রাহে বেলায়াত প্রথম অধ্যায় - বেলায়াত ও যিকর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
জ. মাসনূন যিকরের শ্রেণীবিভাগ - ১. আল্লাহর একত্ব প্রকাশক বাক্যাদি

যিকর নং ১ : (لا اله الا الله) ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই)।


এটি এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রথম যিকর। লক্ষণীয় যে, হাদীস শরীফে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যিকরের জন্য কোনো সময় বা

সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি। সর্বদা বেশি বেশি করে এই যিকর করতে বলা হয়েছে। বর্তমানে অনেক আবেগী ইসলাম-প্রিয় সাধারণ মানুষ ও আলিম ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-কে যিকর হিসাবে পালন করাকে অযৌক্তিক বলে মনে করেন বা করতে চান। তারা বলেন, এই কালেমাই ঈমান। একবার সর্বান্তকরণে বললেই হলো। এরপরের কাজ নিজের জীবনে, সমাজে ও রাষ্ট্রে এই কালেমাকে প্রতিষ্ঠা করা। বারবার আউড়ে কী হবে? বিবাহের কালেমা ও ইজাব কবুল তো একবারই বলা হয়। এতেই আজীবন স্বামীর ঘর করতে হয়। বারবার আউড়ানোর কোনো প্রয়োজন হয় না।

কথাটি শুনতে খুব যৌক্তিক মনে হলেও কিছুটা বিভ্রান্তিকর ও ইসলাম বিরোধী। কালেমার ঘোষণার মাধ্যমে ঈমান আনার পর আল্লাহর পরিপূর্ণ আনুগত্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে হবে একথা অবশ্যই ঠিক। কেউ যদি তার উপর অর্পিত ফরয দায়িত্ব পালন না করে নফল যিকরে রত থাকেন তাহলে তার এই কর্ম বাতুলতা ও ইসলামের শিক্ষা বিরোধী। কিন্তু এজন্য এই কালেমার যিকরকে অর্থহীন বললে মহানবী (সা.)- কেই অবমাননা করা হয়। কারণ, তিনি নিজেই এই কালেমাকে বেশি বেশি পাঠ করে যিকর করতে বলেছেন।

‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বাক্যটি বারবার জপ করার মাধ্যমে আল্লাহর যিকর করার নির্দেশনায় এবং এই যিকরের অচিন্ত্যনীয় ফযীলতের ঘোষণায় অগণিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[1] আসলে ঈমান আনার পরে ঈমানকে মজবুত করতে ও নবায়ন করতে এই যিকর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে সুন্নাতের আলোকে আমরা জানতে পারি। জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

أَفْضَلُ الذِّكْرِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ الحَمْدُ لِلَّهِ


“সর্বোত্তম যিকর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং সর্বোত্তম দু‘আ আলহামদুলিল্লাহ।” হাদীসটি সহীহ।[2]


তবে যতবারই বলতে হবে ততবারই অন্তরের ভালবাসা ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা নিয়ে বলতে হবে। যিকরের অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে অন্তরকে যিকরের সাথে সাথে আলোড়িত করতে হবে। বারবার উচ্চারণের সাথে সাথে নতুন করে ঈমানকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করতে হবে। যাকির অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রতিবার যিকর উচ্চারণের সাথে সাথে নিজের ক্বলব বা মন থেকে আল্লাহ ছাড়া সকল উপাস্য ও সকল আরাধ্যকে দূর করে দেবে। আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুর অস্তিতবই সে তাঁর মন থেকে সরিয়ে দেবে। একমাত্র আল্লাহ, তাঁরই ভয়, তাঁরই ভালবাসা, তাঁরই উপর নির্ভরতা, তাঁরই উপাসনা, তাঁর কাছেই চাওয়া, তাঁকেই চাওয়া হবে মুমিনের অন্তরের একমাত্র অনুভূতি। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) এই ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে এই যিকর উচ্চারণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এই যিকরের মাধ্যমে ঈমানকে নবায়ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন।


আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেছেনঃ

أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ


“কিয়ামতের দিন সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আমার শাফা’আত লাভ করবে, যে তাঁর অন্তরের পরিপূর্ণ একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততা দিয়ে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।” [3]

আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছিঃ

إِنِّي لَأَعْلَمُ كَلِمَةً لَا يَقُولُهَا عَبْدٌ حَقًّا مِنْ قَلْبِهِ فَيَمُوتُ عَلَى ذَلِكَ إِلَّا حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ : لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ


“আমি এমন একটি বাক্য জানি, যে বাক্যটি যদি কেউ তাঁর অন্তর থেকে সত্যিকারভাবে বলে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে জাহান্নাম তাঁর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। বাক্যটিঃ ‘লা- ইলাহা ইল্লল্লাহ’।” হাদীসটি সহীহ।[4]


কাজেই মুমিন সর্বান্তকরণে অন্তরের সকল আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে বারবার এই বাক্যটি বলবেন, যেন মৃত্যুর আগে এই বাক্যটি তাঁর শেষ বাক্য হয়। বারবার বলে তিনি তাঁর ঈমানকে নবায়ন করবেন। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেনঃ (جَدِّدُوا إِيمَانَكُمْ) “তোমাদের ঈমানকে নবায়ন কর।” তাঁকে প্রশ্ন করা হলোঃ “ইয়া রাসূলাল্লাহ, কিভাবে আমরা আমাদের ঈমানকে নবায়িত করবো?” তিনি বললেনঃ (أَكْثِرُوا مِنْ قَوْلِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ) “তোমরা বেশি বেশি করে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।” হাদীসটির সনদ হাসান অর্থাৎ সুন্দর বা গ্রহণযোগ্য।[5]

অন্য হাদীসে মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَنْ كَانَ آخِرُ كَلامِهِ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ


“যার সর্বশেষ কথা ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[6]

আমরা জানি যে, যে ব্যক্তি সর্বদা এই যিকরে তাঁর জিহ্বাকে রত রাখবেন, নিজের নিশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে এই কালেমার যিকর করবেন, ইনশাআল্লাহ এই বাক্য তাঁর জীবনের শেষ বাক্য হবে।

আরো অনেক হাদীসে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ যিকর হিসাবে পাঠ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেগুলি আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।


যিকর নং ২ :

আল্লাহর একত্ব জ্ঞাপক যিকরের দ্বিতীয় বাক্যঃ

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ


উচ্চারণ: লা- ইলা-হা ইল্লল্লা-হু, ওয়া‘হদাহু লা- শারীকা লাহু, লাহুল মুলক, ওয়া লাহুল ‘হামদ, ওয়া হুআ ‘আলা- কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।


অর্থঃ “নেই কোন মা’বদু আল্লাহ ছাড়া, তিনি একক, তারঁ কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তারই এবং প্রশংসা তারই। এবং তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।”


এই যিকরটির ফযীলতে অগণিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সকালে সন্ধ্যায় ১ বার, ১০ বার, ১০০ বার বা ২০০ বার বলতে, প্রতি ওয়াক্ত সালাতের পরে বলতে ও সাধারণভাবে এই যিকরটি বলতে নির্দেশ দিয়ে অনেক সহীহ হাদীস বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু হাদীস আমরা পরবর্তী বিভিন্ন অধ্যায়ে দেখতে পাব। এখানে দু’একটি হাদীস উল্লেখ করছি।


আবু আইঊব (রাঃ) নবীয়ে আকরাম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ

مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ كَانَ كَعَدْلِ مُحَرَّرٍ أو محرّرين


“যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ... কাদীর’ যিকরটি একবার বলবে, সে একজন বা দুইজন ক্রীতদাস মুক্ত করবে।” হাদীসটি হাসান।[7] এই অর্থে বারা ইবনু আযিব (রাঃ) থেকে আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।[8]

সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এই যিকরটি ১০ বার বলবে, সে ৪ জন ইসমাঈল বংশীয় ক্রীতদাসকে মুক্ত করার সাওয়াব অর্জন করবে।[9]

এখানে আবারো আমাদের মনে করা দরকার যে, এই মহান সাওয়াব, অশেষ মর্যাদা ও সীমাহীন রহমত অর্জন করতে হলে অবশ্যই অর্থ বুঝে, আন্তরিকতার সাথে হৃদয়কে অর্থের সাথে আলোড়িত করে যিকর আদায় করতে হবে। ইয়াকুব ইবনু আসিম

বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দুইজন সাহাবী বলেছেন, তাঁরা নবীজী (সা.)-কে বলতে শুনেছেনঃ

مَا قَالَ عَبْدٌ قَطُّ ... مُخْلِصًا بِهَا رُوحُهُ مُصَدِّقًا بِهَا قَلْبُهُ لِسَانَهُ إِلا فُتِقَ لَهُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ حَتَّى يَنْظُرَ اللَّهُ إِلَى قَائِلِهَا وَحُقَّ لِعَبْدٍ نَظَرَ اللَّهُ إِلَيْهِ أَنْ يُعْطِيَهُ سُؤْلَهُ


“যদি কোনো ব্যক্তি কখনো এই বাক্যগুলি বলে এবং বলার সময় তাঁর আত্মা এই বাক্যগুলির প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, তাঁর অন্তর এগুলির সত্যতায় আস্থা রাখে এবং তাঁর জিহ্বা তা উচ্চারণ করে, তাহলে আল্লাহ আকাশমন্ডলী ছেদ করে জমিনের এই যাকিরের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন। আর মহান আল্লাহ যাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, তাঁর জন্য হক ও সুনিশ্চিত যে আল্লাহ তাঁর মনোবাঞ্ছনা পূরণ করবেনই।” হাদীসটি হাসান।[10]


যিকর নং ৩ :

উপরের এই যিকরটি মাসনূন যিকরগুলির মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে অন্য যিকরের সাথে বা শুধামাত্র এই

যিকরটি আমরা বারবার দেখতে পাব। কোনো কোনো হাদীসে এই যিকরের মধ্যে তিনটি বাক্য বৃদ্ধি করে বলা হয়েছেঃ

لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ (يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ حَيٌّ لَا يَمُوتُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ) وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ


উচ্চারণঃ লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া’হদাহু লা- শারীকা লাহু, লাহুল মুলক, ওয়া লাহুল হামদ, [ইউ’হয়ী ওয়া ইউমীতু ওয়া হুআ হাইয়ুন লা ইয়ামুত, বিইয়াদিহিল খাইরু] ওয়া হুআ ‘আলা- কুলিল শাইয়িন কাদীর।

অর্থঃ “নেই কোনো মা’বুদ আল্লাহ ছাড়া, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই। (তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দান করেন। আর তিনি চিরঞ্জীব অমর। তাঁর হাতেই সকল কল্যাণ) এবং তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” অনেক বর্ণনায় শুধুমাত্র প্রথম বাক্যটি (ইউহয়ী ওয়া ইউমীতু) সংযুক্ত করে বলা হয়েছে।[

1] এ জাতীয় কিছু হাদিস দেখুনঃ তুহফাতুয যাকিরীন, পৃঃ ২৩০-২৫২।

[2] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৬২, নং ৩৩৮৩, সুনানু ইবনু মাজাহ ২/১২৪৯, নং ৩৮০০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১২৬, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩২৬-৩২৯, মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৭৬, ৬৮১।

[3] সহীহ বুখারী ১/৪৯, নং ৯৯, ৫/২৪০২, নং ৬২০১।

[4] মুসতাদরাক হাকিম ১/১৪৩, ৫০২।

[5] মুসতাদরাক হাকিম ৪/২৮৫, মাযমাউয যাওয়াইদ ১/৫২, ২/২২১, ১০/৮২, আত-তারগীব ২/৩৯৪।

[6] সহীহ। মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৭৮।

[7] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ৪/১৬৪, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৮৪, আত-তারগীব ২/৩৯৯।

[8] হাদিসটি হাসান। আত-তারগীব ২/৩৯৯, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৮৫।

[9] সহীহ বুখারী, ৫/২৩৫১, নং ৬০৪০, ৬০৪১, সহীহ মুসলিম ৪/২০৭১, নং ২৬৯৩।

[10] নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৬/১২, আত-তারগীব ২/৩৯৯।