প্রথমত, সালত পাঠের গুরুত্ব ও ফযীলত
সালাত পাঠ করা আমাদের দায়িত্ব। তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন আমরা জীবন বিলিয়ে দিলেও তাঁর সামান্যতম প্রতিদান দিতে পারব না, কারণ আমরা হয়ত আমাদের পার্থিব সংক্ষিপ্ত জীবনটা বিলিয়ে দিলাম, কিন্তু তিনি তো আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক অনন্ত জীবনের সফলতার পথ দেখাতে তাঁর মহান জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তাই মহানবী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি আমাদের নূন্যতম দায়িত্ব যে আমরা সদা সর্বদা তাঁর সর্বোচ্চ মর্যাদার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব, বা তাঁর জন্য সালাত পাঠ করব। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামীনের দয়া দেখুন, তাঁর হাবীবের প্রতি তাঁর সম্মান প্রদর্শনের একটি দিক এই যে, যদিও সালাত পাঠ আমাদের দায়িত্ব তবুও আল্লাহ এতে এতো খুশি হন যে এর জন্য অফুরন্ত পুরস্কার দান করেন।
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপর সালাত পাঠের বিভিন্ন প্রকাররের পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। সেগুলির মধ্যে অন্যতম নিম্নের ৬ প্রকার পুরস্কার:
(১) আল্লাহ দয়া, ক্ষমা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’ঊদ (রাঃ) বলেছেন : রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
صَلُّوا عَلَيَّ فَإِنَّهُ مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً صَلَّى الله عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا
“তোমরা আমার উপর সালাত পাঠ কর; কারণ যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত পাঠ করবে আল্লাহ তাকে ১০ বার সালাত (রহমত) করবেন।”[1]
আবু বুরদা ইবনু নিয়ার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
من صلى علي صلاة مخلصا من قلبه صلى الله عليه بها عشر صلوات ورفعه بها عشر درجات وكتب له بها عشر حسنات ومحا عنه عشر سيئات
“যদি কেউ অন্তর থেকে ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে একবার সালাত পাঠ করে, আল্লাহ সেই সালাতটির বিনিময়ে তার ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন, ১০টি সাওয়াব লিখবেন এবং ১০টি গোনাহ ক্ষমা করবেন।”[2]
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرَ صَلَوَاتٍ وَحُطَّتْ عَنْهُ عَشْرُ خَطِيئَاتٍ وَرُفِعَتْ لَهُ عَشْرُ دَرَجَاتٍ
“যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত পাঠ করবে আল্লাহ তাকে ১০ বার সালাত (রহমত) করবেন, তাঁর ১০টি পাপ ক্ষমা করা হবে এবং তাঁর মর্যাদা ১০টি স্তর বাড়িয়ে দেওয়া হবে।” হাদীসটির সনদ সহীহ।[3]
আবু তালহা (রাঃ) বলেন, একদিন সকালে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে অত্যন্ত আনন্দিত চিত্তে দেখা গেল। তাঁর চেহারা মুবারকে আনন্দের ছাপ ছিল। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আজ আপনি খুবই আনন্দচিত্ত। আপনার চেহারা মুবারাকে আনন্দের ছাপ রয়েছে। তিনি বললেনঃ
أجل أتاني آت من ربي عز وجل فقال من صلى عليك من أمتك صلاة كتب الله له بها عشر حسنات ومحا عنه عشر سيئات ورفع له عشر درجات ورد عليه مثلها
“হাঁ, আমার প্রভুর নিকট থেকে একদূত এসে আমাকে বলেছেনঃ আপনার উম্মতের কোনো ব্যক্তি যদি আপনার উপর সালাত পাঠ করে, তাহলে আল্লাহ তাঁর জন্য ১০টি সাওয়াব লিখবেন, তাঁর ১০ টি গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন, তাঁর জন্য দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তাঁর জন্য ঠিক অনুরূপ সালাত (রহমত ও মর্যাদা) ফিরিয়ে দেবেন।” হাদীসটির সনদ হাসান।[4]
আবু তালহা থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসে তিনি বলেছেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত আনন্দিত চেহারায় আমাদের কাছে আসলেন। আমরা বললামঃ আমরা আপনার চেহারা মোবারকে আনন্দ দেখতে পাচ্ছি? তিনি বললেন, আমার কাছে ফিরেশতা এসে বলেন, আপনার প্রভু বলেছেন -
أَمَا يُرْضِيكَ يَا مُحَمَّدُ أَنَّهُ لا يُصَلِّي عَلَيْكَ أَحَدٌ إِلا صَلَّيْتُ عَلَيْهِ عَشْرًا أَوْ لا يُسَلِّمُ عَلَيْكَ أَحَدٌ إِلا سَلَّمْتُ عَلَيْهِ عَشْرًا
“আপনি কি খুশি নন যে, যদি কেউ আপনার উপর ১ বার সালাত পাঠ করে তাহলে আমি তাঁর উপর ১০ বার সালাত (রহমত ও
দয়া) দান করব। আর যদি কেউ আপনার উপর ১ বার সালাম জানায় আমি তাঁর উপর ১০ বার সালাম জানাই।”[5]
আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) বাইরে যান, আমিও তাঁকে অনুসরণ করি। তিনি একটি খেজুরের
বাগানে প্রবেশ করেন এবং সাজদায় যান। তিনি সাজদা রত অবস্থায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন, ফলে আমি ভয় পেয়ে যাই এই ভেবে যে, সাজদা রত অবস্থায় তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেল কিনা? এজন্য আমি কাছে এসে নজর করি। তিনি মাথা তুলে বলেন, আব্দুর রহমান, তোমার কী হয়েছে? তখন আমি আমার (মনের ভয়ের) কথা তাঁকে জানালাম। তিনি বললেনঃ জিবরীল আমাকে বললেনঃ আপনি কি এজন্য খুশি নন যে, আল্লাহ বলেছেনঃ
مَنْ صَلَّى عَلَيْكَ صَلَّيْتُ عَلَيْهِ، وَمَنْ سَلَّمَ عَلَيْكَ سَلَّمْتُ عَلَيْهِ
“আপনার উপর যে সালাত (দরুদ) পাঠাবে আমিও তার উপর সালাত (রহমত, বরকত) পাঠাব, আর যে আপনার উপর সালাম পাঠাবে আমি তার উপর সালাম পাঠাব।” (নবীজী বলেন) “ আর এ জন্য আমি শুকরানা সাজদা করি।”[6]
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছিঃ
إِذَا سَمِعْتُمْ الْمُؤَذِّنَ فَقُولُوا مِثْلَ مَا يَقُولُ ، ثُمَّ صَلُّوا عَلَيَّ ، فَإِنَّهُ مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلاةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا ، ثُمَّ سَلُوا اللَّهَ لِي الْوَسِيلَةَ ، فَإِنَّهَا مَنْزِلَةٌ فِي الْجَنَّةِ لا تَنْبَغِي إِلا لِعَبْدٍ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ ، وَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَنَا هُوَ ، فَمَنْ سَأَلَ لِي الْوَسِيلَةَ حَلَّتْ لَهُ الشَّفَاعَةُ
“যখন তোমরা মুয়াযযিনকে (আযান দিতে) শুনবে তখন সে যা যা বলবে তোমরাও তা বলবে, এরপর তোমরা আমার উপর সালাত পাঠ করবে; কারণ যে আমার উপর সালাত পাঠ করবে আল্লাহ তাঁকে একটি সালাতের বিনিময়ে ১০ বার সালাত (রহমত, মর্যাদা, বরকত) প্রদান করবেন। এরপর তোমরা আমার জন্য আল্লাহর কাছে ওসীলা প্রার্থনা করবে; ওসীলা জান্নাতের এমন একটি মর্যাদার স্থান যা শুধুমাত্র আল্লাহর একজন বান্দাই লাভ করবেন, আমি আশা করি আমিই তা লাভ করব। যে ব্যক্তি আমার জন্য ‘ওসীলা’ প্রার্থনা করবে তাঁর জন্য শাফায়াত প্রাপ্য হবে।”[7]
যিকর নং ৩৩ : আরেকটি মাসনূন সালাত
اللهم صل على محمد عبدك ورسولك وصل على المؤمنين والمؤمنات والمسلمين والمسلمات
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা সাল্লি ‘আলা- মুহাম্মাদিন, ‘আবদিকা ওয়া রাসূলিকা, ওয়া সাল্লি ‘আলাল মু’মিনীনা ওয়াল মু’মিনা-ত, ওয়াল মুসলিমীন ওয়াল মুসলিমা-ত।
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনি সালাত প্রেরণ করুন আপনার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদের উপর, এবং সালাত প্রেরণ করুন সকল মুমিন পুরুষ, মুমিন নারী, মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীর উপর।”
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেছেনঃ
أَيُّمَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ لَمْ يَكُنْ عِنْدَهُ صَدَقَةٌ فَلْيَقُلْ فِي دُعَائِهِ ... فَإِنَّهَا (له) زَكَاةٌ
“কোনো মুসলিমের কাছে যদি দান করার কিছুই না থাকে তাহলে তার উচিত দু‘আর মধ্যে উপরিউক্ত কথাগুলি (সালাতটি) বলা উচিত, তাহলে এই সালাত তাঁর জন্য যাকাত স্বরূপ গণ্য হবে (সে দান করার সাওয়াব অর্জন করবে)।”
হাদীসটির সনদে কিছু দুর্বলতা থাকলেও, তা অনুধাবনযোগ্য এবং সাখাবী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।[8] আরো অনেক সাহাবা থেকে সহীহ সনদে সালাত পাঠের অপরিসীম অপরিমেয় পুরস্কারের বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত রয়েছে।
(২) ফিরিশতারা রহমত ও মর্যাদার জন্য দু‘আ করবেন
সালাত পাঠের পুরস্কারের আরেকটি দিক, আল্লাহর সম্মানিত ফিরিশতাগণ সালাত পাঠকারীর জন্য দু‘আ করেন। আমির বিন রাবিয়া (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে খুতবায় বলতে শুনেছি যে,
مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً لَمْ تَزَلِ الْمَلَائِكَةُ تُصَلِّي عَلَيْهِ مَا صَلَّى عَلَيَّ، فَلْيُقِلَّ عَبْدٌ مِنْ ذَلِكَ أَوْ لِيُكْثِرْ
“যে ব্যক্তি আমার উপর সালাত (দরুদ) পাঠ করবে, যতক্ষণ যে সালাত পাঠ করতে থাকবে ততক্ষণ ফিরেশতাগণ তাঁর জন্য সালাত (দু‘আ) করতে থাকবেন, অতএব কোনো বান্দা চাইলে তা বেশি করে করুক অথবা কম করে করুক।” হাদীসটির সনদ হাসান বা গ্রহণযোগ্য।[9]
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেছেন,
من صلى على رسول الله صلى الله عليه وسلم صلاة صلى الله عليه وملائكته سبعين صلاة فليقل عبد من ذلك أو ليكثر
“কোনো ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপর একবার সালাত পাঠ করবে, আল্লাহ এবং তাঁর ফিরিশতাগণ তাঁর উপর সত্তর বার সালাত (রহমত ও দু’আ) করবেন, অতএব কোনো বান্দা চাইলে তা বেশি করে করুক অথবা কম করে করুক।” হাদীসটির সনদ হাসান।[10]
(৩) সালাত রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে পৌঁছান হবে
সালাত পাঠের পুরস্কারের ৩য় দিক, সালাত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পৌঁছান হবে। অন্য কোনো পরলোকগত মানুষের জন্য দু’আ করা হলে তা আল্লাহ হয়ত কবুল করবেন এবং যার জন্য দু’আ করা হয়েছে তাকে বিনিময়ে মর্যাদা বা পুণ্য দান করবেন। কিন্ত তিনি হয়ত দু‘আকারীর বিষয়ে বিস্তারিত জানবেন না। কিন্ত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপর সালাত পাঠকারীর সকল পুরস্কারের অতিরিক্ত আনন্দ এই যে, তাঁর নাম ও পরিচয়সহ তাঁর সালাত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে পৌঁছান হবে। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানি, যে কোনো মুসলিম দুনিয়ার যেখানেই থাক না কেন, দুনিয়ার যে প্রান্ত থেকেই সে সালাত পাঠ করুক না কেন, তাঁর সালাত মদীনা মুনাওয়ারায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তাঁর রওযা মুবারাকায় পৌঁছান হবে। উপরন্তু কোনো কোনো হাদীসে এরূপও বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাত পাঠকারীর জন্য দু‘আ করবেন।
আউস বিন আউস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
إن من أفضل أيامكم يوم الجمعة فيه خلق آدم عليه السلام وفيه قبض وفيه النفخة وفيه الصعقة فأكثروا علي من الصلاة فإن صلاتكم معروضة علي قالوا يا رسول الله وكيف تعرض صلاتنا عليك وقد أرمت أي يقولون قد بليت قال إن الله عز وجل قد حرم على الأرض أن تأكل أجساد الأنبياء عليهم السلام
“তোমাদের দিনগুলির মধ্যে সর্বোত্তম দিন শুক্রবার। এদিনেই আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এদিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, এদিনেই সিংগা ফুঁক দেওয়া হবে, এদিনেই কিয়ামত হবে। কাজেই এই দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে সালাত পাঠ করবে, কারণ
তোমাদের সালাত আমার কাছে পেশ করা হবে।” সাহাবীগণ বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তো (কবরের মাটিতে) বিলুপ্ত হয়ে যাবেন, মিশে যাবেন, কিভাবে তখন আমাদের সালাত আপনার নিকট পেশ করা হবে?” তিনি বলেন, “মহান আল্লাহ মাটির জন্য নিষিদ্ধ করেছেন নবীদের দেহ ভক্ষণ করা।” হাদীসটির সনদ সহীহ।[11]
অন্য একটি হাদীসে আবু হুরাইরা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
من صلى علي عند قبري سمعته ومن صلى علي من بعيد أعلمته
“কেউ আমার কবরের নিকট থেকে আমার উপর সালাত পাঠ করলে আমি শুনতে পাই। আর যদি কেউ দূর থেকে আমার উপর সালাত পাঠ করে তাহলে আমাকে জানান হয়।”[12]
হাদীসটি সনদের দিক থেকে খুবই দুর্বল। তবে একাধিক সমার্থক বর্ণনার কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।[13]
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মাতকে সর্বাবস্থায় যে যেখানে অবস্থান করবে সেখানে থেকেই সালাত ও সালাম পাঠ করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন আর তাদের সালাত ও সালাম তাঁর দরবারে পৌঁছান হবে বলে তাদেরকে নিশ্চিত করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর প্রিয়তম নাতী ইমাম হুসাইন, আবু হুরাইরা প্রমুখ সাহাবী তাঁর থেকে বিভিন্ন হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম হুসাইন (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
حيثما كنتم فصلوا علي فإن صلاتكم تبلغي
“তোমরা যেখানেই থাকনা কেন আমার উপর সালাত পাঠ কর, কারণ তোমাদের সালাত আমার কাছে পৌঁছান হবে।” হাদীসটির সনদ হাসান।[14]
ইমাম হাসান বিন আলী (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
صلوا في بيوتكم ولا تتخذوها قبورا، ولا تتخذوا بيتي عيدا، وصلوا علي وسلموا فإن صلاتكم وسلامكم تبلغني
“তোমরা তোমাদের বাড়িতে বসেই সালাত প্রেরণ করবে, তোমাদের বাড়িগুলিকে কবর বানিয়ে ফেলবে না। আর আমার বাড়িকেও ঈদ (ঈদগাহ বা আনন্দ বা সমাবেশের স্থান) বানিয়ে ফেলবে না। তোমরা (তোমাদের বাড়িতেই) আমার উপর সালাত ও সালাম পাঠাও, কারণ তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের সালাত ও সালাম আমার কাছে পৌঁছে যায়।”[15]
এই মর্মে অন্য হাদীসে আবু হুরাইরার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেনঃ
اَ تَتَّخِذُوا قَبْرِي عِيدًا وَلاَ تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا وَحَيْثُمَا كُنْتُمْ فَصَلُّوا عَلَيَّ فَإِنَّ صَلاَتَكُمْ تَبْلُغُنِي
“তোমরা আমার কবরকে ঈদ বানাবে না এবং তোমাদের বাড়িগুলিকে কবর বানাবে না, যেখানেই থাকনা কেন আমার উপর সালাত পাঠ করবে; কারণ তোমাদের সালাত আমার কাছে পৌঁছে যাবে।”[16]
আল্লাহর কত দয়া! বিশ্ব নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকবে, ক’জনের জন্যই বা সম্ভব হবে রওযা মুবারাকে গিয়ে সালাত ও সালাম পাঠের। তাই তাদের জন্য দিলেন অফুরন্ত নিয়ামত। নিজ ঘরে বসে উম্মত সালাম জানাবে, সালাত পাঠ করবে, আর আল্লাহর ফিরিশতাগণ তা রাসূলে আকরাম (সা.)-এর রওযা মুবারাকায় পৌঁছে দেবেন।
এভাবে বিভিন্ন সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা সালাত পাঠকারীর জন্য বিশেষ সুখবর পাচিছ যে, তার সালাত সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ
(সা.)-এর নিকট পেশ করা হয়। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সালাত পাঠকারীর নাম ও পরিচয়ও রাসূলুল্লাহ (সা.) জানান হয়। আম্মর বিন ইয়াসির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
إن الله وكل بقبري ملَكا أعطاه أسماع الخلائق ، فلا يصلي عليَّ أحد إلى يوم القيامة إلا أبلغني باسمه واسم أبيه : هذا فلان ابن فلان قد صلى عليك
“মহান আল্লাহ আমার কবরে একজন ফিরিশতা নিয়োগ করছেন, যাকে সকল সৃষ্টির শ্রবণশক্তি প্রদান করা হয়েছে, কিয়ামত পর্যন্ত যখনই কোনো ব্যক্তি আমার উপর সালাত (দরুদ) পাঠ করবে তখনই ঐ ফিরিশতা আমাকে সালাত (দরুদ) পাঠকারীর নাম ও তাঁর পিতার নাম উল্লেখ করে আমাকে তাঁর সালাত (দরুদ) পৌঁছে দিয়ে বলবেঃ অমুকের ছেলে অমুক আপনার উপর সালাত (দরুদ) প্রেরণ করেছে।”
হাদীসটির সনদে দুর্বলতা আছে। তবে এই অর্থে আরো কয়েকটি দুর্বল সনদের হাদীস আল্লামা সাখাবী তাঁর সালাত বিষয়ক বই “আল- কবাওলুল বাদীয়”[17] গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যে সকল হাদীস থেকে বুঝা যায় সালাত পাঠকারীর সালাত যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে পেশ করা হয় তখন সালাত পাঠকারীর নাম ও পিতার নামসহ তার পরিচয় তাঁর দরবারে পেশ করা হয়। একই বিষয়ে কয়েকটি দুর্বল বা যয়ীফ হাদীস বর্ণিত হলে বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে, যাকে মুহাদ্দিসগণ ‘হাসান লিগাইরিহী’ বলেন। এ হাদীসটিও এভাবে ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য।[18]
আমরা অন্যান্য সহীহ হাদীসের আলোকে জেনেছি যে, আমাদের সালাত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে পৌঁছান হয়। পরের হাদীসগুলির আলোকে আমরা আরো আশা করছি যে, আমাদের সালাত তাঁর দরবারে পৌঁছানর সময় আমাদের ও আমাদের পিতাদের নামও তাঁর মুবারক দরবারে উচ্চারিত হয়। আমাদের জন্য এর চেয়ে গৌরবের ও আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে?
(৪) রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাত পাঠকারীর জন্য দু‘আ করবেন
কিন্তু প্রিয় পাঠক, এর চেয়েও আনন্দের বিষয় আপনাকে জানাচ্ছি। আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন
من صلى علي صلاة صليت عليه عشرا، وفى لفظ: بلغتني صلاته وصليت عليه
“কেউ আমার উপর একবার সালাত (দরুদ) প্রেরণ করলে আমি তাঁর উপর ১০ বার সালাত (দু‘আ) করি। দ্বিতীয় বর্ণনায় : কেউ
আমার উপর সালাত প্রেরণ করলে তা আমার কাছে পৌঁছান হয় এবং আমি তাঁর উপর সালাত প্রেরণ করি।” হাদীসটির সনদ হাসান বা গ্রহণযোগ্য।[19]
সম্মানিত পাঠক, সালাত পাঠকারীর জন্য এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জন্য দু‘আ করবেন। শুধু তাই নয় একবর দরুদের জন্য তিনি ১০ বার দু‘আ করবেন। সুব‘হা-নাল্লাহ ! কত বড় পুরস্কার!!
(৫) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শাফায়াত লাভের ওসীলা
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, সালাত পাঠকারীর জন্য আখেরাতের মুক্তি, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শাফায়াত ও জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে। আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
من صلى علي حين يصبح عشرا وحين يمسي عشرا أدركته شفاعتي يوم القيامة
“যে ব্যক্তি সকালে আমার উপর ১০ বার সালাত (দরুদ) পাঠ করবে এবং সন্ধ্যায় ১০ বার আমার উপর সালাত পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত লাভের সৌভাগ্য তাঁর হবে।” হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।[20]
যিকর নং ৩৪ : আরেকটি মাসনূন সালাত
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَنْزِلْهُ الْمَقْعَدَ الْمُقَرَّبَ مِنْكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, স্বাল্লি ‘আলা- মুহাম্মাদিন, ওয়া আনযিলহুল মাক্ব‘আদাল মুক্বাররাবা ‘ইনদাকা ইয়াওমাল ক্বিয়ামাহ।
অর্থঃ “হে আল্লাহ মুহাম্মাদের উপর সালাত (দরুদ) প্রেরণ করুন এবং তাঁকে কিয়ামতের দিন আপনার নৈকট্যপ্রাপ্ত অবস্থানে অবতীর্ণ করুন।”
রুআইফি বিন সাবিত আনসারী (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
من قال ... وجبت له شفاعتي
যে ব্যক্তি উপরের কথাগুলি (সালাতটি) বলবে, তার জন্য আমার শাফায়াত পাওনা হবে। হাদীসটির সনদে একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন, তবে আল্লামা হায়সামী ও মুনযিরী হাদীসটিকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলেছেন।[21]
এই অর্থে অন্য হাদীসে ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
أَوْلَى اَلنَّاسِ بِي يَوْمَ اَلْقِيَامَةِ, أَكْثَرُهُمْ عَلَيَّ صَلَاةً
“কিয়ামতের দিন মানুষদের মধ্য থেকে সেই ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী (আমার শাফায়তের সবচেয়ে বেশি হকদার) হবে, যে সবচেয়ে বেশি আমার উপর সালাত (দরুদ) পাঠ করে।” হাদীসটির সনদে দুর্বলতা আছে। তবে এই অর্থের অন্যান্য হাদীসের সমন্বয়ে হাদীসটি হাসান বলে গণ্য। এই অর্থে আবু উমামা (রাঃ) থেকে কিছুটা দুর্বল সনদে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[22]
অন্য একটি দুর্বল সনদের হাদীসে বলা হয়েছেঃ
من صلى علي في يوم ألف مرة لم يمت حتى يرى مقعده من الجنة
“যদি কেউ দিনে ১ হাজার বার আমার উপর সালাত (দরুদ) পাঠ করে তাহলে জান্নাতে তাঁর অবস্থান স্থল না দেখে তাঁর মৃত্যু হবে না (মৃত্যুর পূর্বেই তার জান্নাতের ঘর দেখার সৌভাগ্য হবে)।” হাদীসটির সনদ দুর্বল।[23]
অন্য হাদীসে সামুরা বিন জুনদুব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
رأيت البارحة عجباً رجلا من أمتي يزحف على الصراط ويحبوا أحيانا ويتعلق أحياناًفجاءته صلاته على فأقامته على قدميه وأنقذته
“আমি গত রাতে একটি অদ্ভুৎ স্বপ্ন দেখলাম (তাঁর স্বপ্নও ওহী), আমি দেখলাম আমার উম্মতের এক ব্যক্তি সিরাতের (পুলসিরাতের) উপর বুকে হেটে চলেছে, কখনো বা হামাগুড়ি দিচ্ছে, কখনো বা ঝুলে পড়ছে (অর্থাৎ, সে পুলসিরাত পার হতে পারছে না, খুবই কষ্ট হচ্ছে) এমতাবস্থায় আমার উপর পাঠকৃত তার সালাত এসে তাকে সোজাভাবে সিরাতের উপর সোজা দু’পায়ে দাঁড় করিয়ে দিল এবং তাকে উদ্ধার করল।”
ইবনুল কাইয়েম ও সাখাবীর আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, হাদীসটির সনদে দুর্বলতা থাকলেও তা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বা আলোচনাযোগ্য।[24]
[2] নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৬/২১, মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৪৯৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬২। হাদিসটির সনদ হাসান।
[3] নাসাঈ, কিতাবুস সাহউ, নং ১২৯৭, মুসনাদ আহমাদ ১১৫৮৭, ১৩৩৪৩।
[4] মুসনাদ আহমাদ ৪/২৯, মাকদিসী, আল-আহাদীস আল-মুখতারাহ ১/১৮৭, মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৪৯৪।
[5] হাদিসটি নাসাঈ তার সুনানে বর্ণনা করেছেন, কিতাবুস সাহউ, নং ১২৮৩, ১২৯৫ ও আহমাদ মুসনাদে বর্ণনা করেছেন, মুসনাদুল মাদানিয়্যীন, নং ১৫৯২৬, ১৫৯২৮, হাদিসটির সনদ মোটামুটি নির্ভরযোগ্য।
[6] মুসনাদ আহমাদ ১/১৯১, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩৪৪-৩৪৫, ৭৩৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৮৭। হাদিসটি সহীহ।
[7] সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সালাত, নং ৩৮৪।
[8] যয়ীফুল আদাবিল মুফরাদ ৬৩ পৃ. নং ১০০/৬৪০, সাখাবী, আল-কাউলুল বাদী, পৃ. ১২৭।
[9] মুসনাদ আহমাদ ৩/৪৪৫, ইবনু মাজাহ ১/২৯৪, নং ২০৭, সহীহ সুনানু ইবনু মাজাহ ১/২৭৩, মুনযিরী আত-তারগীব ২/৪৯৭-৪৯৮।
[10] মুসনাদ আহমাদ ২/১৭২, ১৮৭, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬০, আত-তারগীব ২/৪৯৩।
[11] সুনানুন নাসাঈ, ৩/৯১, নং ১৩৭৪, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৩৪৫, ৫২৪, নং ১০৮৫, ১৬৩৬, আহমাদ ৪/৮, সহীহ ইবনু খুযাইমা ৩/১১৮, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১৯১, মুসতাদরাক হাকিম ১/৪১৩, ৬০৪, আত-তারগীব ২/৫০১-৫০২।
[12] বাইহাকী, হায়াতুল আম্বিয়া ১০৩-১০৫ পৃ. সাখাবী, আল-কাউলুল বাদী ১৫৪ পৃ.।
[13] বাইহাকী, হায়াতুল আম্বিয়া ১০৩-১০৫, শু’আবুল ঈমান ২/২১৮, আউনুল মাবুদ ৬/২১, ২২, যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/৩২৮, উকাইলী, আদ-দু’আফা ৪/২৩৬, আলবানী, সিলসিলাতুয যয়ীফাহ ১/৩৬৬-৩৭৯, নং ২০৩।
[14] হাফিয মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৪৯৬, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬২।
[15] মুসনাদে আবী ইয়ালা ১২/১৩১, নং ৬৭৬১, হাইসামী মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪৭ এ হাদিসটি উল্লেখ করেছেন এবং সনদে দুর্বলতা থাকলেও একাধিক সনদের কারণে হাদিসটি শক্তিশালী বলেছেন।
[16] মুসনাদ আহমাদ ৮৫৮৬।
[17] দেখুন ১৫৩-১৫৫।
[18] আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ২/৩৮৮ ও মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬২, সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সহীহাহ ৪/৪৩-৪৫, নং ১৫৩০।
[19] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ২/১৭৮, ১৬৪২, ৩/১৯০, পৃ. ২৬৯২, হাইসামী মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৩, মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৪৯৬।
[20] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১২০।
[21] মুসনাদ আহমাদ ২/৩৫২, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ৫/২৫-২৬, নং ৪৪৮০, ৪৪৮১, আল-মু’জামুল আউসাত ৩/৪৫৬, নং ৩২৯৭, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৩, আত-তারগীব ২/৫০২-৫০৩।
[22] সুনানুত তিরমিযী ২/৩৫৪, নং ৪৮৪, বাইহাকী আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৯, মুসনাদ আবী ইয়ালা ৮/৪২৮, আত-তারগীব ২/৪৯৭, সাখাবী, আল-কাউলুল বাদী, পৃ. ১৩০-১৩১।
[23] ইবনুল কাইয়েম, জালাউল আউহাম, পৃ. ৩০, সাখাবী, আল-কাউলুল বাদী, পৃ. ১২৬।
[24] ইবনুল কাইয়েম, জালাউল আউহাম, পৃ. ২৩৫, সাখাবী, আল-কাউলুল বাদী, পৃ. ১২৪।