মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সহজেই অত্যন্ত বেশি সাওয়াব অর্জনের অন্যতম মাধ্যম সবর বা ধৈর্যধারণের গুণ অর্জন করা। ধৈর্য মুমিনের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধৈর্য বলতে নিষ্ক্রিয় নির্জীবতা বুঝানো হয় না, বরং সক্রিয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বুঝানো হয়। পারিপার্শিক অবস্থা বা অন্যের আচরণ দ্বারা নিজের আচরণ প্রভাবিত না করে নিজের স্থির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিজেকে পরিচালিত করার ক্ষমতা। এক কথায় Re-active না হয়ে Pro-active হওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
أفضل الإيمان الصبر والسماحة
“ধৈর্য ও উদারতাই সর্বোত্তম ঈমান।” হাদীসটি সহীহ।[1]
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ধৈর্য তিন প্রকারের: (১) বিপদ-আপদ ও কষ্টে ধৈর্য, (২) পাপ ও লোভ থেকে ধৈর্য এবং (৩) ক্রোধের মধ্যে ধৈর্য। বিপদে হতাশ বা অধৈর্য হয়ে পড়া একদিকে যেমন ঈমানের পরিপন্থী, অপরদিকে তা মানবীয় ব্যক্তিতেরব চরম পরাজয়। হতাশা, অস্থিরতা বা উৎকণ্ঠা বিপদ দূর করেনা, বিপদের কষ্ট কমায় না বা বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ দেখায় না। সর্বোপরি হতাশা বা ধৈর্যহীনতা স্বয়ং একটি কঠিন বিপদ যা মানুষকে আরো অনেক কঠিন বিপদের মধ্যে নিপতিত করে। পক্ষান্তরে ধৈর্য বিপদ দূর না করলেও তা বিপদ নিয়ন্ত্রণ করে, বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য শান্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ দেয় এবং অস্থিরতা জনিত অন্যান্য বিপদের পথরোধ করে। সর্বোপরি বিপদে কষ্টে ধৈর্যের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর নিকট মহান মর্যাদা, সাওয়াব, জাগতিক বরকত ও পারলৌকিক মুক্তি অর্জন করেন। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে: “আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্য পরীক্ষা করব। আর আপনি শুভ সংবাদ প্রদান করুন ধৈর্যশীলদেরকে, যারা তাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলে, ‘আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তণকারী।”[2]
ধৈর্য হলো কর্মময় স্থিরচিত্ততা ও হতাশামুক্ত সুদৃঢ় মনোবল। মুমিন দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিজের কল্যাণ ও স্বার্থ অর্জনের জন্য চেষ্টা করবেন। বিপদে আপদে কখনোই অতীতের ভুলভ্রান্তি নিয়ে হতাশা বা আফসোস করে সময় নষ্ট করবেন না বা মনের মধ্যে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও হতাশার অনুপ্রবেশের দরজা খুলে দিবেন না। বরং যা ঘটার আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটেছে এই বিশ্বাস নিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে কর্মের পথে এগোতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেনঃ
الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَيءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ
“শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক প্রিয় ও অধিক কল্যাণময়, যদিও প্রত্যেকের ভিতরেই কল্যাণ রয়েছে।
তোমার জন্য যা কল্যাণকর তা অর্জনের জন্য তুমি সুদৃঢ় মনোবল নিয়ে সচেষ্ট হও এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। কখনোই হতাশা বা অবসাদগ্রস্ত হবে না। যদি তুমি কোনো বিপদে-অসুবিধায় নিপতিত হও তবে তুমি বলবে না যে, যদি আমি এইরূপ করতাম!! বরং তুমি বলবে, আল্লাহর নির্ধারণ এবং তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তাই করেছেন। কারণ ‘যদি করতাম!!’ বলে অতীতের কর্ম নিয়ে আফসোস শয়তানের কর্মের পথ উন্মুক্ত করে।”[3]
ক্রোধের সময় ধৈর্য ধারণ করা ঈমানের অন্যতম দিক। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ
“যে অপরকে মললযুদ্ধে পরাজিত করতে পারে সেই প্রকৃত বীর নয়, প্রকৃত বীর যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারে।”[4]
আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, আমাকে এমন একটি কর্ম শিখিয়ে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বলেনঃ
لا تغضب ولك الجنة
“তুমি ক্রোধান্বিত হবে না তাহলেই জান্নাত তোমার প্রাপ্য হবে।”[5]
ক্রোধ সম্বরণ করা ও ক্রোধের সময় আত্ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন, তন্মধ্যে রয়েছে, ক্রোধান্বিত হলে ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম’ পাঠ করা, আল্লাহর ক্রোধের কথা স্মরণ করা, উত্তেজিত অবস্থায় কথা না বলে চুপ করে থাকা, মুখে-মাথায় ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা, ওজু করা, দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে শয়ন করা ইত্যাদি।
ক্রোধের সময় আত্মনিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যার কারণে ক্রোধের উদ্রেক হয়েছে বা যে কষ্ট দিয়েছে তাকে ক্ষমা করতে ও তার সাথে উত্তম আচরণ করতে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কুরআন ও হাদীসে। বিশেষত যাকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব সেইরূপ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা অতীব প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, “ভাল এবং মন্দ (আচরণ) সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। এই গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা ধৈর্যশীল, এই গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা মহা ভাগ্যবান।”[6]
প্রকৃত মুমিনদের বৈশিষ্ট বর্ণনা করতে যেয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, “তারা কবীরা গোনাহ সমূহ ও অশ্লীল কর্ম বর্জন করে এবং যখন তারা ক্রোধান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে।”[7] অন্যত্র জান্নাতী মুমিনদের পরিচয়ে বলা হয়েছেঃ “তারা ক্রোধ সম্বরণ ও নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানুষদেরকে ক্ষমা করে।”[8]
ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
من كف غضبه ستر الله عورته ومن كظم غيظه ولو شاء أن يمضيه أمضاه ملأ الله قلبه رضي يوم القيامة
“যে ব্যক্তি ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করবে আল্লাহ তার মর্যাদা রক্ষা করবেন ও দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। বিরক্তি ও ক্রোধে উত্তেজিত অবস্থায় যদি কেউ রাগ প্রকাশের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সম্বরণ করে তবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার হৃদয়কে পরিতৃপ্তি ও সন্তুষ্টি দ্বারা পূর্ণ করবেন।” হাদীসটি হাসান।[9]
[2] সূরা বাকারাঃ ১৫৫-১৫৬।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৫২।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২৬৭; মুসলিম আস-সহীহ ৪/২০১৪।
[5] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৭০। হাদিসটির সনদ সহীহ।
[6] সূরা হা-মীম সাজদা (ফুসসিলাত) ৩৩–৩৫।
[7] সূরা শূরাঃ ৩৭।
[8] সূরা আলে ইমরানঃ ১৩৪।
[9] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৯১, আলবানী সহীহুল জামি’ ১/৯৭।