২. ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ
দু‘আ কবুলের একটি বিশেষ আমল, সাধ্যমতো সমাজের মানুষদেরকে সৎকাজে আদেশ করা ও অন্যায় থেকে নিষেধ করা। বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন কোনো মুসলিম সমাজের মানুষ এই ইবাদত পরিত্যাগ করবে তখন আল্লাহ সেই সমাজের খারাপ মানুষদেরকে সমাজের কর্ণধার বানিয়ে দেবেন এবং ভালো ও নেককার মানুষদের দু‘আও কবুল করবেন না। একটি হাদীসে হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বলেন, নবীয়ে আকরাম (সা.) বলেছেনঃ
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللَّهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُونَهُ فَلا يَسْتَجِيبُ لَكُمْ
“যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, তোমরা অবশ্যই ভালোকাজে মানুষদেরকে নির্দেশ প্রদান করবে এবং অবশ্যই অন্যায় থেকে মানুষদেরকে নিষেধ করবে। যদি তা না কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা তাঁর নিকট প্রার্থনা করলেও তিনি তা কবুল করবেন না।”[1]
এই অর্থে আয়েশা (রাঃ), আবু হুরাইরা (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[2]
৩. সুন্নাতের অনুসরণ
সুন্নাতের গুরুত্ব ও বিদ’আতের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি “এহ্ইয়াউস সুনান” গ্রন্থে। আমরা দেখেছি যে, সুন্নাত অনুসারে সামান্য ইবাদত বিদ‘আত মিশ্রিত অনেক ইবাদতের চেয়ে উত্তম। আমরা আরো দেখেছি যে সুন্নাতের বাইরে বা সুন্নাতের অতিরিক্ত কোনো ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না, ইবাদতকারী যত ইখলাস ও আবেগসহ তা পালন করুন না কেন। যিকর, দু‘আ ইত্যাদিও এই সাধারণ বিধানের অন্তর্ভুক্ত। তবে দু’আর ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা পাই আমরা হাদীসে। আনাস (রাঃ) নবীয়ে আকরাম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ
ان الله عز وجل يستحه من ذى الشيبة المسلم اذا كان مسددا لزوما للسنة أن يسأل الله فلا تعطيه
“কোনো বয়স্ক বা বৃদ্ধ মুসলিম যদি সৎকর্মশীল হন এবং সুন্নাত আঁকড়ে ধরে থাকেন তাহলে তিনি কোনো কিছু আল্লাহর কাছে চাইলে আল্লাহ তাঁর প্রার্থিত বস্তু না দিতে লজ্জা পান (আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা পূরণ করেন)।” হাদীসটির সনদ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।[3]
৪. সদা সর্বদা দু‘আ করা
মানব চরিত্রের একটি বিশেষ দিক, শান্তি ও আননেদর সময়ে আল্লাহকে ভুলে থাকা, বা বিশেষ দু‘আ, আকুতি ও প্রার্থনা না করা। বিপদে পড়লে বেশি বেশি দু‘আ করা। নিঃসন্দেহে এই আচরণ মহান রাব্বুল আ’লামীনের প্রকৃত দাসত্বের অনুভূতি, তাঁর উপর আস্থা ও বিশ্বাস না থাকার প্রকাশ। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে এই স্বভাবের কথা উল্লেখ ও নিন্দা করা হয়েছে। এক স্থানে ইরশাদ করা হয়েছেঃ
وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَىٰ بِجَانِبِهِ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ فَذُو دُعَاءٍ عَرِيضٍ
“যখন আমি মানুষকে নিয়ামত প্রদান করি তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও দূরে সরে যায়। আর যখন কোনো অমঙ্গল বা কষ্ট তাকে স্পর্শ করে তখন সে লম্বা চওড়া দু‘আ শুরু করে।”[4]
প্রকৃত মুমিনের উচিত সকল অবস্থায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। নিয়ামতের মধ্যে থাকলে তার স্থায়িত্ব প্রার্থনা করা ও সকল অকল্যাণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া। কোনো কষ্ট বা অসুবিধা থাকলে তার কাছে আশ্রয় ও মুক্তি চাওয়া। এ মুমিনের চরিত্র। মুমিনের অন্তর এভাবে শান্তি পায়। আর এই অন্তরের দু‘আই আল্লাহ কবুল করেন। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَسْتَجِيبَ اللَّهُ لَهُ عِنْدَ الشَّدَائِدِ فَلْيُكْثِرْ الدُّعَاءَ فِي الرَّخَاءِ
“যে চায় যে, আল্লাহ বিপদের সময় তার প্রার্থনায় সাড়া দিবেন, সে যেন সুখশান্তির সময় বেশি বেশি আল্লাহর কাছে দু‘আ করে।” হাদীসটি সহীহ।[5]
৫. বেশি করে চাওয়া
দুনিয়া ও আখেরাতের সবকিছুই আল্লাহর কাছে চাইতে হবে এবং বেশি করে চাইতে হবে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
اذا تمنى أحدكم فليكثر فإنما يسأل ربه
“তোমাদের কেউ যখন কামনা করবে, আশা করবে বা প্রার্থনা করবে তখন বেশি করে চাইবে; কারণ সে তো তার মালিকের কাছে চাচ্ছে (কাজেই, কম চাইবে কেন, তিনি তো অপারগ নন কৃপণও নন)।” হাদীসটির সনদ সহীহ।[6]
৬. কেবলমাত্র মঙ্গল কামনা
অনেক সময় আমরা আবেগ, বিরক্তি, রাগ, কষ্ট ইত্যাদির কারণে মনে মনে নিজের বা অন্যের ক্ষতিকর কোনো কিছু কামনা করি। বিষয়টি খুবই অন্যায়। অন্তরকে নিয়ন্ত্রিত করুন। সর্বদা কল্যাণময় বিষয় কামনা করুন। কষ্ট বা রাগের কারণে অকল্যাণজনক কিছু কামনা না করে এমন কল্যাণময় কিছু কামনা করুন যা কষ্ট, বেদনা বা রাগের কারণ চিরতরে দূরীভূত করবে।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
إذا تمنى أحدكم فلينظر ما يتمناه فإنه لا يدري ما يكتب له من أمنيته
“যখন তোমাদের কেউ কামনা বা প্রার্থনা করে তখন সে যেন চিন্তা ভাবনা করে কামনা বা প্রার্থনা করে, কারণ তার কোন্ কামনা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যাচ্ছে তা সে জানে না। (কাজেই, এমন কিছু যেন কেউ কামনা বা প্রার্থনা না করে যার জন্য পরে আফসোস করতে হয়)।” হাদীসটির সনদ সহীহ।[7]
অন্য হাদীসে উম্মু সালামাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
لَا تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ إِلَّا بِخَيْرٍ فَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ يُؤَمِّنُونَ عَلَى مَا تَقُولُونَ
“তোমরা নিজেদের উপর কখনো বদদু‘আ করবে না; কারণ ফিরিশতাগণ তোমাদের দু‘আর সাথে ‘আমীন’ বলেন।”[8] আরেক হাদীসে জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
لَا تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ وَلَا تَدْعُوا عَلَى أَوْلَادِكُمْ وَلَا تَدْعُوا عَلَى أَمْوَالِكُمْ لَا تُوَافِقُوا مِنْ اللَّهِ سَاعَةً يُسْأَلُ فِيهَا عَطَاءٌ فَيَسْتَجِيبُ لَكُمْ
“তোমরা কখনো নিজেদের বা তোমাদের সন্তানদের বা তোমাদের মালসম্পদের অকল্যাণ, অমঙ্গল বা ক্ষতি চেয়ে বদ দু‘আ করবে না। কারণ, হয়ত এমন হতে পারে যে, যে সময়ে তোমরা বদদু’আ করলে, সেই সময়টি এমন সময় যখন আল্লাহ বান্দার সকল প্রার্থনা কবুল করেন এবং যে যা চায় তাকে তা প্রদান করেন। এভাবে তোমাদের বদদু‘আও তিনি কবুল করে নেবেন।”[9]
৭. ফলাফলের জন্য ব্যস্ত না হওয়া
দু‘আর ক্ষেত্রে আমাদের বড় ক্ষতিকর একটি স্বভাব বা অভ্যাস দু‘আর ফল লাভে ব্যস্ত হওয়া। বিশেষত বিপদে, সমস্যায় বা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে আমরা যখন দু‘আ করি তখন তৎক্ষণাৎ ফল আশা করি। দুই চার দিন দু‘আ করে ফল না পেলে আমরা হতাশ হয়ে দু‘আ করা ছেড়ে দেই। এই হতাশা ও ব্যস্ততা ক্ষতি ও গোনাহের কারণ। কখনোই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, দু‘আ করা একটি ইবাদত ও অপরিমেয় সাওয়াবের কর্ম। আমি যত দু‘আ করব ততই লাভবান হব। আমার সাওয়াব বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর সাথে আমার একান্ত রহমতের সম্পর্ক তৈরি হবে। সর্বোপরি আল্লাহ আমার দু‘আ কবুল করবেনই। তবে তিনিই ভালো জানেন কিভাবে ফল দিলে আমার বেশি লাভ হবে।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
لَا يَزَالُ يُسْتَجَابُ لِلْعَبْدِ مَا لَمْ يَدْعُ بِإِثْمٍ أَوْ قَطِيعَةِ رَحِمٍ وَمَا لَمْ يَسْتَعْجِلْ
“বান্দা যতক্ষণ পাপ বা আত্মীয়তার ক্ষতিকারক কোনো কিছু প্রার্থনা না করে ততক্ষণ তার দু‘আ কবুল করা হয়, যদি না সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।” বলা হলোঃ “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ব্যস্ততা কিরূপ?” তিনি বলেনঃ “প্রার্থনাকারী বলতে থাকে - দু‘আ তো করলাম, দু‘আ তো করলাম ; মনে হয় আমার দু‘আ কবুল হলো না। এভাবে সে হতাশ হয়ে পড়ে এবং তখন দু‘আ করা ছেড়ে দেয়। “[10]
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
لا يزال العبد بخير ما لم يستعجل قالوا يا نبي الله وكيف يستعجل قال يقول قد دعوت الله ربى فلم يستجب لي
“বান্দা যতক্ষণ না ব্যস্ত ও অস্থির হয়ে পড়ে ততক্ষণ সে কল্যাণের মধ্যে থাকে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেনঃ ব্যস্ত হওয়া কিরূপ ? তিনি বলেনঃ সে বলে - আমি তো অনেক দু‘আ করলাম কিন্তু দু‘আ কবুল হলো না।” হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।[11]
৮. মনোযোগ ও কবুলের দৃঢ় আশা
আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, বান্দা যেভাবে তার প্রভুর প্রতি ধারণা পোষণ করবে, তাঁকে ঠিক সেভাবেই পাবে। কাজেই প্রত্যেক মুমিনের উপর দায়িত্ব, আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও ভালবাসার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় রাখা। আল্লাহ আমাকে ভালবাসেন, তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন এবং তিনি আমাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। এই দৃঢ় প্রত্যয় মুমিনের অন্যতম সম্বল ও মহোত্তম সম্পদ। প্রার্থনার ক্ষেত্রেও এই প্রত্যয় রাখতে হবে। অন্তরের গভীর থেকে মনের আকুতি ও সমর্পণ মিশিয়ে নিজের সবকিছু আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। সাথে সাথে সুদৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে, আল্লাহ অবশ্যই আমার প্রার্থনা শুনবেন এবং আমার ডাকে সাড়া দিবেন। তিনি অবশ্যই শুনবেন। ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
إِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ أَيُّهَا النَّاسُ فَسَلُوهُ وَأَنْتُمْ مُوقِنُونَ بِالْإِجَابَةِ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَسْتَجِيبُ لِعَبْدٍ دَعَاهُ عَنْ ظَهْرِ قَلْبٍ غَافِلٍ
“তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাইবে, তখন দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করবে যে, আল্লাহ অবশ্যই তা কবুল করবেন ও পূরণ করবেন। কারণ কোনো বান্দা অমনোযোগী অন্তরে দু‘আ করলে আল্লাহ তার দু‘আ কবুল করেন না।”[12]
অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
ادْعُوا اللَّهَ وَأَنْتُمْ مُوقِنُونَ بِالإِجَابَةِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ لا يَسْتَجِيبُ دُعَاءً مِنْ قَلْبٍ لاهٍ
“তোমরা আল্লাহর কাছে দু‘আ করার সময় দৃঢ়ভাবে (একীন) বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ নিশ্চয় কবুল করবেন। আর জেনে রাখ, আল্লাহ কোনো অমনোযোগী বা অন্য বাজে চিন্তায় রত মনের প্রার্থনা কবুল করেন না।”[13]
৯. নিজের জন্য নিজে দু‘আ করা
অনেক সাধারণ মুসলিম সাধারণত নিজের জন্য নিজে আল্লাহর দরবারে দু‘আ চাওয়ার চেয়ে অন্য কোনো বুজুর্গের কাছে দু‘আ চাওয়াকেই বেশি উপকারী বলে মনে করেন। পিতামাতা, উস্তাদ, আলিম বা নেককার কোনো জীবিত মানুষের কাছে দু‘আ চাওয়া জায়েয। তবে নিজের দু‘আ নিজে করাই সর্বোত্তম। আমরা অনেক সময় মনে করি, আমরা গোনাহগার, আমাদের দু‘আ কি আল্লাহ শুনবেন? আসলে গোনাহগারের দু‘আই তো তিনি শুনেন। আমার মনের বেদনা, আকুতি আমি নিজে আমার প্রেমময় প্রভুর নিকট যেভাবে জানাতে পারব সেভাবে কি অন্য কেউ তা পারবেন। এছাড়া এই দু‘আ আমার জন্য সাওয়াব বয়ে আনবে এবং আমাকে আল্লাহর প্রেম ও করুণার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি প্রশ্ন করলাম, “হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোত্তম দু‘আ কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ
دعاء المرء لنفسه
“মানুষের নিজের জন্য নিজের দু’আ”। হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।[14]
অন্যের জন্য দু’আ করলে প্রথমে নিজের জন্য দু’আ করা
মুমিন সর্বদা নিজের জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন। অন্য কারো জন্য দু’আ করলে তখন সেই সুযোগে নিজের জন্য দু’আ করা উচিত। যেমন, কারো রোগমুক্তির জন্য দু’আ করতে হলে বলা উচিত : ‘আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দান করুন এবং তাঁকেও সুস্থতা দান করুন’। অথবা, কেউ বললেন : ‘আমরা জন্য দু’আ করুন। তখন বলা উচিত : ‘আল্লাহ আমার কল্যাণ করুন ও আপনার কল্যাণ করুন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত কারো জন্য দু‘আ করলে প্রথমে নিজের জন্য দু‘আ করা। উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) বলেনঃ
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كان إذا ذكر أحدا فدعا له بدأ بنفسه
“রাসূলুল্লাহ (সা.) কারো কথা উল্লেখ করে দু‘আ করলে প্রথমে নিজের জন্য দু‘আ করতেন।” ইমাম তিরমিযী বলেন, ‘হাদীসটি হাসান সহীহ গরীব।’[15]
কোনো নবীর কথা উল্লেখ করলে তিনি প্রথমে নিজের জন্য দু‘আ করে এরপর সেই নবীর জন্য দু’আ করতেন। বলতেনঃ
رَحْمَةُ اللَّهِ عَلَيْنَا وَعَلَى كَذا ... رَحْمَةُ اللَّهِ عَلَيْنَا وَعَلَى مُوسَى
“আমাদের উপর আল্লাহর রহমত এবং আমাদের অমুক ভাইয়ের উপর।” যেমন, বলতেনঃ “আমাদের উপর আল্লাহর রহমত এবং মূসার উপর।”[16]
আবু আইউব আনসারী (রাঃ) বলেনঃ
ان النبي صلى الله عليه وسلم كان اذا دعا بدأ بنفسه
নবী (সা.) যখন দু’আ করতেন তখন নিজেকে দিয়ে শুরু করতেন।[17]
১০. অনুপস্থিতদের জন্য দু’আ করা
প্রত্যেক মুমিনের উচিত, তিনি যখন আল্লাহর দরবাবে প্রার্থনা করবেন, তখন শুধুমাত্র নিজের জন্য দু‘আ না করে অন্যান্য মুসলিম ভাইবোনের জন্যও দু‘আ করবেন। বিশেষত যাদেরকে তিনি আল্লাহর জন্য মহব্বত করেন, যারা কোনো সমস্যা বা বিপদে আছে বলে তিনি জানেন বা যারা তার কাছে দু‘আ চেয়েছে। সকল বিশ্বের নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য দু‘আ করা প্রয়োজন। কারো অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু‘আ করলে উক্ত দু‘আ আল্লাহ কবুল করবেন এবং প্রার্থনাকারীকেও উক্ত নিয়ামত দান করবেন বলে বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে।
তাবেয়ী সাফওয়ান ইবনু আব্দুল্লাহ বলেন, আমি সিরিয়ায় গিয়ে (আমার শ্বশুর) আবু দারদার (রাঃ) বাসায় দেখা করতে গেলাম। তিনি বাসায় ছিলেন না। (আমার শাশুড়ি) উম্মু দারদা আমাকে বললেনঃ তুমি কি এ বছর হজ্ব করতে যাচ্ছ? আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তাহলে আমাদের মঙ্গলের জন্য দু‘আ করবে। একথা বলে তিনি বলেন, আবু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ عِنْدَ رَأْسِهِ مَلَكٌ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لأَخِيهِ بِخَيْرٍ قَالَ الْمَلَكُ الْمُوَكَّلُ بِهِ آمِينَ وَلَكَ بِمِثْلٍ
“কোনো মুসলিম যখন তার কোনো অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দু‘আ করে তখন আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন। তার মাথার কাছে একজন ফিরিশতা নিয়োজিত থাকেন। যখনই ঐ মুসলিম তার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য কোনো কল্যাণ বা মঙ্গল চায়, তখনই ফিরিশতা বলেনঃ আমীন, এবং আপনার জন্যও অনুরূপ।”[18]
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
إذا دعا المرء لأخيه بظاهر الغيب قالت الملائكة : آمين ولك بمثله
“যখন কোনো মানুষ যখন তার কোনো অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দু‘আ করে, তখন ফিরিশতাগণ বলেনঃ আমীন, এবং আপনাকেও আল্লাহ অনুরূপ বস্তু প্রদান করেন। (অর্থাৎ, আল্লাহ আপনার ভাইয়ের জন্য এই দু‘আ কবুল করুন এবং আপনি আপনার ভাইয়ের জন্য যা চাচ্ছেন আল্লাহ আপনাকেও তা দান করুন)।”[19]
রাসূলুল্লাহ (সা.) দুর্বল ও নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য মাঝে মাঝে ফজর, মাগরিব বা অন্য সালাতের শেষ রাকাতের রুকুর পরে দু’আ করতেন। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ
وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم حين يرفع رأسه يقول: سمع الله لمن حمده ربنا ولك الحمد، ثم يدعو لرجال فيسميهم بأسمائهم فيقول: اللهم أنج الوليد بن الوليد، وسلمة بن هشام، وعياش بن أبي ربيعة والمستضعفين من المؤمنين اللهم اشدد وطأتك على مضر اللهم اجعلها سنين كسني يوسف
“রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন রুকু থেকে মাথা উঠাতেন তখন ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’, ‘রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ বলে নাম উল্লেখ করে করে অনেকের জন্য দু‘আ করতেন। তিনি বলতেনঃ আল্লাহ, আপনি ওলীদ ইবনুল ওলীদ, সালামাহ ইবনু হিশাম, আইয়াশ ইবনু আবী রাবীআহ এবং দুর্বল মুমিনদেরকে রক্ষা করুন। হে আল্লাহ আপনি মুদার গোত্রকে কঠিনভাবে পাকড়াও করুন এবং ইউসূফ (আ.)-এর দুভিক্ষের ন্যায় দুর্ভিক্ষের মধ্যে নিপতিত করুন।”[20]
মুসনাদে বাযযারের বর্ণনায় হাদীসটি নিম্নরূপ :
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم رفع رأسه بعدما سلم وهو مستقبل القبلة فقال اللهم خلص سلمة بن هشام وعياش بن أبي ربيعة والوليد بن الوليد وضعفة المسلمين الذين لا يستطيعون حيلة ولا يهتدون سبيلا
“রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাতের সালাম ফেরানোর পরে কিবলামুখী বসা অবস্থায় মাথা উঠিয়ে বলেনঃ আল্লাহ সালামাহ ইবনু হিশাম, আইয়াশ ইবনু আবী রাবিয়াহ, ওলীদ ইবনু ওলীদ ও দুর্বল মুসলমানদেরকে (মক্বার কাফেরদের হাত থেকে) রক্ষা করুন, যারা তাদের হাত থেকে বেরিয়ে চলে আসার কোনো পথ পাচ্ছে না।”
বাযযারের সনদ মোটামুটি গ্রহণ যোগ্য।[21] উপরের বর্ণনাটি বেশি প্রসিদ্ধ। সম্ভবত, কখনো কখনো তিনি সালাতের পরেও এভাবে দু‘আ করেছিলেন।
[2] সুনানু ইবনি মাজাহ ২/১৩২৭, নং ৪০০৪, তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ২/৯৯ (নং ১৩৭৯), মুসনাদ আহমাদ ৫/৩৯০, জামিউল উসূল ১/৩২৭-৩৩২, মাযমাউয যাওয়াইদ ৭/২৬৬, রিয়াযুস সালেহীন, পৃঃ ৯২-৯৭, তারীখ বাগদাদ ১৩/৯২।
[3] তাবারানী, আল-আউসাত, মাযমাউয যাওয়াইদ ১০/১৪৯।
[4] সূরা ফুসসিলাতঃ ৫১।
[5] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৬২, নং ৩৩৮২, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭২৯।
[6] তাবারানী, মু’জামুল আওসাতে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫০।
[7] ইমাম আহমাদ সহীহ সনদে মুসনাদে হাদিসটি সংকলিত করেছেন। মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫১।
[8] সহীহ মুসলিম ২/৬৩৪, নং ৯২০।
[9] সহীহ মুসলিম ৪/২৩০১-২৩০৪, নং ৩০০৬।
[10] সহীহ মুসলিম ৪/২০৯৬, নং ২৭৩৫।
[11] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৪৭।
[12] হাদিসটির সনদ হাসান। মুসনাদ আহমাদ, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৪৮।
[13] হাদিসটির সনদ যয়ীফ। সুনানুত তিরমিযী ৫/৫১৭, মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৭০।
[14] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫২।
[15] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৬৩, নং ৩৩৮৫, সুনানু আবী দাউদ ৪/৩৩, নং ৩৯৮৪।
[16] সহীহ মুসলিম ৪/১৮৫১, নং ২৩৮০।
[17] হাদিসটির সনদ হাসান বা গ্রহণযোগ্য। মুসনাদ আহমাদ ৫/১২১, ১২২, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ৪/১৮২, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫২।
[18] সহীহ মুসলিম ৪/২০৯৪, নং ২৭৩২, ২৭৩৩।
[19] হাদিসটির সনদ সহীহ। মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫২।
[20] সহীহ বুখারী ১/২৭৭, নং ৭৭১, সহীহ মুসলিম ১/৪৬৬, ৪৬৭, নং ৬৭৫।
[21] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫২।