১২. নাজরানের প্রতিনিধি দল (وَفْدُ نَجْرَانَ):

মক্কা হতে ইয়ামানের দিকে যেতে সাত দিনের দূরত্বে একটি বড় অঞ্চল ছিল, ঐ অঞ্চলটি ছিল ৭৩ পল্লী বিশিষ্ট। কোন দ্রুতগামী বাহন একদিনে পুরো অঞ্চল ভ্রমণ করতে সক্ষম হতো না। এ অঞ্চলে এক লক্ষ যোদ্ধা পুরুষ ছিল। এরা ছিল সকলেই খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী।

নাজরানের প্রতিনিধি দল মদীনায় আগমন করেন ৯ম হিজরী সনে। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ষাট। ২৪ জন ছিলেন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ। যার মধ্যে ৩ জন ছিলেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এর মধ্যে একজনের নাম ছিল আব্দুল মাসীহ। তিনি ছিলেন আক্বিব। তাঁর দায়িত্ব ছিল অধিনায়কত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনা। দ্বিতীয় জনের নাম ছিল আইহাম অথবা শুরাহবিল। তিনি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদি দেখাশোনা করতেন, উপাধি ছিল সাইয়্যিদ। তৃতীয় জন হলেন আসক্বাফ’। তার নাম ছিল আবূ হারিসাহ বিন আলক্বামাহ। তিনি ছিলেন ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক নেতা (লাট পাদরী) উপকুফ।

মদীনায় পৌঁছার পর এ দলটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) এবং এ প্রতিনিধি দলের মধ্যে উভয় পক্ষের কিছু প্রশ্ন নিয়ে কথাবার্তা হয়। এরপর নাবী কারীম (ﷺ) তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করে শোনান। কিন্তু তাঁরা ইসলাম গ্রহণ না করে পাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন- ‘আপনি মাসীহ (আঃ) সম্পর্কে কী বলছেন? তাঁদের জবাবে কিছু না বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিরুত্তর রইলেন। অতঃপর নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হল:

‏(‏إِنَّ مَثَلَ عِيْسَى عِندَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثِمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُوْنُ - الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُن مِّن الْمُمْتَرِيْنَ - فَمَنْ حَآجَّكَ فِيْهِ مِن بَعْدِ مَا جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءنَا وَأَبْنَاءكُمْ وَنِسَاءنَا وَنِسَاءكُمْ وَأَنفُسَنَا وأَنفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَل لَّعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَاذِبِيْنَ‏)‏ ‏[‏آل عمران‏:‏59-61‏]‏‏

‘আল্লাহর নিকট ঈসার অবস্থা আদামের অবস্থার মত, মাটি দ্বারা তাকে গঠন করে তাকে হুকুম করলেন, হয়ে যাও, ফলে সে হয়ে গেল। এ বাস্তব ঘটনা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতেই, সুতরাং তুমি সংশয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে ব্যক্তি তোমার সাথে (ঈসার সম্বন্ধে) বিতর্ক করবে তাকে বল, ‘আসো, আমাদের পুত্রদেরকে এবং তোমাদের পুত্রদেরকে আর আমাদের নারীদেরকে এবং তোমাদের নারীদেরকে এবং আমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের নিজেদেরকে আহবান করি, অতঃপর আমরা মুবাহালা করি আর মিথ্যুকদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।’ [আল ‘ইমরান (৩) : ৫৯-৬১]

সকাল হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ আয়াত সমূহের আলোকে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে তাঁদের প্রশ্নের জবাব দেন এবং এর পর সারা দিন যাবত এ ব্যাপারে তাদের চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ দেন। কিন্তু তাঁরা ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত নাবী কারীম (ﷺ)-এর কথাবার্তা মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর পরবর্তী দিবস সকালের কথা যেহেতু দলের সদস্য ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত নাবী কারীম (ﷺ)-এর কথাবার্তা মেনে নিতে এবং ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদেরকে মুবাহালার জন্য দাওয়াত দিলেন। হাসান ও হোসাইন (রাঃ) একই চাদর পরিবেষ্টিত অবস্থায় আগমন করলেন। পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন ফাত্বিমাহ (রাঃ)।

প্রতিনিধি দল যখন লক্ষ্য করলেন যে, প্রকৃতই নাবী (ﷺ) সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছেন তখন নির্জনে গিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলেন। আকেব এবং সাইয়্যিদ একজন অপরজনকে বললেন, ‘দেখ মুবাহালা করো না। আল্লাহর কসম! তিনি যদি সত্যিই নাবী হন এবং আমরা তাঁর সঙ্গে মুলা‘আনত করি তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কখনই কৃতকার্য হবে না। পৃথিবীর উপরিভাগে আমাদের একটি লোম এবং নখও ধ্বংস হতে রক্ষা পাবে না। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ ব্যাপারে বিচারক নির্ধারণ করা হোক ।

কাজেই তাঁরা নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন যে, ‘আপনি যে দাবী করবেন আমরা তার মানার জন্য প্রস্তুত থাকব।’ এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের নিকট থেকে কর গ্রহণের স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং তাঁদের দুই হাজার জোড়া কাপড় প্রদানের স্বীকৃতি সাপেক্ষে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়। তাঁরা এ কাপড় প্রদান করবেন এক হাজার জোড়া রজব মাসে, এক হাজার জোড়া সফর মাসে। অধিকন্তু, এটাও স্বীকৃত হল যে, প্রতি জোড়া কাপড়ের সঙ্গে এক উকিয়া রৌপ্য (একশ বায়ান্ন গ্রাম) প্রদান করবে। এর বিনিময়ে নাবী কারীম (ﷺ) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর জামানত প্রদান করলেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করলেন। পক্ষান্তরে তাঁরা এ আরজি পেশ করলেন যে, তাঁদের নিকট হতে কর আদায়ের জন্য নাবী কারীম (ﷺ) যেন একজন আমানতদার প্রেরণ করেন। চুক্তি মোতাবেক এ কাজের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মতের আমানতদার আবূ উবাইদাহ বিন জাররাহকে প্রেরণ করেন।

এরপর তাদের মধ্যে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে। চরিত বিশারদগণের বর্ণনানুযায়ী সৈয়দ এবং আকেব নাজরানে প্রত্যাবর্তনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) তাঁদের সাদকা ও কর আদায়ের জন্য আলী (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। এটি একটি বিদিত বিষয় যে, মুসলিমগণের নিকট থেকেই সাদকা গৃহীত হয়ে থাকে।[1]

[1] ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ৯৪-৯৫ পৃঃ, যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ৩৮-৪১ পৃঃ। নাজরান প্রতিনিধিদলের বিস্তারিত বিবরণে কিছু বিরোধ আছে এবং সেই কারণেই কোন কোন মুহাক্কেকীন বলেছেন যে, নাজরানের প্রতিনিধিদল মদীনায় দু’বার এসেছিলেন। কিন্তু আমরা উপরে যা বর্ণনা করেছি সেটাই অমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য।