পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের পরেই অন্যতম ফরয ইবাদত জানাযার সালাত। আমাদের সমাজের অনেক ধার্মিক মুসলিমই এই ইবাদতের ক্ষেত্রে অবহেলা করেন। অনেকে মনে করেন, যেহেতু ফরযে কেফায়া সেহেতু কেউ পালন করলেই তো হলো। এ পলায়নী মনোবৃত্তি। মুমিনের এই দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। মুমিন দেখবেন, এই কর্মে আল্লাহ কত খুশি হবেন এবং কত সাওয়াব ও বরকত আমি লাভ করব।
জানাযার সালাতের জন্য অচিন্তনীয় সাওয়াব ও বরকতের কথা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এর একটি কারণ এই ইবাদতটি সৃষ্টির সেবা কেন্দ্রিক, আর আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন তাঁর সৃষ্টির সেবাতে।
এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
من تبع جنازة فصلى عليها فله قيراط فإن شهد دفنها فله قيراطان القيراط أعظم من أحد
“কেউ যদি কারো জানাযার অনুগমন করে ও সালাতে অংশ গ্রহণ করে তবে সে এক ‘কীরাত’ সাওয়াব অর্জন করবে। আর যদি সে তার দাফনে (কবরস্থ করায়) উপস্থিত থাকে তাহলে সে দুই কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে। এক কীরাত উহদ পাহাড়ের চেয়েও বড়।” হাদীসটি সহীহ।[1]
অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন বলেনঃ
مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا ؟ ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، قَالَ : فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً ؟ ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، قَالَ : فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا ؟ ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، قَالَ : فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا ؟ ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ
“তোমাদের মধ্যে আজ কে সিয়ামরত ছিলে? আবু বকর (রাঃ) বলেন: আমি। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রশ্ন করেন: তোমাদের মধ্যে কে আজ কোনো জানাযায় শরীক হয়েছ? আবু বকর (রাঃ) বলেন: আমি। তিনি প্রশ্ন করেন: তোমাদের মধ্যে কে আজ দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করেছ ? আবু বকর (রাঃ) বলেন: আমি। তিনি আবার প্রশ্ন করেন: আজ তোমাদের কে অসুস্থ কোনো মানুষকে দেখতে গিয়েছ ? আবু বকর বলেন: আমি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ এই কর্মগুলি যদি কোনো মানুষের মধ্যে একত্রিত হয় তাহলে সেই ব্যক্তি অবশই জান্নাতী হবেন।”[2]
পাঠক দেখতে পাচ্ছেন যে, এখানে চারটি ইবাদতের তিনটিই সৃষ্টির সেবা বিষয়ক। আল্লাহ আমাদেরকে এই গুণগুলি একত্রিত করার তাওফীক দান করেন।
অনেক ধার্মিক মুসলিম জানাযার সালাতের নিয়ম জানেন না বা ভয় পান। বস্তুত জানাযার সালাত অত্যন্ত সহজ ইবাদত। এর একমাত্র উদ্দেশ্য মৃতব্যক্তির জন্য দু‘আ করা। মৃতের জন্য কিছু দু‘আ ছাড়া অতিরিক্ত কোনো কিছু এতে নেই। আমাদের দেশে বানোয়াট একটি দীর্ঘ “নিয়্যাত” প্রচলিত আছে, যা একেবারেই ভিত্তিহীন ও খেলাফে সুন্নাত। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাওয়াবের উদ্দেশ্যে মৃতব্যক্তির জন্য জানাযার সালাত আদায় করছি, এই কথাটুকু মনের মধ্যে থাকাই যথেষ্ট।
৪টি তাকবীর ও সালামের মাধ্যমে এই সালাত আদায় করা হয়। ইমাম ও মুক্তাদীগণ সকলেই এই তাকবীরগুলি ও সালাম মুখে উচ্চারণ করবেন। প্রথমে মৃতের জন্য দু‘আ করার আন্তরিক আবেগ ও নিয়্যাতসহ তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে সালাত শুরু করবেন। তাকবীরে তাহরীমার পরে আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে সালাতের সানা (পূর্বোক্ত ৪৬ নং যিকর) পাঠ করবেন। হাদীস শরীফে এ সময়ে সূরা ফাতিহা পড়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এরপর দ্বিতীয় তাকবীরের পরে দরুদে ইবরাহীমী (পূর্বোক্ত ৩১ ও ৩২ নং যিকর) পাঠ করবেন। এরপর তৃতীয় তাকবীরের পরে মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করবেন। এরপর ৪র্থ তাকবীর বলে সালামের মাধ্যমে সালাত শেষ করবেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, জানাযার সালাত মূলত মৃতের জন্য দু‘আ। বিভিন্ন হাদীসে জানাযার সালাতে মৃতের জন্য বেশি করে দু‘আ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
إذا صليتم على الميت فأخلصوا له الدعاء
“যখন তোমরা মৃতের উপর (জানাযার) সালাত আদায় করবে তখন তার জন্য আন্তরিকতার সাথে দু‘আ করবে।”[3]
জানাযার সালাতের তৃতীয় তাকবীরের পরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দু‘আ পাঠ করতেন। তিনি মৃতের জন্য এত দু‘আ করতেন যে, পিছনের জীবিত সাহাবীগণ কামনা করতেন যে, আমরা যদি এই মাইয়েত হতে পারতাম তাহলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই দু‘আ আমরা পেতাম।
যে কোনো দু‘আ পাঠ করলে, বা শুধুমাত্র (ﻟـﻪ ﺍﻏﻔـﺮ ﺍﻟﻠـﻬﻢ) “আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন” ইত্যাদি বাক্যের মাধ্যমে দু‘আ করলেই দু‘আর ন্যূনতম দায়িত্ব পলিত হবে। তবে মুমিনের উচিত একাধিক মাসনূন দু‘আ মুখস্থ করে তা এই সময়ে পাঠ করা।
যিকর নং ১৪২ : জানাযার দু‘আ-১
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ وَعَافِهِ وَاعْفُ عَنْهُ وَأَكْرِمْ نُزُلَهُ وَوَسِّعْ مُدْخَلَهُ وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ وَنَقِّهِ مِنْ الْخَطَايَا كَمَا نَقَّيْتَ الثَّوْبَ الْأَبْيَضَ مِنْ الدَّنَسِ وَأَبْدِلْهُ دَارًا خَيْرًا مِنْ دَارِهِ وَأَهْلًا خَيْرًا مِنْ أَهْلِهِ وَزَوْجًا خَيْرًا مِنْ زَوْجِهِ وَأَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ وَأَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ أَوْ مِنْ عَذَابِ النَّارِ
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মাগফির লাহূ, ওয়ার‘হামহূ, ওয়া‘আ-ফিহী, ওয়া‘অ্ফু ‘আনহু, ওয়া আকরিম নুযুলাহূ, ওয়া ওয়াসসি‘য় মুদখালাহূ, ওয়াগসিলহু বিলমা-ই ওয়াসসালজি ওয়াল বারাদি। ওয়া নাক্বক্বিহী মিনাল খাতা-ইয়া- কামা- নাক্বক্বাইতাস সাওবাল আবইয়াদ্বা মিনাদ দানাস। ওয়া আবদিলহূ দা-রান খাইরাম মিন দা-রিহী, ওয়া আহলান খাইরাম মিন আহলিহী, ওয়া যাওজান খাইরাম মিন যাওজিহী, ওয়া আদখিলহুল জান্নাতা ওয়া আ‘ইযহু মিন আযাবিল ক্বাবরি (আযাবিন না-র)।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি তাকে ক্ষমা করুন, রহমত করুন, নিরাপত্তা দান করুন, তাকে মাফ করে দিন, তাকে সম্মানের সাথে আপনার কাছে স্থান দান করুন, তার প্রবেশস্থান (আবাসস্থান) প্রশস্থ করুন, তাকে পানি, বরফ ও শীল দিয়ে ধৌত করুন, তাকে পাপরাশি থেকে এমনভাবে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করুন যেভাবে সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে করেছেন। তাকে দান করুন তার (ফেলে যাওয়া) বাড়ির চেয়ে উত্তম বাড়ি, তার পরিজনের চেয়ে উত্তম পরিজন, তার দাম্পত্য সঙ্গীর চেয়ে উত্তম সঙ্গী। তাকে আপনি জান্নাত প্রদান করুন এবং কবরের বা জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।”[4]
যিকর নং ১৪৩ : জানাযার দু‘আ-২
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيرِنَا وَكَبِيرِنَا وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا ، فَأَحْيِهِ عَلَى الإِسْلامِ ، وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الإِيمَانِ اللَّهُمَّ لاَ تَحْرِمْنَا أجْرَهُ وَلاَ تَفْتِنَا بَعْدَهُ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাগফিরলি ‘হাইয়িনা- ওয়ামাইয়িতিনা- ওয়া শা-হিদিনা- ওয়াগা-ইবিনা- ওয়া স্বাগীরিনা- ওয়া কাবীরিনা-ওয়া যাকারিনা ওয়া উনসা-না। আল্লা-হুম্মা, মান আ’হইয়াইতাহূ মিন্না- ফাআ’হয়িহী ‘আলাল ইসলা-ম। ওয়ামান তাওয়াফফাইতাহূ মিন্না- ফাতাওয়াফফাহু ‘আলাল ঈমা-ন। আল্লাহুম্মা লা তাহরিমনা আজরাহু ওয়ালা তাফতিন্না বা’দাহু।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমা করুন আমাদের মৃতকে এবং জীবিতকে, উপস্থিতকে এবং অনুপস্থিতকে, ছোটকে এবং বড়কে, পুরুষকে এবং নারীকে। হে আল্লাহ, আমাদের মধ্য থেকে যাকে আপনি জীবিত রাখবেন, তাকে ইসলামের উপর জীবিত রাখুন এবং যাকে আপনি মৃত্যু দান করবেন, তাকে আপনি ঈমানের উপর মৃত্যু দান করুন। হে আল্লাহ তার (তার জন্য দু‘আ করার বা সবর করার) পুরস্কার থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না এবং তার পরে আমাদেরকে ফিতনায় (পরীক্ষায় বা বিপদে) ফেলবেন না।”[5]
যিকর নং ১৪৪ : জানাযার দু‘আ-৩
اللَّهُمَّ إنَّ فُلانَ ابْنَ فُلان في ذِمَّتِكَ وَحَبْلِ جِوَارِكَ، فَقِهِ فِتْنَةَ القَبْر، وَعَذَابَ النَّارِ، وَأَنْتَ أَهْلُ الوَفاءِ والحَمْدِ، اللَّهُمَّ فاغفِرْ لهُ وَارْحَمْهُ، إنكَ أَنْتَ الغَفُور الرَّحيمُ
অর্থ: “হে আল্লাহ, অমুকের সন্তান অমুক (মৃত ব্যক্তি ও তার পিতার নাম) আপনার যিম্মায় ও আপনার নৈকট্যের রশির মধ্যে। আপনি তাকে কবরের ও জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন। আপনি ওয়াদা পালন ও প্রশংসার অধিকারী। অতএব আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন এবং রহমত করুন। নিশ্চয় আপনিই ক্ষমাশীল করুণাময়।”[6]
যিকর নং ১৪৫: জানাযার দু‘আ-৪
اللهم (أنت ربها و) أنت خلقتها وأنت هديتها (للإسلام) وأنت قبضت روحها تعلم سرها وعلانيتها جئنا شفعاء فاغفر لها
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, আনতা রাব্বুহা-, ওয়া আনতা খালাক্বতাহা-, ওয়া আনতা হাদাইতাহা- লিল ইসলা-ম, ওয়া আনতা ক্বাবাদ্বতা রূহাহা-, তা‘অ্লামু সিররাহা ওয়া ‘আলা-নিয়্যাতাহা-, জিয়না শুফা‘আ-আ ফাগফির লাহা-।
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনি তার প্রভু, আপনিই তাকে সৃষ্টি করেছেন, আপনিই তাকে ইসলামের পথ প্রদর্শন করেছেন, আপনিই তার রূহ গ্রহণ করেছেন, আপনি তার গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু জানেন। আমরা তার জন্য সুপারিশ (শাফা‘আত) করতে এসেছি, অতএব আপনি তাকে ক্ষমা করে দেন।”[7]
যিকর নং ১৪৬: জানাযার দু‘আ-৫
প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হাসান বসরী (রহঃ) অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুর জানাযায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন এবং নিম্নের দু‘আটি পাঠ করতেনঃ
اللهم اجعله لنا فرطا وسلفا واجراً
উচ্চারণঃ “আল্লা-হুম্মাজ‘আলহূ লানা- ফারাত্বাও ওয়া সালাফাও ওয়া আজরান।”
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনি একে আমাদের জন্য (জান্নাতের দিকে) অগ্রবর্তী, অগ্রগামী ও পুরস্কার হিসাবে সংরক্ষিত করুন।”[8]
[2] সহীহ মুসলিম ২/৭১৩, নং ১০২৮।
[3] হাদিসটি হাসান। সুনানু আবী দাউদ ৩/২১, নং ৩১৯৯, সুনানু ইবনু মাজাহ ১/৪৮০, নং ১৪৯৭।
[4] সহীহ মুসলিম ২/৬৬২-৬৬৩, নং ৯৬৩।
[5] হাদিসটি হাসান। সুনানুত তিরমিযী ৩/৩৪৩, নং ১০২৪, সুনানু আবু দাউদ ৩/২১১, নং ৩২০১, সুনানুন নাসাঈ ৪/৭৪, ১৯৮৬, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৪৮০, নং ১৪৯৮, মুসতাদরাক হাকিম ১/৫১২।
[6] হাদিসটি হাসান। সুনানু আবু দাউদ ৩/২১১, নং ৩২০২, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৪৮০, নং ১৪৯৯।
[7] হাদিসটি হাসান। নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৬/২৬৫-২৬৬, মুসনাদ আহমাদ ২/২৫৬, ৩৪৫, ৩৬৩, ৪৫৮, মুসান্নাফু ইবনি আবী শাইবা ২/৪৮৯, বাইহাকী, কুবরা ৪/৪২।
[8] সহীহ বুখারী (তা’লীক) ১/৪৪৮।