রাহে বেলায়াত প্রথম অধ্যায় - বেলায়াত ও যিকর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
ঙ. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয় - (৮) যিকর বনাম মাসনূন যিকর

আমরা এই গ্রন্থে মূলত এই ‘আল্লাহর নাম জপ’ জাতীয় যিকরের বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা আল্লাহর যিকর, আল্লাহর নামের যিকর ইত্যাদির গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, মর্যাদা ও অফুরন্ত সাওয়াবের বিষয়ে আলোচনা করব। তবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, আমরা মাসনূন বা সুন্নাত-সম্মত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ কর্তৃক আচরিত ও প্রচারিত যিকর আলোচনা করব।

পরবর্তী আলোচনায় আমরা আল্লাহর যিকরের অফুরন্ত সাওয়াব ও মর্যাদার কথা জানতে পারব। কেউ যদি মনে করেন যে, যিকর মানে

তো স্মরণ করা বা জপ করা। আমি ইচ্ছামতো যেভাবে পারি আল্লাহর স্মরণ করব বা তাঁর নাম জপ করব। এখানে আবার মাসনূন শব্দ বা পদ্ধতি শিক্ষার প্রয়োজন কি। তাহলে তার জন্য এই গ্রন্থ বিশেষ কোনো উপকারে আসবে না। আর যদি কেউ বিশ্বাস করেন যে, সালাত, সিয়াম ও অন্যান্য সকল ইবাদতের মতো যিকরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, এক্ষেত্রে নিজেদের মনগড়াভাবে কিছু না করে অবিকল রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের অনুকরণে, তাঁদের আচরিত ও প্রচারিত শব্দে ও পদ্ধতিতে ও তাঁদের সুন্নাত অনুসারে যিকর করব তাহলে তাকে বিশেষভাবে এই বইটি পড়তে অনুরোধ করব।


এখানে উল্লেখ্য যে, যে কোনো ভাষায়, যে কোনোভাবে, যে কোনো নামে ও যে কোনো শব্দে আল্লাহর কথা মুখে বা মনে স্মরণ করলে তা ভাষাগতভাবে ‘যিকর’ বলে গণ্য হবে। এভাবে স্মরণকারী হয়ত যিকরের জন্য উল্লেখিত কিছু সাওয়াবের অধিকারীও হতে পারেন। এতে তার “যিকরের” দায়িত্ব নূন্যতমভাবে পালিত হতেও পারে অথবা নাও হতে পারে।

কেউ যদি মুখে বা মনে আল্লাহ আল্লাহ, রাব, রাব, মালিক, মালিক, দয়াল, প্রভু, Lord, Creator, ইত্যাদি শব্দ আউড়ায় তাহলে ভাষাগত দিক থেকে একে যিকর বলা হবে। এতে আল্লাহর স্মরণ করার কিছু সাওয়াব মিলতেও পারে। এতে তার যিকরের ইবাদত পালিত হতে পারে, নাও হতে পারে। তবে সুন্নাত পালিত হবে না। এজন্য ভাষাগত বা সাধারণ যিকর (স্মরণ বা জপ) ও মাসনূন বা সুন্নাত-সম্মত যিকরের মধ্যে পার্থক্য বুঝা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। এখানে কয়েকটি উদাহরণ প্রদান করছিঃ


(ক) পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নামের যিকর

কুরআন কারীমে প্রায় দশ স্থানে পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নামের যিকর করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন, ইরশাদ করা হয়েছেঃ (وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ) “এবং তাদেরকে আল্লাহ যে সকল পশু রিযিক হিসাবে প্রদান করেছেন সেগুলির উপরে আল্লাহর নামের যিকর করবে।”[1] আরো ইরশাদ করা হয়েছেঃ (فَكُلُوا مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ) “যার উপর আল্লার নাম যিকর করা হয়েছে তা থেকে ভক্ষণ কর।”[2]


(وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ) “যার উপর আল্লাহর নামের যিকর করা হয়নি তা ভক্ষণ করবে না।”[3]


এভাবে কুরআন ও হাদীসে অগণিত স্থানে পশু জবাইয়ের সময় পশুর উপর আল্লাহর নামের যিকর করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন যদি কেউ পশু জবাই করার সময় যে কোনো ভাষায় ও যে কোনো বাক্যে বা শব্দে আল্লাহর যে কোনো গুণবাচক নাম- আল্লাহ, রাহীম, দয়াবান, স্র্ষ্টা, রব্ব, প্রতিপালক বা যে কোনো ভাষায় যে কোনো নাম উচ্চারণ করে জবাই করেন তাহলে তার যিকরের নূন্যতম দায়িত্ব পালিত হবে বলে ফকীহগণ মত প্রকাশ করেছেন।[4] তবে সুন্নাত-সম্মত যিকরের দায়িত্ব পালিত হবে না। সুন্নাত “বিসমিল্লাহ” বলা।


(খ) বাড়িতে প্রবেশ ও খাদ্য গ্রহণের সময়ে আল্লাহর যিকর


জাবের (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছিঃ

إِذَا دَخَلَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ فَذَكَرَ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ وَعِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ لا مَبِيتَ لَكُمْ وَلا عَشَاءَ وَإِذَا دَخَلَ فَلَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ قَالَ الشَّيْطَانُ أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ وَإِذَا لَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ عِنْدَ طَعَامِهِ قَالَ أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ وَالْعَشَاءَ


“যখন কেউ তার বাড়ি প্রবেশ করার সময় আল্লাহর যিকর করে এবং খাদ্য গ্রহণের সময় আল্লাহর যিকর করে, তখন শয়তান বলেঃ এখানে তোমাদের (শয়তানদের) কোনো খাবার নেই রাত্রি যাপনের জায়গাও নেই। আর যখন কেউ আল্লাহর যিকর না করে তার বাড়ি প্রবেশ করে, তখন শয়তান বলেঃ তোমরা রাত্রি যাপনের জায়গা পেয়ে গিয়েছ। আর যদি কেউ খাদ্য গ্রহণের সময় আল্লাহর যিকর না করে, তাহলে শয়তান বলেঃ এখানে তোমরা খাবার ও রাত্রি যাপনের জায়গা সবই পেয়েছ।”[5]

বাড়িতে প্রবেশের সময় ও খাদ্য গ্রহণের সময় কোন্ শব্দ দ্বারা আল্লাহর যিকর করতে হবে তা রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন। কেউ যদি এখানে শুধুমাত্র আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে বা অন্য কোনো ভাষায় ও শব্দে আল্লাহর কোনো নাম বা গুণবাচক নামের জপ বা উচ্চারণ করে তাহলে হয়ত আল্লাহর স্মরণের মূল ফযীলত কিছু তার অর্জিত হলেও মাসনূন যিকরের মর্যাদা থেকে সে বঞ্চিত হবে।


(গ) সালাতের শুরুতে আল্লাহর নামের যিকর


আল্লাহ তাঁর নামের যিকর করে সালাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়ে বলেনঃ

وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّىٰ


“এবং তাঁর রবের নামের যিকর করে সালাত আদায় করল।”[6]

এখানে যদি কেউ উপরের মতো একবার বা অনেকবার “আল্লাহ” বলে বা আরবী বা অন্য কোনো ভাষায় আল্লাহর কোনো নাম পাঠ করে সালাত শুরু করেন তাহলে ভাষাগতভাবে তার কাজকে ‘আল্লার নাম যিকর করে সালাত পড়ল’ বলা হবে। কিন্তু ইসলামের বিধানে তাঁর যিকরের ইবাদত পালন হবে না। তার সালাত হবে না। এখানে “আল্লাহর নামের মাসনূন যিকর” অর্থ “আল্লাহু আকবার”। ইমাম আবু ইউসূফ ও অন্য তিন ইমামের মতে এখানে অন্য কোনো যিকর, এমনকি আফযালুয যিকর “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” বলে সালাত শুরু করলেও তার যিকরের দায়িত্ব পালন হবে না। ইমাম আবু হানীফা বলেছেন যে, ‘আর-রাহমানু আ’যম’, ‘আর রহীমু আ’জম’, ‘আর-রাহমানু আজাল্ল’, ‘আর-রাহীমু আজাল্ল’ ইত্যাদি আল্লাহর মর্যাদা প্রকাশক বাক্যের যিকর দ্বারা সালাতের তাহরীমা বাঁধা জায়েয। কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর নাম যিকর করলে এক্ষেত্রে যিকরের দায়িত্ব কোনোভাবেই পলিত হবে না।[7]


(ঘ) আইয়ামে তাশরীকে আল্লাহর যিকর


আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ

فَإِذَا قَضَيْتُم مَّنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا


“যখন তোমরা হজের আহকাম পালন সম্পন্ন করবে তখন আল্লাহর যিকর করবে, যেরূপভাবে তোমাদের পিতা পিতামহদের যিকর করতে বা তার চেয়েও বেশি।”[8]


আমরা জানি যে, হাজীগণের জন্য হজ্বের শেষে বিশেষ কিছু তাকবীর ও তাহলীল করতে হয়, (الله أكبر الله أكبر لا إله إلا الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد) বলে। এজন্য মুফাসসির ও ফকীহগণ বলেছেন যে, এখানে আল্লাহর যিকর বলতে এ সকল যিকরকে বুঝান হয়েছে।[9] আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ

وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍ


“তোমরা সুনির্দিষ্ট দিনগুলিতে আল্লাহর যিকর কর।”[10]

এখানেও যিকর বলতে উপরের সুনির্দিষ্ট তাকবীর তাহলীল বুঝানো হয়েছে। এই আয়াতের উপর নির্ভর করেই ঈদুল আযহার আগে পরে ৩/৪ দিন সালাতের পরে আমরা তাকবীর বলে থাকি। এখানে যদি কেউ আল্লাহর যিকর বলতে শুধুমাত্র তাঁর নাম যিকর বা জপ করেন তাহলে তাঁর ইবাদত পলিত হবে না।

[1] সূরা হাজ্জঃ ২৮। আরো দেখুন সূরা হাজ্জঃ ৩৪, ৩৬, আন’আমঃ ১৩৮, মাইদাঃ ৪।

[2] সূরা আন’আমঃ ১১৮।

[3] সূরা আন’আমঃ ১২১।

[4] সারাখসী, আল-মাসবূত ১২/৪, কাসানী, বাদাইউস সানইয় ৫/৪৭–৪৮।

[5] সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১০০।

[6] সূরা আ’লাঃ ১৫।

[7] আবু বকর আল-জাসসাস, আহকামুল কুরআন ৩/৪৭২, ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৯২২, আলাউদ্দিন সমরকান্দী, তুহফাতুল ফুকাহা ১/১২৩।

[8] সূরা বাকারাঃ ২০০।

[9] তাফসীরে তাবারী ২/২৯৬, ২৯৮।

[10] সূরা বাকারাঃ ২০৩।