‘‘কুফর’’-এর পরিধি বাড়ানো অর্থ যা কুফর নয় তাও কুফর বলে গণ্য করা। এর অন্যতম দিক কবীরা গোনাহকে কুফর বলে গণ্য করা। এ পদ্ধতিতে মুমিনকে কাফির বলার ধারা চালু হয় ‘‘খারিজী’’-গণের মাধ্যমে। তারা যে কোনো কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়াকে কুফর বলে গণ্য করে। খারাজা (خَرَجَ) অর্থ বাহির হওয়া, আনুগত্য ত্যাগ বা বিদ্রোহ করা। খারিজ বা খারিজী (الخارج/الخارجي) অর্থ দলত্যাগী, বিদ্রোহী, সমাজ পরিত্যাগকারী বা বিচ্ছিন্নতার পথ গ্রহণকারী।

৩৭ হিজরী সালে আলী (রা)-এর সাথে মুআবিয়া (রা)-এর চলমান সিফ্ফীনের যুদ্ধের সময়ে একপর্যায়ে উভয় পক্ষ ‘‘সালিস’’-এর মাধ্যমে মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে আলী (রা)-এর পক্ষের কয়েক হাজার যুবক সৈনিক পক্ষত্যাগ করে ‘‘বিদ্রোহী’’ বাহিনী তৈরি করেন। এদের মূলনীতি ছিল (১) তাকফীর, (২) জিহাদ ও (৩) রাষ্ট্র। এরা দাবী করেন যে, আল্লাহর কোনো বিধান অমান্য করা বা কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়াই কুফরী। কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয আইন। এরূপ কাফির বা পাপী রাষ্ট্রপ্রধান ও তার পক্ষের মানুষদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয আইন। তারা দাবি করেন, আল্লাহ কুরআনে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।[1] আলী (রা) ও মুআবিয়া (রা) সে নির্দেশ অমান্য করে সালিস নিয়োগ করে কুফরী করেছেন। কাজেই তাঁরা ও তাঁদের অনুসারীরা সকলেই কাফির। এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে প্রকৃত মুসলিমদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ফরয।

এরা ইসলামের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের প্রায় সকলেই ছিলেন যুবক। এরা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান আবেগী মুসলিম। সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় ও সারাদিন সিয়াম, যিক্র ও কুরআন পাঠে রত থাকার কারণে এরা ‘কুর্রা’ বা ‘কুরআনপাঠকারী দল’ বলে সুপরিচিত ছিলেন। এদের বাহ্যিক ধার্মিকতা ও সততা ছিল অতুলনীয়। পাশাপাশি এদের হিংস্রতা ও সন্ত্রাস ছিল ভয়ঙ্কর। নিরপরাধ অযোদ্ধাসহ হাজার হাজার মুসলিমের প্রাণ নষ্ট হয় তাদের হিংস্রতা ও সন্ত্রাসের কারণে।

মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন:


إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلّهِ


‘‘হুকুম, বা কর্তৃত্ব শুধু আল্লাহরই’’ বা ‘‘বিধান শুধু আল্লাহরই’’।[2]

এ থেকে তারা বুঝাতেন যে, আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানাই কুফর। আর পাপ মানেই আল্লাহর অবাধ্যতায় শয়তানের আনুগত্য করা ও তার হুকুম মানা। কাজেই পাপ অর্থই কুফরী। মহান আল্লাহ আরো বলেন:


وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ


‘‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।’’[3]

এ থেকে তারা দাবি করতেন যে, আল্লাহর নাযিলকৃত যে কোনো হুকুমু বা বিধান অমান্য করাই কুফর। এছাড়া হাদীসে অনেক সময় পাপকে সুস্পষ্টভাবে কুফরী বলা হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ


‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ এবং তার সাথে যুদ্ধ করা কুফরী।’’[4]

কুরআন-হাদীসের এ সকল নির্দেশনার ভিত্তিতে তারা যে কোনো কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়াকে কুফরী বলে গণ্য করত, এরূপ ব্যক্তি, সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ, যুদ্ধ ও হত্যা বৈধ ও জরুরী বলে দাবি করত।

বস্ত্তত ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলে দাবি করা মুসলিম সমাজের সকল সংঘাত, হানাহানি ও ফিতনার মূল উৎস। সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগগুলোর সকল ইমাম, ফকীহ ও আলিম এ বিভ্রান্তি দূরীকরণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। আমি ‘‘ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ’’ গ্রন্থে ও ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, খারিজীদের বিভ্রান্তির কারণ ও স্বরূপ নিম্নরূপ:

(১) কুরআন-হাদীসের এক নির্দেশনা মান্য করার দাবিতে অন্য নির্দেশনা অস্বীকার, ব্যাখ্যা বা রহিত-মানসূখ বলে দাবি করা। কুরআনে একদিকে যেমন আল্লাহর বিধান বিরোধী ফয়সালা করা বা বিধান অমান্যকে কুফর বলা হয়েছে, অন্যদিকে বিধান বিরোধী ফয়সালা বা কর্মে লিপ্তদেরকে মুমিন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদীসে যেমন কোনো কোনো পাপকে কুফর বলা হয়েছে তেমনি অগণিত হাদীসে কঠিনতম পাপে লিপ্ত মুমিনকে ‘‘পাপী মুমিন’’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

(২) কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে ‘‘সুন্নাত’’ বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যবহারিক রীতি ও কর্মকে গুরুত্ব না দেওয়া। তাঁর ব্যবহারিক সুন্নাত থেকে আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারি যে, তিনি কখনো কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুমিনদেরকে কাফির বলে গণ্য করেন নি।

(৩) কুরআন-হাদীস অনুধাবনের ক্ষেত্রে নিজেদের ‘‘বুঝ’’-কে চূড়ান্ত এবং সাহাবীগণের মত ও ব্যাখ্যাকে গুরুত্বহীন ভাবা। সাহাবীগণ কুরআন নাযিল প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এর ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক রীতি প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁরা সর্বসম্মতভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, পাপের কারণে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা বৈধ নয়। তাঁরা বারবার বলেছেন যে, কুরআন ও হাদীসে কুফর বলতে কখনো অবিশ্বাস এবং কখনো অকৃতজ্ঞতা বুঝানো হয়েছে। এছাড়া আল্লাহর বিধানের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থাসহ তা অমান্য করা এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা ও অস্বীকৃতিসহ তা অমান্য করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

[1] সূরা (৪৯) হুজুরাত: ৯ আয়াত।

[2] সূরা (৬) আনআম: ৫৭ আয়াত; সূরা (১২) ইউসূফ: ৪০ ও ৬৭ আয়াত।

[3] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ আয়াত।

[4] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭ (কিতাবুল ঈমান, বাবু খাওফিল মুমিন), ৫/২২৪৭, ৬/২৫৯২; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৮১ (কিতাবুল ঈমান, বাবু কাওলিন নাবিয়্যি... সিবাবুল মুমিন)