৮. সাক্বীফ প্রতিনিধি দল (وَفْدُ ثَقِيْفٍ):

তাবুক হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর ৯ম হিজরীর রমাযান মাসে এ দলটি খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হন। এ গোত্রের ইসলাম গ্রহণের পূর্বের ঘটনার গতি প্রকৃতি ছিল ৮ম হিজরীর যুল ক্বাদাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন ত্বায়িফ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের করেন তখন তাঁর মদীনায় পৌঁছার পূর্বেই এ গোত্রের সর্দার উরওয়াহ বিন মাসউদ সাক্বাফী মদীনায় আগমন করে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর নিজ কওমের নিকট ফিরে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। যেহেতু তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন এবং শুধু এটাই নয় যে, কওমের লোকেরা তাকে মান্য করে চলত বরং তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের মেয়েদের এবং মহিলাদের চাইতেও বেশী প্রিয় ভাবত। এ কারণেই তাঁর ধারণা ছিল যে, লোকেরা অবশ্যই তাঁকে অনুসরণ করে চলবে। কিন্তু যখন তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকলেন তখন সম্পূর্ণ উল্টো ফল ফলল। লোকেরা তীরের আঘাতে আঘাতে তাঁকে হত্যা করে ফেলল।

তাঁকে হত্যার পর একই অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হতে থাকে। কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এটা তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পার্শববর্তী অঞ্চলসমূহের যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার ক্ষমতা তাদের নেই। সুতরাং অবস্থার প্রেক্ষিতে আলাপ আলোচনা ও সলাপরামর্শের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে একজন লোক পাঠানোর সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করল এবং এ কাজের জন্য আবদে ইয়ালিল বিন ‘আমরকে মনোনীত করল কিন্তু এ কাজের জন্য সে প্রথমাবস্থায় রাজি হল না। তার আশঙ্কা ছিল যে, তার সঙ্গেও সে আচরণ করা হতে পারে যা উরওয়া বিন মাসউদ সাকাফীর সঙ্গে করা হয়েছিল। এ কারণে তিনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে আরও কিছু সংখ্যক লোক না পাঠালে আমার পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয়।’

লোকেরা তাঁর এ দাবী মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাহায্যকারীদের মধ্য হতে দু’জনকে এবং বনু মালিক গোত্রের মধ্য হতে তিনজনকে তাঁর সঙ্গে দিল। কাজেই, তাঁকে সহ মোট ছয় জনের সমন্বয়ে দলটি গঠিত হল। এ দলে উসমান বিন আবিল আস সাক্বাফীও ছিলেন যিনি ছিলেন বয়সে সর্বকনিষ্ঠ।

যখন তাঁরা খিদমতে নাবাবীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের জন্য মসজিদের এক কোণে একটি তাঁবু খাটিয়ে দিলেন। যাতে তাঁরা কুরআন শ্রবণ করতে এবং সাহাবীগণ (রাঃ)-কে সালাতরত অবস্থায় দেখতে পারেন। অতঃপর তাঁরা নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট যাতায়াত করতে থাকেন এবং তিনি তাঁদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান জানাতে থাকেন। অবশেষে তাঁদের নেতা প্রস্তাব করলেন যে, নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর নিজের এবং সাক্বীফ গোত্রের মধ্যে এমন একটি সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করে দেবেন যার মধ্যে ব্যভিচার, মদ্যপান এবং সুদ খাওয়ার অনুমতি থাকবে। অধিকন্তু, তাদের উপাস্য লাত বিদ্যমান থাকবে, তাদের জন্য সালাত মাফ করে দিতে হবে এবং তাদের মূর্তিগুলোকে বিনষ্ট করা হবে না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের অযৌক্তিক দাবীসমূহের কোনটিকেই মেনে নিতে পারলেন না। অতএব তাঁরা নির্জনে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে থাকলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাঁরা কোন উপায় স্থির করতে পারলেন না। অবশেষে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁরা একটি শর্ত আরোপ করলেন এবং তা হচ্ছে তাঁদের মূর্তি লাতকে বিনষ্ট করার ব্যাপারে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা কখনই নিজ হাতে তা ধ্বংস করবে না। উসমান বিন আবিল আস সাকাফীকে তাঁদের দলের নেতা মনোনীত করে দিলেন। কারণ, ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ এবং দ্বীন ও কুরআনের শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সব চাইতে উৎসাহী এবং অগ্রণী। এর কারণ ছিল দলের সদস্যগণ প্রত্যহ সকালে যখন খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হতেন তখন উসমান বিন আবিল আস শিবিরে থাকতেন। অতঃপর দলের লোকেরা যখন দুপুর বেলা শিবিরে ফিরে এসে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন তখন উসমান বিন আবিল আস রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে কুরআন পাঠ করতেন এবং দ্বীনের কথাবার্তা জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। তিনি যখন নাবী কারীম (ﷺ)-কে বিশ্রামের অবস্থায় পেতেন তখন আবূ বকরের খিদমতে গিয়ে হাজির হতেন। উসমান বিন আবিল আসের নেতৃত্ব অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যুবরণ করার সময়ের পর আবূ বাকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে যখন নব্য মুসলিমগণের মধ্যে ধর্মত্যাগের হিড়িক পড়ে যায় তখন সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা ধর্মত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন উসমান বিন আবিল ‘আস (রাঃ) সকলকে সম্বোধন করে বলল,

‏(‏يَا مَعْشَرَ ثَقِيْفٍ، كُنْتُمْ آخِرُ النَّاسِ إِسْلَاماً، فَلَا تَكُوْنُوْا أَوَّلُ النَّاسِ رِدَّةً، فَامْتَنِعُوْا عَنْ الرِّدَّةِ، وَثَبِّتُوْا عَلَى الْإِسْلَامِ‏)

‘হে সাক্বীফ গোত্রের লোকজনেরা! তোমরা সকলের শেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ। এখন স্বধর্ম ত্যাগ করলে সকলের পূর্বেই তোমরা স্বধর্ম ত্যাগী, তোমরা এভাবে স্বধর্ম ত্যাগ করো না।’ এ কথা শ্রবণের পর ধর্মত্যাগের চিন্তা পরিহার করে তাঁরা ইসলামের উপর সুদৃঢ় থাকেন।

যাহোক, দলের লোকেরা নিজ গোত্রীয় লোকজনদের নিকট ফিরে আসার পর তাঁদের প্রকৃত অবস্থা গোপন রেখে ভবিষ্যত লড়াইয়ের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে চিন্তান্বিত ও দুঃখিত হয়ে বলল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা ইসলাম গ্রহণ এবং ব্যভিচার, মদ ও সুদ পরিত্যাগ কর, অন্যথায় তোমাদের বিরুদ্ধে ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ করা হবে।’ এ কথা শ্রবণের পর প্রথমাবস্থায় সাক্বীফ গোত্রের লোকদের মধ্যে জাহেলিয়াত যুগের অহমিকা প্রাবল্য লাভ করে এবং দু’ তিন দিন যাবত তাঁরা যুদ্ধের কথাই চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। কিন্তু এর পর আল্লাহ তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেন, যার ফলে পুনরায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট লোক পাঠিয়ে তাঁর সমস্ত শর্ত মেনে নেয়ার চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ায় প্রতিনিধিদল প্রকৃত বিষয় প্রকাশ করে এবং যে সকল কথার পর উপর সন্ধি হয়েছিল তা সুস্পষ্টভাবে বলে। সব কিছু অবগত হওয়ার পর সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেন।

এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লাত মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্দেশ্যে খালিদ বিন ওয়ালীদের নেতৃত্বে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীর সমন্বয়ে গঠিত একটি দলকে প্রেরণ করেন। মুগীরা বিন শু‘বা দাঁড়িয়ে লৌহ নির্মিত গদা বিশেষ উত্তোলন করলেন এবং তাঁর সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি আপনাদের জন্য সাক্বীফদের সম্পর্কে একটু হাসির ব্যবস্থা করব।

অতঃপর লাতের উপর গুর্জ দ্বারা আঘাত করলেন এবং নিজেই মাটির উপর লুটিয়ে পড়লেন এবং পায়ের গোড়ালি দ্বারা মাটিতে আঘাত করতে থাকলেন। এ উদ্ভট দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ত্বায়িফবাসীদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হল। তারা বলতে লাগল ‘আল্লাহ মুগীরাকে ধ্বংস করুক’। লাত দেবী তাকে হত্যা করেছে’। এমন সময় মুগীরা লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের মন্দ করুন। এ তো হচ্ছে মাটি এবং পাথরের তৈরি একটি মূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। অতঃপর তিনি দরজার উপর আঘাত করেন এবং তা ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেন। এর পর সব চাইতে উঁচু দেয়ালের উপর ওঠেন, তাঁর সঙ্গে আরও কয়েক সাহাবীও ওঠেন। অতঃপর তা ভেঙ্গে মাটির সমতল করে ফেলেন। এমনকি ভিত পর্যন্ত উঠিয়ে ফেলেন এবং অলঙ্কার ও পোশাকাদি বাহির করে ফেলেন। সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় এ সব কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করেন। খালিদ (রাঃ) অলংকার ও পোশাকাদিসহ নিজ দলের সঙ্গে মদীনায় ফিরে আসেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লাতের মন্দির থেকে আনীত দ্রব্যাদি বন্টন করে দেন এবং নাবী (ﷺ)-এর সাহায্য এবং দ্বীনের সম্মানের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করেন।[1]

[1] যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ২৬-২৮ পৃঃ। ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫৩৭-৫৪২ পৃঃ।