হারাম ও কবিরা গুনাহ হারাম ও কবীরা গুনাহ্ পরিচিতি মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ১ টি
১৫৯. মুত্‘আ বিবাহ্ তথা কোন কিছুর বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিবাহ্ করা

মুত্‘আ বিবাহ্ তথা কোন কিছুর বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিবাহ্ করা হারাম।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَالَّذِيْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حَافِظُوْنَ، إِلاَّ عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُوْمِيْنَ، فَمَنِ ابْتَغَى وَرَآءَ ذَلِكَ فَأُوْلَآئِكَ هُمُ الْعَادُوْنَ».

‘‘আর যারা নিজ যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী। তবে যারা নিজ স্ত্রী ও অধিকারভুক্ত দাসীদের সঙ্গে যৌনকর্ম সম্পাদন করে তারা অবশ্যই নিন্দিত নয়। এ ছাড়া অন্যান্য পন্থায় যৌনক্রিয়া সম্পাদনকারীরা অবশ্যই সীমালংঘনকারী’’। (মা‘আরিজ : ২৯-৩১)

উক্ত আয়াতের মর্মানুযায়ী যে মহিলার সাথে মুত্‘আ করা হচ্ছে সে প্রথমত: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিয়মিত স্ত্রী নয়। কারণ, এ জাতীয় মহিলা বিধিসম্মতভাবে তার পক্ষ থেকে কোন মিরাস পায় না, চুক্তি শেষে তাকে তালাকও দিতে হয় না এবং তাকে ইদ্দতও পালন করতে হয় না। এমনকি সে তার অধিকারভুক্ত দাসীও নয়। সুতরাং তার সাথে যৌনক্রিয়া সম্পাদন করা সীমালংঘনই বটে।

সাব্রাহ্ আল-জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ! إِنِّيْ قَدْ كُنْتُ أَذِنْتُ لَكُمْ فِيْ الاسْتِمْتَاعِ مِنَ النِّسَاءِ، وَإِنَّ اللهَ قَدْ حَرَّمَ ذَلِكَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، فَمَنْ كَانَ عِنْدَهُ مِنْهُنَّ شَيْءٌ فَلْيُخَلِّ سَبِيْلَهُ، وَلَا تَأْخُذُوْا مِمَّا آتَيْتُمُوْهُنَّ شَيْئًا.

‘‘হে মানব সকল! আমি তোমাদেরকে ইতিপূর্বে মহিলাদের সাথে মুত্‘আ করতে অনুমতি দিয়েছিলাম; অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা এখন তা কিয়ামত পর্যন্ত হারাম করে দিয়েছেন। অতএব তোমাদের কারোর নিকট এ জাতীয় কোন মহিলা থেকে থাকলে সে যেন তাকে নিজ গতিতে ছেড়ে দেয়। আর তোমরা যা তাদেরকে মোহর হিসেবে দিয়েছো তা থেকে এতটুকুও ফেরত নিবে না’’। (মুসলিম ১৪০৬)

উক্ত বিবাহ্ ইসলামের শুরু যুগে কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধকালীন সময়ে সাহাবায়ে কিরাম যখন নিজ স্ত্রীদের থেকে বহু দূরে অবস্থান করতেন তখন তাঁদেরই নিতান্ত প্রয়োজনে চালু করা হয়। যা মক্কা বিজয়ের সময় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় এবং যা কিয়ামত পর্যন্ত এ দীর্ঘ কালের যে কোন সময় তার যতোই প্রয়োজন হোক না কেন তা আর চালু করা যাবে না।

‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’উদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

كُنَّا نَغْزُوْ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ  لَيْسَ لَنَا نِسَاءٌ، فَقُلْنَا: أَلَا نَسْتَخْصِيْ ؟ فَنَهَانَا عَنْ ذَلِكَ، ثُمَّ رَخَّصَ لَنَا أَنْ نَنْكِحَ الْـمَرْأَةَ بِالثَّوْبِ إِلَى أَجَلٍ.

‘‘একদা আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বেরুতাম। তখন আমাদের সঙ্গে আমাদের স্ত্রীগণ ছিলো না। তাই আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললাম: আমরা কি খাসি হয়ে যাবো না? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তা করতে নিষেধ করেন। বরং তিনি শুধুমাত্র একটি কাপড়ের বিনিময়ে হলেও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিবাহ্ তথা মুত্‘আ করা আমাদের জন্য হালাল করে দিলেন’’। (মুসলিম ১৪০৪)

খাইবারের যুদ্ধ পর্যন্ত সাধারণভাবে এ নিয়ম চালু ছিলো। অতঃপর তা উক্ত যুদ্ধেই সর্ব প্রথম নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

‘আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

نَهَى رَسُوْلُ اللهِ  عَنْ مُتْعَةِ النِّسَاءِ يَوْمَ خَيْبَرَ، وَعَنْ أَكْلِ لُحُوْمِ الْحُمُرِ الْإِنْسِيَّةِ.

‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারের যুদ্ধে গৃহপালিত গাধার গোস্ত খাওয়া এবং মহিলাদের সাথে মুত্‘আ করা নিষেধ করে দিয়েছেন’’। (মুসলিম ১৪০৭)

মক্কা বিজয়ের সময় তা আবার কিছু দিনের জন্য চালু করা হয়। অতঃপর তা আবার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

সাব্রাহ্ আল-জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ  بِالْـمُتْعَةِ عَامَ الْفَتْحِ حِيْنَ دَخَلْنَا مَكَّةَ، ثُمَّ لَمْ نَخْرُجْ مِنْهَا حَتَّى نَهَانَا عَنْهَا.

‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় মক্কায় প্রবেশ করে আমাদেরকে মুত্‘আ করতে আদেশ করেন। অতঃপর মক্কা থেকে বের হতে না হতেই তা আবার নিষেধ করে দেন’’। (মুসলিম ১৪০৬)

সাব্রাহ্ আল-জুহানী (রাঃ) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা মক্কা বিজয়ের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মক্কায় পনেরো দিন অবস্থান করেছিলাম। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে মুত্‘আ করতে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়েই আমি ও আমার এক চাচাতো ভাই মুত্‘আ করতে রওয়ানা করলাম। আমি ছিলাম তার চাইতে একটু বেশি জোয়ান, ফরসা ও সুন্দর গড়নের। আর সে ছিলো একটু কালো বর্ণের। আমাদের উভয়ের সাথে ছিলো দু’টি চাদর। তবে আমার চাদরটি ছিলো পুরাতন। আর তার চাদরটি ছিলো খুবই সুন্দর এবং নতুন। আমরা মক্কার উঁচু-নিচু ঘুরতে ঘুরতে বনূ ‘আমির বংশের এক সুন্দরী মহিলা পেয়ে গেলাম। আমরা তাকে বললাম: আমাদের কেউ কি তোমার সাথে মুত্‘আ করতে পারবে ? সে বললো: তোমরা আমাকে এর বিনিময়ে কি দিবে ? তখন আমরা উভয়ে তাকে নিজ নিজ চাদর দেখালাম। আমার সাথীর চাদর দেখে সে আকৃষ্ট হয়। তবে তাকে দেখে নয়। আবার আমাকে দেখে সে আকৃষ্ট হয়। তবে আমার চাদর দেখে নয়। আমার সাথী বললো: এর চাদরটি পুরাতন। আর আমার চাদরটি নতুন। তখন সে বললো: এর চাদরে কোন সমস্যা নেই। কথাটি সে দু’ বার অথবা তিন বার বললো। অতঃপর আমি তার সাথে তিন দিন মুত্‘আ করি। ইতিমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যার কাছে মুত্‘আর মহিলা রয়েছে সে যেন তাকে ছেড়ে দেয়।

(মুসলিম ১৪০৬)

সকল সাহাবায়ে কিরাম মুত্‘আ হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত ছিলেন। তবে ‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) থেকে তা হালাল হওয়ার মতও পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি মৃত্যুর পূর্বে উক্ত মত পরিহার করেছেন। অতএব তা সাহাবাদের সর্ব সম্মতিক্রমে হারামই প্রমাণিত হলো। নিম্নে সাহাবাগণের কয়েকটি উক্তি উল্লিখিত হলো:

‘আলী (রাঃ) বলেন: রমযানের রোযা অন্যান্য বাধ্যতামূলক রোযাকে রহিত করে দিয়েছে যেমনিভাবে তালাক, ইদ্দত ও মিরাস মুত্‘আ বিবাহ্কে রহিত করে দিয়েছে। (মুস্বান্নাফি আব্দির রায্যাক্ব ৭/৫০৫)

‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’ঊদ্ (রাঃ) বলেন: তালাক, ইদ্দত ও মিরাস মুত্‘আ বিবাহ্কে রহিত করে দিয়েছে। (মুস্বান্নাফি আব্দির রায্যাক্ব ৭/৫০৫)

‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রা.) কে উক্ত মুত্‘আ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: তা ব্যভিচার। (মুস্বান্নাফি আব্দির রায্যাক্ব ৭/৫০৫)

‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ যুবাইর (রা.) কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনিও বলেন: তা ব্যভিচার। (মুস্বান্নাফি ইব্নি আবী শাইবাহ্ ৩/৫৪৬)

‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) বলেন: মুত্‘আ বিবাহ্ হারাম। এর প্রমাণ সূরাহ মা‘আরিজের উনত্রিশ থেকে একত্রিশ নম্বর আয়াত।

(বায়হাক্বী ৭/২০৬)

জা’ফর বিন্ মুহাম্মাদ (রাহিমাহুল্লাহ্) কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: তা হুবহু ব্যভিচার। এতে কোন সন্দেহ নেই। (বায়হাক্বী ৭/২০৭)

ইমাম নাওয়াওয়ী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: ‘আল্লামাহ্ মাযিরী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: মুত্‘আ বিবাহ্ ইসলামের শুরু যুগে জায়িয ছিলো। যা পরবর্তী যুগে বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা রহিত করা হয় এবং এর হারামের উপর সকল গ্রহণযোগ্য আলিম একমত।

‘আল্লামাহ্ ক্বাযী ’ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: শুধু রাফিযী ছাড়া সকল আলিম তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত এবং সবাই এ ব্যাপারেও একমত যে, এখনো কোন ব্যক্তি তা সম্পাদন করলে সাথে সাথেই তা বাতিল হয়ে যাবে। চাই সে উক্ত মহিলার সাথে সঙ্গম করুক বা নাই করুক। (মুসলিম/ইমাম নাওয়াওয়ীর ব্যাখ্যা ৯-১০/১৮৯)

শিয়া সম্প্রদায় এখনো উক্ত মুত্‘আ বিবাহ্কে হালাল মনে করে। যা কুর‘আন-সুন্নাহ্’র সম্পূর্ণ বিরোধী। কোন কোন বর্ণনা মতে ‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) ও তাঁর কিছু ভক্তরা উক্ত বিবাহ্ জায়িয বললে বা করলে তা জায়িয হয়ে যাবে না। কারণ, কুর‘আন-সুন্নাহ্’র সামনে কোন সাহাবার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। উপরন্তু অন্যান্য সকল সাহাবা তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত এবং তিনিও পরিশেষে উক্ত মত থেকে ফিরে এসেছেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। মূলতঃ আজো যারা উক্ত অগ্রহণযোগ্য মতকে আঁকড়ে ধরে আছে তারা নিশ্চয়ই নিজ কুপ্রবৃত্তির অদম্য পূজারী। নতুবা হারাম হওয়ার ব্যাপারটি সুনিশ্চিত হওয়ার পরও একটি বিচ্ছিন্ন মতকে আঁকড়ে ধরার আর অন্য কোন মানে হয় না।