আপনি যখন বলবেন, لَا أُعْطِيكَ دِرْهَمًا حَتَّى أُعْطِيَكَ قَبْلَهُ دِرْهَمًا ‘‘আমি তোমাকে এক দিরহাম দিবো না, যতক্ষণ না তার পূর্বে আরেক দিরহাম দেই’’ এ ওয়াদা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।

এ উদাহরণ ও তুলনা সঠিক নয়। বরং সঠিক তুলনা হলো, আপনি এভাবে বলবেন,مَا أَعْطَيْتُكَ دِرْهَمًا إِلَّا أَعْطَيْتُكَ قَبْلَهُ دِرْهَمًا ‘‘আমি তোমাকে এক দিরহাম দেইনি, যতক্ষণ না তার পূর্বে আরেক দিরহাম দিয়েছি’’। এখানে আপনি এক অতীতের পূর্বে আরেক অতীত নির্ধারণ করেছেন। যেমন আপনি সেখানে এক ভবিষ্যতের পরে আরেক ভবিষ্যত নির্ধারণ করেছেন।

কিন্তু কারো এ কথা বলা যে, لَا أُعْطِيكَ حَتَّى أُعْطِيَكَ قَبْلَهُ ‘‘আমি তোমাকে দিবো না, যতক্ষণ না তার পূর্বে আরেকবার দেই’’। এখানে ভবিষ্যতে এবং পূর্বে কিছু অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আরেক ভবিষ্যৎ নাকচ করা হয়েছে। এক ভবিষ্যৎ অর্জন না পাওয়া পর্যন্ত আরেক ভবিষ্যৎ নাকচ করা হয়েছে। এটি অসম্ভব। কিন্তু এক অতীত অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আরেক অতীত নাকচ করা সম্ভব। দানকারী ভবিষ্যতে দান করবে। যে ভবিষ্যতের শুরু ও শেষ রয়েছে, তার পূর্বে সীমাহীন ভবিষ্যৎ হয় না। কেননা যার সীমা রয়েছে, তাতে সীমাহীনের অস্তিত্বের ধারণা করা অসম্ভব।[8]

[1]. উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, কেউ যদি বলে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে এক হাজার বছর আগে, তাকে জিজ্ঞেস করা যুক্তিসংগত যে, দুই হাজার বছর আগে সৃষ্টি হতে মানা কোথায়? বিশেষ করে যেহেতু জানা গেল যে, আল্লাহ তাআলা সবসময় সৃষ্টি করতে সক্ষম। সুতরাং আমাদের কাছে যেহেতু পৃথিবী সৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট সময় জানা নেই, তাই যেমন এটি সৃষ্টি হওয়া সম্ভব এক হাজার বছর পূর্বে, তেমনি দুই হাজার বছর...তিন হাজার বছর..বা আরো আগে।

[2]. সুতরাং সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, -এ বিশ্বাস রাখা অসম্ভবকে সম্ভব করার আকীদাহ পোষণ করার চেয়ে অধিক সহজ। অসম্ভবকে সম্ভব করার বিশ্বাস করার আকীদাহ থেকে প্রশ্ন জাগে যে, কার উপর অসম্ভব ছিল? কখন অসম্ভব থেকে সম্ভব হয়েছে? ইত্যাদি।

[3]. এগুলো মুতাযেলা ও জাহমীয়া দার্শনিকদের নিছক অপ্রয়োজনীয় সন্দেহ এবং যুক্তি-তর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। এ বিষয়গুলোতে প্রবেশ করার প্রয়োজনই ছিল না। তারা যেহেতু এ অকল্যাণকর বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং মুসলিমদের আকীদাহকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা করেছে, তাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলেমগণও তাদের অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্যই তাদের সাথে যুক্তি-তর্কে নেমেছেন। মূলতঃ এটি এমন অকল্যাণকর বিষয়, যাতে প্রবেশ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

এটি এ সময় তৈরী হয়েছে, ঐটি ঐ সময় তৈরী হয়েছে, এটি হওয়া সম্ভব, ঐটি অসম্ভব, মুসলিমগণ এ জাতীয় কথা-বার্তার জবাব দেয়ার মূলনীতির প্রতি মোটেই মুখাপেক্ষী নন। কেননা আমরা সৃষ্টিজগৎ তৈরী হওয়ার সময় সম্পর্কে অবগত নই। আমরা যদি নির্ধারণ করি যে, পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে একহাজার বছর পূর্বে, তাহলে এও সম্ভাবনা আছে যে, উহা দুই হাজার বছর পূর্বে তৈরী হয়েছে। আরেকজন বলতে পারে যে, তা আরো বহু পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে।

সুতরাং কোনো মানুষই জানেনা যে, সৃষ্টিজগৎ কখন তৈরী হয়েছে। তবে আমরা জানি যে, একসময় সৃষ্টিজগৎ ছিল না। পরে সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, মানুষের অস্তিত্ব ছিল না। অতঃপর তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, هَلْ أَتَىٰ عَلَى الْإِنسَانِ حِينٌ مِّنَ الدَّهْرِ لَمْ يَكُن شَيْئًا مَّذْكُورًا ‘‘মানুষের উপরে কি অন্তহীন মহাকালের এমন একটি সময়ও অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কোন জিনিসই ছিল না?’’। (সূরা দাহার: ১) অর্থাৎ তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এমনি জিন সৃষ্টি করেছেন। তাদেরও অস্তিত্ব ছিল না। ফেরেশতাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন এবং আসমান-যমীন ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। এমনি সমস্ত সৃষ্টির ব্যাপারেও একই কথা। এগুলোর কিছুই ছিল না। আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টির সূচনা করেছেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তা‘আলা ভূপৃষ্ঠে এ জীব-জন্তুগুলো ছড়িয়ে দিয়েছেন, নদ-নদী, সাগর, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত ফল-মূল ও রিযিক সৃষ্টি করেছেন। এগুলো তিনিই সৃষ্টি করেছেন। এগুলোর পূর্বে সম্ভবতঃ তিনি অন্যান্য মাখলুকও সৃষ্টি করেছেন। তবে তা আমরা জানি না। আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা এবং তিনিই পরিচালক।

আমাদের উপর আবশ্যক হলো, আমরা এসব দেখে শিক্ষা গ্রহণ করবো। এগুলো আমাদের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। এ সৃষ্টিগুলোর মাধ্যমে স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে। যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, তিনিই একমাত্র ইবাদতের হকদার। সুতরাং আমরা এককভাবে তারই ইবাদত করবো। এ সীমা কখনো অতিক্রম করবো না। মুসলিমদের জন্য এটিই আবশ্যক ও উত্তম।

উপরোক্ত আলোচনায় ممكن (সম্ভব) এবং ممتنع (অসম্ভব) কথা দু’টি একাধিকবার এসেছে। যা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব এবং যা ঘটার ধারণা করা যায়, উহাকে কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ممكن (সম্ভব) বলা হয়। আর বিবেক-বুদ্ধি যা সংঘটিত হওয়ার কল্পনা করেনা, উহাকে ممتنع (অসম্ভব) বলা হয়। ممتنع-এর অপর নাম مستحيل।

এ বিষয়টি সকলের জানা যে, অতীতে সৃষ্টিজগৎ ছিল না। অতঃপর তা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ তা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু অনেক জিনিস সৃষ্টি করা অসম্ভব বলেই তা সৃষ্টি হয়নি। যেমন পরস্পর বিপরীতধর্মী দু’টি জিনিস একত্রিত করা অসম্ভব। সংকীর্ণ একটি স্থানে একই সাথে আলো ও অন্ধকার একত্রিত হওয়া অসম্ভব। একই সাথে কারো চেহারা কালো ও সাদা হওয়া অসম্ভব এবং একই কাপড় সাদা ও কালো হওয়া অসম্ভব...ইত্যাদি। কেননা পরস্পর বিপরীতমুখী দু’টি জিনিস একত্রিত হওয়া অসম্ভব।

তবে এটি বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহর কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি পরস্পর বিপরীতমুখী দু’টি জিনিস একসাথে মিলাতেও সক্ষম। তিনি অসম্ভব বস্তু সৃষ্টি করতেও সক্ষম। তবে পরস্পর বিপরীতমুখী বস্তুগুলো একসাথে একত্রিত না করা সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষ এগুলো কল্পনা করে না। আল্লাহ তা‘আলা কিছু কিছু গায়েবী জিনিস সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি তাতে পরস্পর বিপরীতমুখী বিষয়কে একত্র করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, لا يَمُوتُ فِيهَا وَلا يَحْيَا ‘‘জাহান্নামে সে মরবেও না, বাঁচবেও না’’। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এটিকে অসম্ভব মনে করতে পারে। একজন মানুষের অবস্থা কিভাবে এমন হতে পারে যে, সে মরবেও না এবং বাঁচবেওনা? এর জবাব হলো আল্লাহর ক্ষমতায় কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি একই সময় জীবিত ও মৃত রাখার ক্ষমতা রাখেন। জাহান্নামবাসী এমন জীবন লাভ করবে, যাতে সে আগুনের আযাব ভোগ করবে। সে এমন মৃত্যু বরণ করবে না, যাতে সে আযাব থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। বরং সে শাস্তির যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু কামনা করবে; কিন্তু মৃত্যু হবে না।

মোটকথা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অন্যতম বিশেষণ হলো, তিনি সবকিছুই করতে সক্ষম। কোনো কিছুই তাকে অক্ষম করতে পারে না। তিনি পরস্পর বিপরীতমুখী বিষয় ও জিনিসগুলোকেও একসাথে মিলাতে সক্ষম। তবে সৃষ্টিজগতের মধ্যে পরস্পর বিপরীতমুখী জিনিস একসাথে মিলিত না হওয়া আল্লাহর নীতিতে পরিণত হয়েছে।

[4]. কেননা তারা বলে থাকে যে, অতীতে সূচনাহীন, অনাদি ধারাবাহিক সৃষ্টি থাকার বিশ্বাস করা হলে একাধিক অনাদি ও সূচনাহীন সত্তা সাব্যস্ত করা আবশ্যক হয়। এটি তাওহীদের পরিপন্থী। এ কারণেই তারা অতীতে ধারাবাহিক সৃষ্টি থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।

[5]. কেননা কুরআন ও সুন্নাহর দলীল দ্বারা প্রমাণিত যে, জান্নাত এবং জাহান্নাম চিরকাল থাকবে। কখনো জান্নাতের নেয়ামত এবং জাহান্নামের আযাব শেষ হবে না। এ বিশ্বাস আল্লাহ তা‘আলা সর্বশেষে বিদ্যমান থাকার পরিপন্থী নয়। কেননা হাদীছে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, أنت الآخر فليس بعدك شيئ ‘‘হে আল্লাহ! তুমিই সর্বশেষ, তোমার পরে আর কিছুই নেই’’। সুতরাং এটি যেহেতু সম্ভব, তাই অপর পক্ষে আল্লাহ তা‘আলাই যেহেতু প্রথম, তার পূর্বে যেহেতু আর কিছুই ছিল না, তা সত্ত্বেও তার সৃষ্টি করা বিশেষণটিও অনাদি এবং প্রাক্তন হওয়াতে কোনো বাধা নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা সবসময়ই স্ব-ইচ্ছায় কর্ম সম্পাদনকারী রয়েছেন।

[6]. এখানে কালেমা বা আল্লাহ তা‘আলার কথা বলতে তার ঐসব আদেশ উদ্দেশ্য, যা দ্বারা তিনি সমস্ত মাখলুক সৃষ্টি করেছেন। এতে প্রমাণ মিলে যে, অতীতে কিংবা ভবিষ্যতে আল্লাহ তা‘আলার কথা ও কাজের কোনো শেষ সীমা নেই। এগুলো আল্লাহর সিফাতের অন্তর্ভুক্ত। অতীত ও ভবিষ্যৎ সবসময়ই আল্লাহর ক্রিয়া চলতে থাকার মধ্যেই তার পূর্ণতার প্রমাণ নিহিত। যদি বলা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার পূর্বেই কোনো সৃষ্টি ছিল কিংবা তিনি প্রথমে নিস্ক্রিয় ছিলেন, এরকম ধারণা করা তার পূর্ণতার পরিপন্থী।

[7]. এ অংশ এভাবে বুঝলে ভালো হবে যে, আল্লাহর যেমন কোনো শুরু নেই, ঠিক তেমনি তার কাজ করা বিশেষণটিরও কোনো শুরু নেই। এটি তার সাথে সাথেই অনাদি ও অনন্ত এবং চিরবিদ্যমান। কিন্তু তিনি তার কাজ করার ক্ষমতা বিশেষণ দিয়ে যা সৃষ্টি করেছেন বা করেন, তার একটি সূচনা ও পরিসমাপ্তি অবশ্যই রয়েছে।

[8]. এগুলো নিছক বিবেক-বুদ্ধি ও মস্তিস্কের কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মূলকথা হলো অতীতে ও ভবিষ্যতে আল্লাহর সৃষ্টি ও ক্রিয়া চালু থাকা শুধু সম্ভবই নয়; বরং আবশ্যক। এতেই আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণতা সাব্যস্ত হয়। স্রষ্টা যেহেতু চির বিদ্যমান ও চিরজীবন্ত, অনাদি-অবিনশ্বর তাই তার ক্রিয়া ও সৃষ্টি অতীতে এবং ভবিষ্যতের সবসময় ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকার মধ্যেই তার পূর্ণতা রয়েছে। তা সাব্যস্ত করা ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতা সাব্যস্ত হয় না। এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মত। শাইখ ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ জাহমিয়া এবং দার্শনিকদের কথা টেনে এনে কুরআন-হাদীছের দলীল ও যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তা বাতিল করে দিয়ে এ সত্যটিই সাব্যস্ত করেছেন। (আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)