উপদেশ ১২. তাওহীদ বনাম শিরক আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ১ টি

قَالَتْ حَفْصَةُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ أَتَى عَرَّافًا فَسَأَلَهُ عَنْ شَيْءٍ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلاَةٌ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً

হাফছাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন গণক বা জ্যোতির্বিদদের নিকট যাবে এবং তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করবে ৪০ দিন তার ছালাত কবুল করা হবে না’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৫৯৫ বঙ্গানুবাদ ৮ম খন্ড হা/৪৩৯৩ ‘জ্যোতিষীর গণনা’ অনুচ্ছেদ)।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَالْحَسَنِ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ أَتَى كَاهِنًا أَوْ عَرَّافًا فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

আবূ হুরাইরা ও হাসান (রাঃ) বলেন, নবী (ছাঃ) বলেছেনঃ ‘যে কোন গণক বা জ্যোতির্বিদদের নিকট আসল এবং তার বলা কথার প্রতি বিশ্বাস করল সে মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর উপর যা (কুরআন মাজীদ) অবতীর্ণ হয়েছে তাকে অস্বীকার করল (আহমাদ ২/৪২৯পৃঃ)।

অত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাতের রাশি দেখে ভাগ্যের ভবিষ্যৎ প্রকাশ করা, হাত চালিয়ে হারিয়ে যাওয়া বস্তুর সংবাদ দেয়া, টিয়া পাখির মাধ্যমে ভাগ্যের ভবিষ্যৎ প্রকাশ করা গণকের নিকট হারিয়ে যাওয়া বস্তু জানতে চাওয়া এগুলো সবই শিরক।

عَنْ أَبِي وَاقِدٍ اللَّيْثِيِّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا خَرَجَ إِلَى حُنَيْنٍ مَرَّ بِشَجَرَةٍ لِلْمُشْرِكِينَ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُبْحَانَ اللهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ-

আবূ ওয়াক্বিদ আল-লায়ছী (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে হুনাইনের (যুদ্ধের) উদ্দেশ্যে বের হলাম। আমরা তখন সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি। একস্থানে পৌত্তলিকদের একটি কুল গাছ ছিল যার চারপাশে তারা বসত এবং তাদের সমরাস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। গাছটিকে তারা (যাতুল আনওয়াত) বলত। আমরা একদিন একটি কুল গাছের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমরা রাসূল (ছাঃ)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মুশরিকদের যেমন নির্ধারিত গাছ আছে আমাদের জন্যও তেমনি একটি গাছ নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘‘আল্লাহু আকবার’’ তোমাদের এ দাবী পূর্ববর্তী লোকদের রীতিনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তোমরা এমন কথা বলেছ যা বনী ইসরাঈলরা মূসা (আঃ)-কে বলেছিল। তারা বলেছিল, হে মূসা! মুশরিকদের যেমন মা‘বূদ আছে আমাদের জন্য তেমন মা‘বূদ বানিয়ে দাও। মূসা (আঃ) বললেন, তোমরা মূর্খের মত কথাবার্তা বলছ’ (আ‘রাফ ১৩৮)। ‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতিনীতিই অবলম্বন করছ’ (তিরমিযী হা/২১০৬, হাদীছ ছহীহ)। অত্র কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোন কিছুর মাধ্যমে বরকত হাছিল করা শির্ক।

গাছ, পাথর, কোন স্থান, কোন পুরাতন নিদর্শন কিংবা কোন মৃত মানুষের মাধ্যমে বরকত হাছিল করা শির্ক। যেমন, কোন মৃত পীর-দরবেশের মাযারে যাওয়া বা তাদের আস্তানায় গিয়ে বরকত হাছিল করা শির্ক। কোন স্থানে গিয়ে ছালাত আদায় করে কিংবা কিছু দান করে বরকত হাছিল করা শির্ক। কোন দিনকে লক্ষ্য করে কোন অনুষ্ঠান করা শির্ক। যেমন জন্ম দিবস পালন করা, মৃত দিবস পালন করা, ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ, ২১শে ফেব্রুয়ারী পালন করা শির্ক। নির্দিষ্ট কাজের উদ্দেশ্যে কিছুকাল ও সপ্তাহ উদযাপন করা, ধর্মীয় কাজ উপলক্ষে ও ব্যক্তিবর্গের স্মরণে সমাবেশ করা, প্রতিকৃতি তৈরী ও স্মরণীয় মূর্তি দাঁড় করা, মাতম করা ও জানাযার পন্থা উদ্ভাবন করা এবং কবরের উপর ঘর নির্মাণ করা সবগুলিই শির্ক।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا أَنفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ أَوْ نَذَرْتُمْ مِنْ نَذْرٍ فَإِنَّ اللهَ يَعْلَمُهُ- ‘তোমরা যা কিছু দান কর আর যা কিছু মানত কর আল্লাহ তা জানেন’ (আল-বাকারাহ ২৭০)।

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيعَ اللهَ فَلْيُطِعْهُ وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِيَهُ فَلاَ يَعْصِهِ

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের কাজে মানত করে সে যেন তা পুরা করার মাধ্যমে আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মানত করে সে যেন আল্লাহর নাফারমানী না করে (মানত পূরণ না করে) (বুখারী, মিশকাত হা/৩৪২৭, বঙ্গানুবাদ ৭ম খন্ড হা/৩২৮১)।

অত্র হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর নামে বৈধ স্থানে মানত মানা যায় এবং তা পালন করা যরূরী (আল-বাকারাহ ২৭)।

আল্লাহ ছাড়া অন্যের উদ্দেশ্যে মানত করা শির্ক। যেমন, কোন বালা-মছীবত দূর করার উদ্দেশ্যে অথবা কিছু অর্জন করার আশায় মাযারে জীবিত কিংবা মৃত পীরের নামে পশু বা কোন কিছু মানত করা শির্ক।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنْ الْإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِنْ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا-

‘মানুষের মধ্য হতে কিছু সংখ্যক লোক কতিপয় জিনের কাছে আশ্রয় চাইত, এর ফলে জিনদের গর্ব ও অহমিকতা আরো বেড়ে গিয়েছিল’ (জিন ৬)। অত্র আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ জিনের কাছে আশ্রয় নিত, এখনও নেয়।

عَنْ خَوْلَةَ بِنْتِ حَكِيْمٍ السُّلَمِيَّةِ تَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ نَزَلَ مَنْزِلاً ثُمَّ قَالَ أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ لَمْ يَضُرَّهُ شَيْءٌ حَتَّى يَرْتَحِلَ مِنْ مَنْزِلِهِ ذَلِكَ-

খাওলাহ বিনতে হাকীম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে এ কথা বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোন বাড়িতে বা স্থানে অবতীর্ণ হয়ে বলবে,

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

‘আমি আল্লাহর পূর্ণ কালামের নিকট তাঁর সৃষ্টির সকল অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাই’। তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ঐ স্থান ত্যাগ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না (মুসলিম, মিশকাত হা/২৪২২, বঙ্গানুবাদ ৫ম খন্ড, হা/২৩১০ ‘বিভিন্ন সময়ের দো‘আ’ অনুচ্ছেদ)।

আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট কিছু চাওয়া ও পাওয়ার আশা করা কিংবা পীর-ফকীরের নিকট কিংবা তাদের মাযারে সন্তান বা কিছু কামনা করা শির্ক।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلاَ تَدْعُ مِنْ دُونِ اللهِ مَا لاَ يَنْفَعُكَ وَلاَ يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنْ الظَّالِمِينَ، وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ-

‘আল্লাহ ছাড়া এমন কোন সত্তাকে ডেকো না যে তোমার কোন উপকার করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না। যদি তুমি এমন কাজ কর তাহলে নিশ্চয়ই তুমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ যদি তোমাকে কোন বিপদে ফেলেন, তাহলে একমাত্র তিনি ব্যতীত আর অন্য কেউ ঐ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না’ (ইউনুস ১০৬-১০৭)।

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, فَابْتَغُوا عِنْدَ اللهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ- ‘তোমরা আল্লাহর নিকট খাদ্য চাও এবং তাঁরই ইবাদত কর’ (আনকাবুত ১৭)।

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللهِ مَنْ لاَ يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ- ‘তার চেয়ে অধিক ভ্রান্ত আর কে হতে পারে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ছেড়ে এমন ব্যক্তিকে ডাকে যে ব্যক্তি ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিতে পারবে না’ (আহকাফ ৫)।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ- ‘বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির ডাকে কে সাড়া দেয়? যখন সে ডাকে। আর কে তার কষ্ট দূর করে?’ (নামল ৬২)।

আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে চাওয়া বা দো‘আ করা শির্ক। সাধারণভাবে সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার নাম হচ্ছে দো‘আ। আর দুঃখ-দুর্দাশাগ্রস্ত অবস্থায় আল্লাহর কাছে দো‘আ করার নাম হচ্ছে ইস্তিগাছা বা সাহায্য চাওয়া। যাবতীয় বালা-মুছীবত ও দুঃখ-কষ্টের সময় একমাত্র তাঁরই কাছে সাহায্য চাইতে হবে। একমাত্র তিনিই দো‘আকারীর ডাকে সাড়া দেন। তিনি বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে যে ব্যক্তি কোন নবী, ফেরেশতা, ওয়ালী অথবা অন্য কারো নিকট দো‘আ করল অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে এমন ব্যাপারে সাহায্য চাইল, যে ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো কিছু করার ক্ষমতা নেই, সে মুশরিক, কাফির। সাথে সাথে সে দ্বীন থেকে বের হয়ে গেল এবং জাহেলী উম্মাতে পরিণত হল। সৃষ্টিজগতের কোন ব্যক্তি তার নিজের কিংবা অন্যের কল্যাণ অথবা বালা-মছীবত দূর করার ক্ষমতা রাখে না; বরং সৃষ্টি জগতের সবাই সর্ববিষয়ে আল্লাহর মুখাপেক্ষী।

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

وَقَالُوا لاَ تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلاَ تَذَرُنَّ وَدًّا وَلاَ سُوَاعًا وَلاَ يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا

‘কাফেররা বলল, তোমরা তোমাদের মা‘বূদগুলিকে কখনো পরিত্যাগ করো না। বিশেষ করে ‘ওয়াদ’, সু‘আও, ‘ইয়াগূছ’, ‘ইয়াউক্ব’ এবং নছর (মূর্তিগুলিকে) কখনও পরিত্যাগ করো না’ (নূহ ২৩)।