রাহে বেলায়াত প্রথম অধ্যায় - বেলায়াত ও যিকর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
জ. মাসনূন যিকরের শ্রেণীবিভাগ - ৭. দু‘আ বা প্রার্থনা বিষয়ক বাক্যাদি - (খ) দু‘আর সুন্নাত-সম্মত নিয়ম ও আদব - ষষ্ঠ ভাগ

১৯. দু‘আর সময় হাত উঠানো


আমরা দেখেছি যে, মুমিন বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে বা যে কোনো অবস্থায় দু‘আ করতে পারেন। তবে দু‘আর একটি বিশেষ আদব

দুই হাত বুক পর্যন্ত বা আরো উপরে ও আরো বেশি এগিয়ে দিয়ে, হাতের তালু উপরের দিকে বা মুখের দিকে রেখে, অসহায় করুণাপ্রার্থীর ন্যায় কাকুতি মিনতির সাথে দু‘আ করা।

দু‘আর সময় হাত উঠানোর বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কতগুলি হাদীস দু‘আর জন্য হাত উঠানোর ফযীলত সম্পর্কিত। অন্য দু’একটি হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু (সা.) ও সাহাবীগণ কখনো কখনো দু‘আর জন্য হাত উঠাতেন।

প্রথম প্রকারের একটি হাদীস ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো বান্দা হাত তুলে দু‘আ করলে মহান আল্লাহ সেই হাত খালি ফিরিয়ে দিতে চান না। অন্য হাদীসে মালিক ইবনু ইয়াসার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إذا سألتم الله فاسألوه ببطون أكفكم ولا تسألوه بظهورها


“তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাইবে, তখন হাতের পেট বা ভিতরের দিক দিয়ে চাইবে, হাতের পিঠ দিয়ে চাইবে না।” হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।[1]

এছাড়া কয়েকটি হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ কোনো কোনো সময়ে দু‘আ করতে দুই হাত তুলে দু‘আ করতেন।


সালমান ফারসী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

مَا رَفَعَ قَوْمٌ أَكُفَّهُمْ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ يَسْأَلُونَهُ شَيْئًا إِلا كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ أَنْ يَضَعَ فِي أَيْدِيهِمُ الَّذِي سَأَلُوا


“যখনই কিছু মানুষ আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার জন্য তাদের হাতগুলিকে উঠাবে, তখনই আল্লাহর উপর হক্ক বা নির্ধারিত হয়ে যাবে যে তিনি তারা যা চেয়েছে তা তাদের হাতে প্রদান করবেন।” হাফিয হাইসামী হাদীসটির সনদ সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে শেখ আলবানী হাদীসটিকে যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন।[2]

আয়েশা (রাঃ) বলেন,

إن رسول الله صلى الله عليه وسلم يرفع يديه يدعو حتى إنى لأسأم له مما يرفعهما يدعو اللهم فإنما أنا بشر فلا تعذبنى بشتم رجل شتمته أو آذيته


“রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর মুবারক হাত দু’খানা উঠিয়ে দু‘আ করতেন, এমনকি আমি তাঁর (বেশি বেশি) হাত উঠিয়ে দু‘আ করাতে ক্লান্ত ও অস্থির হয়ে পড়তাম; তিনি এভাবে দু‘আয় বলতেনঃ হে আল্লাহ, আমি একজন মানুষ মাত্র। আমি কোনো মানুষকে গালি দিয়ে ফেললে বা কষ্ট দিলে আপনি সেজন্য আমাকে শাস্তি দিবেন না। হাদীসটির সনদ সহীহ।[3]

অনুরূপ বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, বৃষ্টির জন্য দু‘আর সময়, আরাফাতের মাঠে দু‘আর সময়, যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার সময় ও অন্যান্য কোনো কোনো সময়ে দু‘আর জন্য তিনি হাত তুলেছেন।[4]


উপরের হাদীসগুলি থেকে আমরা দু‘আর সময় হাত তুলে দু‘আ করার ফযীলত জানতে পারছি। তবে এক্ষেত্রেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই ফযীলত পালনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণই পূর্ণতম আদর্শ। তাঁদের সুন্নাতের আলোকেই আমাদের এই ফযীলত পালন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) হাত তুলে দু‘আ করার ফযীলত বর্ণনা করেছেন। এই ফযীলত পালনের ক্ষেত্রে তাঁর ও তাঁর সাহাবীগণের কর্ম ছিল কখনো কখনো হাত তুলে দু‘আ করা এবং সাধারণ ক্ষেত্রে হাত না তুলে শুধুমাত্র মুখে দু‘আ করা। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, হাত উঠানো দু‘আর আদব এবং একান্ত মুস্তাহাব পর্যায়ের সুন্নাত, অর্থাৎ পালন করলে ভালো, না করলে কোনো দোষ নেই। একে বেশি গুরুত্ব দিলে, হাত না উঠালে ‘কিছু খারাপ হলো’ মনে করলে - তা খেলাফে সুন্নাত হবে।

যেখানে ও যে দু‘আয় রাসূলুল্লাহ (সা.) হাত উঠিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে সেখানে হাত উঠানো সুন্নাত। যেখানে উঠাননি বলে জানা গিয়েছে সেখানে হাত না উঠানো সুন্নাত। চলাফেরা, উঠাবসা, খাওয়া-দাওয়া, মসজিদে প্রবেশ, মসজিদ থেকে বের হওয়া, ওযুর পরে, খাওয়ার পরে, আযানের পরে, সালাতের পরে ইত্যাদি দৈনন্দিন মাসনূন দু‘আর ক্ষেত্রে হাত না তুলে স্বাভাবিক অবস্থায় মুখে দু‘আ করাই সুন্নাত। যে সকল দু‘আ মাসনূন, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর সাহাবীগণ যে সকল দু‘আ বা যে সকল সময়ে দু‘আ করেছেন, অথচ তাঁরা হাত উঠিয়েছেন বলে বর্ণিত নেই, সেসকল স্থানে নিয়মিত হাত উঠনোকে রীতি বানিয়ে নেওয়া বা হাত উঠানোকে উত্তম মনে করা আমাদেরকে বিদ‘আতে নিপতিত করবে। বাকি সকল ক্ষেত্রে হাত উঠানো ও না উঠানো উভয়ই জায়েয। আবেগ, আগ্রহ ও বিশেষ দু‘আর সময় হাত তুলে আকুতির সাথে দু‘আ করা উত্তম।


এখানে আমাদের সাধারণ মুসলমানদের মনের একটি ভুল ধারণা দূর করা দরকার। আমরা সর্বদা দুই হাত তুলে প্রার্থনা করাকে মুনাজাত বলে মনে করি। মুখে কোনো দু‘আ পাঠ বা মুখে মুখে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করাকে কখনই মুনাজাত বলে মনে করি না। এটি একেবারেই ভিত্তিহীন ধারণা। এই ধারণাটি শুধু ভিত্তিহীনই নয়, বরং সত্যের বিপরীত। আমরা উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি যে, ‘মুনাজাত’ অর্থ সকল প্রকার যিকর, দু‘আ, প্রার্থনা। হাত উঠানো হোক বা না হোক, শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, হাঁটতে চলতে বা যে কোনো সময় বান্দা যখন আল্লাহর কথা স্মরণ করে, তাঁকে ডাকে, তাঁর কাছে কিছু চায় বা এক কথায় তাঁর সাথে সঙ্গোপনে কথা বলে তখন বান্দা মুনাজাতে রত থাকে। তেমনি হাত উঠানো হোক বা না হোক, শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে বা যে কোনো অবস্থায় বান্দা যখন আল্লাহকে ডাকে বা তাঁর কাছে কিছু চায় সে তখন দু‘আয় রত থাকে। মুনাজাত ও দু‘আ মূলত একই বিষয়। আর হাত উঠানো, কিবলামুখী হওয়া, বসা, ইত্যাদি দু‘আ বা মুনাজাতের বিভিন্ন আদব। এগুলিসহ বা এগুলি ব্যতিরেকে বান্দা আল্লাহর সাথে ‘মুনাজাতে’ বা চুপিসারে কথায় রত থাকতে পারে বা প্রার্থনায় রত থাকতে পারে।

[1] সুনানু আবী দাউদ ২/৭৮, নং ১৪৮৬, সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ ২/১৪২-১৪৪, নং ৫৭৫।

[2] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ৬/২৫৪, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৯, মানাবী, ফাইযুল কাদীর ৫/৪৪৭, আলবানী যয়ীফুল জামি’ পৃ. ৭৩৩, নং ৫০৭০।

[3] মুসনাদ আহমাদ ৬/১৬০, ২২৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৮।

[4] বিস্তারিত দেখুনঃ সুয়ূতী, ফাদ্দুল বি’আ ফী আহাদিসী রাফইল ইয়াদাইনি ফিদ্দুআ পৃ. ৪১-১০২, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৬৮-১৬৯।