মিনা যাবার আগে বা পরে হাজীগণ যেসব ভুল করেন

১. নফল তাওয়াফের মাধ্যমে হজের অগ্রিম সাঈ করে নেয়া

৮ যিলহজ হজের ইহরামের পর তাওয়াফ-সাঈ করা। অনেক তামাত্তু হজকারী হজের এই ইহরামের পর নফল তাওয়াফ করে সাঈ করে নেন। এরূপ করার কথা হাদীসে নেই। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও কেউ এরূপ করেছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। যেহেতু হাদীসে এবং সাহাবায়ে কিরাম ও সালফে সালেহীনের যুগে এরূপ করার কোনো প্রমাণ নেই, তাই এ বিষয়টি অবশ্যই বর্জন করতে হবে। নতুবা সুন্নতের জায়গায় বিদ‘আত কায়েম হবে। তাই ইহরাম বেঁধে বা ইহরাম বাদে কোনভাবেই সেদিন তাওয়াফ-সাঈ করতে যাবেন না। যেসব সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তামাত্তু করেছিলেন, তারা ৮ যিলহজ ইহরাম বাঁধার পূর্বে বা পরে কোনো প্রকার সাঈ করা তো দূরের কথা তাওয়াফও করেন নি। আয়েশা রা. বলেন, ‘বিদায় হজের বছর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বের হলাম... যারা উমরার জন্য ইহরাম বেঁধেছিলেন, তারা তাওয়াফ ও সাঈ করে হালাল হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর মিনা থেকে ফেরার পর তারা হজের জন্য তাওয়াফ করেন।’[1] যদি ৮ তারিখের দিনে তাওয়াফ বা সাঈ করার সুযোগ থাকত, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা অবশ্যই সাহাবীগণকে জানাতেন। আর সাহাবীগণও এটা ত্যাগ করতেন না। হানাফী ফিকহের প্রসিদ্ধ কিতাব বাদায়িউস্‌সানায়ে’তে লিখা হয়েছে :

وَإِذَا أَحْرَمَ الْمُتَمَتِّعُ بِالْحَجِّ فَلَا يَطُوفُ بِالْبَيْتِ ، وَلَا يَسْعَى فِي قَوْلِ أَبِي حَنِيفَةَ ، وَمُحَمَّدٍ ؛ لِأَنَّ طَوَافَ الْقُدُومِ لِلْحَجِّ لِمَنْ قَدِمَ مَكَّةَ بِإِحْرَامِ الْحَجِّ ، وَالْمُتَمَتِّعُ إنَّمَا قَدِمَ مَكَّةَ بِإِحْرَامِ الْعُمْرَةِ لَا بِإِحْرَامِ الْحَجِّ ، وَإِنَّمَا يُحْرِمُ لِلْحَجِّ مِنْ مَكَّةَ ، وَطَوَافُ الْقُدُومِ لَا يَكُونُ بِدُونِ الْقُدُومِ ، وَكَذَلِكَ لَا يَطُوفُ ، وَلَا يَسْعَى أَيْضًا ؛ لِأَنَّ السَّعْيَ بِدُونِ الطَّوَافِ غَيْرُ مَشْرُوعٍ ، وَلِأَنَّ الْمَحَلَّ الْأَصْلِيَّ لِلسَّعْيِ مَا بَعْدَ طَوَافِ الزِّيَارَةِ ؛ لِأَنَّ السَّعْيَ وَاجِبٌ ، وَطَوَافُ الزِّيَارَةِ فَرْضٌ ، وَالْوَاجِبُ يَصْلُحُ تَبَعًا لِلْفَرْضِ ، فَأَمَّا طَوَافُ الْقُدُومِ فَسُنَّةٌ . وَالْوَاجِبُ لَا يَتْبَعُ السُّنَّةَ إلَّا أَنَّهُ رَخَّصَ تَقْدِيمَهُ عَلَى مَحَلِّهِ الْأَصْلِيّ عَقِيبَ طَوَافِ الْقُدُومِ فَصَارَ وَاجِبًا عَقِيبَهُ بِطَرِيقِ الرُّخْصَةِ ، وَإِذَا لَمْ يُوجَدْ طَوَافُ الْقُدُومِ يُؤَخَّرُ السَّعْيُ إلَى مَحَلِّهِ الْأَصْلِيِّ فَلَا يَجُوزُ قَبْلَ طَوَافِ الزِّيَارَةِ.

‘তামাত্তু হজকারী যখন হজের ইহরাম বাঁধে তখন সে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। সাঈও করবে না। এটা হল ইমাম আবু হানীফা রহ. ও ইমাম মুহাম্মদ রহ.-এর অভিমত। কারণ তাওয়াফে কুদূম ওই ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত যে হজের ইহরাম নিয়ে মক্কায় আগমন করল। পক্ষান্তরে তামাত্তু হজকারী উমরার ইহরাম নিয়ে মক্কায় আগমন করেছে। হজের ইহরাম নিয়ে আগমন করেনি। তামাত্তু হজকারী ব্যক্তি মক্কা থেকেই হজের ইহরাম বাঁধে। আর তাওয়াফে কুদূম বাইর থেকে আগমন ব্যতীত হয় না। তাওয়াফ-সাঈ এ জন্যেও করবে না যে, তাওয়াফ ব্যতীত সাঈ করা শরীয়তসম্মত নয়। কেননা সাঈর মূল জায়গা তাওয়াফে যিয়ারতের পর। কেননা সাঈ হল ওয়াজিব। আর তাওয়াফে যিয়ারত হল ফরয। ওয়াজিব, ফরযের তাবে’ বা অনুবর্তী হতে পারে। পক্ষান্তরে তাওয়াফে কুদূম হচ্ছে সুন্নত। আর ওয়াজিব সুন্নতের তাবে’ বা অনুবর্তী হতে পারে না। তবে তাওয়াফে কুদূমের ক্ষেত্রে সাঈকে তার মূল জায়গা হতে এগিয়ে নিয়ে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই অনুমতির কারণে তাওয়াফে কুদূমের পর ‘ওয়াজিব’ আদায়যোগ্য হয়েছে। তাই তাওয়াফে কুদূমের অনুপস্থিতিতে সাঈকে তার মূল জায়গায় পিছিয়ে নিতে হবে। সুতরাং তাওয়াফে যিয়ারতের পূর্বে সা‘ঈ আদায় করা জায়েয হবে না।[2]

উক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, আমাদের বাংলাদেশী হাজীগণ মিনায় যাওয়ার সময় ইহরাম বেঁধে, নফল তাওয়াফ করে, যেভাবে হজের সাঈ অগ্রিম সেরে নেন, তা আদৌ শরীয়তসম্মত নয়। কেননা এর পেছনে কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের আমল থেকে কোনো দলীল- প্রমাণ নেই। সুতরাং এ শরীয়তবিরোধী বিদ‘আত কাজটি পরিত্যাগ করুন।

২. মসজিদে হারামে গিয়ে ইহরাম বাঁধা

মসজিদে হারামে গিয়ে ইহরাম বাঁধা।[3] বিদায় হজে সাহাবায়ে কিরাম নিজ নিজ অবস্থানস্থল থেকে ইহরাম বেঁধেছিলেন। যদি মসজিদে হারামের ভেতরে বা বাইরের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ইহরাম বাঁধার বিধান থাকতো, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দিতেন এবং সাহাবায়ে কিরাম অগ্রাধিকারভিত্তিতে তা আমলে নিতেন।

৩. ৮ তারিখ মিনায় পৌঁছা পর্যন্ত ইহরাম বিলম্বিত করা। এটি জায়েয; কিন্তু উত্তম নয়। কেননা বিদায় হজে সাহাবীরা নিজ নিজ অবস্থানস্থল থেকে ইহরাম বেঁধেছেন। অতঃপর মিনার দিকে রওনা হয়েছেন।[4]

৪. কোনো কোনো হাজী মনে করেন, উমরায় পরিহিত ইহরামের কাপড় না ধুয়ে হজের জন্য পরিধান করা বৈধ নয়। এটি ভুল ধারণা। কেননা ইহরামের কাপড় নতুন ও পরিষ্কার থাকা শর্ত নয়। পরিষ্কার থাকলে ভালো। কিন্তু ওয়াজিব নয়।

৫. অনেক হাজী সাহেব মিনায় রওনা হবার সময় তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করেন না। অথচ উচ্চস্বরে পাঠ করা সুন্নত। কেননা,

ক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

أَتَانِي جِبْرِيلُ ، فَقَالَ : إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكَ أَنْ تَأْمُرَ أَصْحَابَكَ أَنْ يَرْفَعُوا أَصْوَاتَهُمْ بِالتَّلْبِيَةِ ، فَإِنَّهَا مِنْ شِعَارِ الْحَجِّ .

‘জিবরীল আমার কাছে আগমন করে বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে আদেশ দিচ্ছেন, যাতে আপনি আপনার সাহাবীগণকে নির্দেশ দেন, তারা যেন উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করে। কেননা এটি হজের শ্লোগানের অন্তর্ভুক্ত।’[5]

খ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন হজ উত্তম? তিনি বললেন, ‘আল-‘আজ্জু ওয়াছ-ছাজ্জু।’[6] আল-আজ্জু হচ্ছে তালবিয়ার মাধ্যমে আওয়াজ উচ্চ করা, আর আছছাজ্জু হচ্ছে হাদী বা কুরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা।

গ. সাহাবায়ে কিরাম এই আদেশ পালন করেছেন। তাঁরা উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করেছেন। রীতিমত চড়া গলায় তাঁরা তালবিয়া পড়েছেন। এমনকি এর ফলে তাঁদের গলার স্বর ভেঙ্গে গিয়েছিল।[7] ইমাম নববী রহ. তালবিয়ার আওয়াজ উচ্চ করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি সর্বসম্মত মত। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, পরিমিতভাবে উচ্চ করা যাতে নিজের কষ্ট না হয়।

আর মহিলারা এমন আওয়াজে পড়বে যাতে তারা নিজেরা শুনতে পায়। কেননা তাদের উচ্চ আওয়াজে ফিতনার আশংকা রয়েছে।’[8] ইবন আবদিল বার বর্ণনা করেন, ‘এ বিষয়ে সর্বসম্মত মত হচ্ছে, মহিলারা অতি উঁচুস্বরে তালবিয়া পাঠ করবে না। বরং এমন আওয়াজে পড়বে যাতে নিজেরা শুনতে পায়।’[9] এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম থেকেও বর্ণনা এসেছে। ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘মহিলারা তালবিয়া উচ্চস্বরে পড়বে না।’[10] ইবন উমর রা. বলেছেন, মহিলাদের জন্যে অনুমতি নেই যে, তারা উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করবে।’[11]

৬. কোনো কোনো হাজী মিনায় দুই ওয়াক্তের সালাত একত্র করে আদায় করেন। আবার কেউ কেউ চার রাক‘আত বিশিষ্ট সালাতে কসর করেন না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি মিনায় দুই ওয়াক্তের সালাত একত্রে আদায় না করে পৃথক পৃথকভাবে কসর করেছেন। আর মুসলমানদের যাবতীয় কাজে সুন্নতের অনুসরণ করা একান্ত প্রয়োজন।

[1]. বুখারী : ১৫৫৬, মুসলিম : ১১১২।

[2]. আল কাসানী : বাদায়িউস্সানায়ে’: ২/৩৪৭।

[3]. মনে রাখবেন, ইহরাম বাঁধার ক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে দু’টি। এক. পবিত্র মক্কায় হারামের সীমারেখায় অবস্থিত আপনার অবস্থানস্থল থেকে ইহরাম বাঁধা। দুই. ৮ তারিখ সূর্যোদয়ের পর থেকে তা হেলে পড়ার পূর্বেই যেকোনো সময়ে ইহরাম বাঁধা।

[4]. তবে যদি ৭ তারিখ কোনো কারণে কাউকে মিনা চলে যেতে হয়, তবে তার জন্য উত্তম হলো, ৮ তারিখ তিনি যেখানে থাকবেন সেখান থেকে ইহরাম বাঁধা। যদিও তা মিনা হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৮ তারিখ ইহরাম বেঁধেছেন। তার আগে নয়।

[5]. আহমাদ : ২১৭২২, ইবন হিব্বান : ৩৮০৩।

[6]. হাকেম : ১৬৫৫, বায়হাকী : ৩৯৭৪।

[7]. মুছান্নাফ ইবন আবী শাইবা : ৪/৪৬৪।

[8]. শারহু মুসলিম লিন-নাবাবী : ৪/৩৫১।

[9]. আল-ইসতিযকার : ৪/৫৭; বিদায়াতুল মুজতাহিদ : ১/৪৬৭।

[10]. মুছান্নাফে ইবন আবী শাইবা : ৪/৪১৬; সুনানে বায়হাকী : ৫/৪৬।

[11]. মুছান্নাফে ইবন আবী শাইবা : ৪/৪১৬; উমদাতুল কারী : ৯/১৭১।