উপরোল্লিখিত যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সপ্তম হিজরীর শওয়াল মাস পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন। এ সময় মদীনায় অবস্থান কালে তিনি যে সকল অভিযান প্রেরণ করেন তার বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল-

১. কুদাইদ অভিযান (৭ম হিজরী সফর কিংবা রবিউল আওয়াল মাস) :

বনু মুলাওওয়াহ গোত্রকে শায়েস্তার জন্য গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়সীর পরিচালনাধীনে কুদাইদ নামক স্থানে এ অভিযান প্রেরিত হয়। বনু মলুহ বিশর বিন সোয়াইদের বন্ধুগণকে হত্যা করেছিল। এ হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে এ অভিযান প্রেরিত হয়েছিল। এ অভিযাত্রী দল রাত্রি বেলা আক্রমণ করে বনু মলুহ গোত্রের অনেক লোককে হত্যা করেন এবং গবাদি পশু খেদিয়ে নিয়ে আসেন। শত্রু পক্ষ একটি বড় আকারের বাহিনীসহ মুসলিম বাহিনীকে অনুসরণ করে অগ্রসর হতে থাকে। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীর উপর পাল্টা আঘাত হানা। কিন্তু তারা যখন মুসলিম বাহিনীর কাছাকাছি এসে পড়েন তখন প্রবল বেগে বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে প্লাবন দেখা দেয়। এ প্লাবনই উভয় পক্ষের মধ্যে প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। সে সুযোগে মুসলিম বাহিনী নিরাপত্তা ও শান্তির মধ্য দিয়ে অবশিষ্ট পথ অতিক্রম করেন।

হিসমা অভিযান (৭ম হিজরী, জুমাদাস সানীয়াহ) : এ অভিযান সংক্রান্ত আলোচনা রাজন্যবর্গের নিকট পত্রলিখন অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

তুরাবাহ অভিযান (৭ম হিজরী শা‘বান মাস) : এ অভিযান প্রেরণ করা হয়েছিল উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর নেতৃত্বে। এ অভিযানে ত্রিশ জন মুসলিম সৈন্য অংশ গ্রহণ করেন। তাঁরা রাত্রি বেলা সফর করতেন এবং দিবা ভাগে আত্মগোপন করে থাকতেন। এ অভিযানের লক্ষ্যস্থল ছিল বনু হাওয়াযিন। মুসলিম অগ্রাভিযানের খবর পেয়ে বনু হাওয়াযিন পলায়ন করে যার ফলে মুসলিম বাহিনী সেখানে কাউকে না পেয়ে মদীনা ফিরে আসেন।

ফাদাক অঞ্চল অভিমুখে অভিযান (৭ম হিজরী শা‘বান মাস) : এ অভিযান প্রেরণ করা হয় বশীর বিন সা‘দ আনসারী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে বনু মুররার সংশোধন উপলক্ষে। এ অভিযাত্রী দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ত্রিশ জন। বশীর (রাঃ) তাদের অঞ্চলে পৌঁছে ভেড়া বকরী এবং গবাদী পশু খেদিয়ে নিয়ে মদীনার পথে অগ্রসর হন। কিন্তু রাত্রে শত্রুদল তাঁদের পশ্চাদনুসরণ করে। অভিযাত্রীগণ তাদের দিকে তীর নিক্ষেপ করে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তীর শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে তারা নিরস্ত্র হয়ে পড়েন এবং অবশেষে সকলকেই শাহাদত বরণ করতে হয়। কেবল মাত্র বশীর (রাঃ) আহত অবস্থায় জীবিত থাকেন। আহত অবস্থায় তাকে ফাদাকে আনা হয়। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ইহুদীগণের নিকট অবস্থান করেন। সুস্থতা লাভের পর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন।

মাইফা’আহ অভিযান (৭ম হিজরীর রমাযান মাস) : এ অভিযান প্রেরণ করা হয় গালিব বিন আব্দুল্লাহ লাইসীর নেতৃত্বে বনু ওয়াল ও বনু আবদ বিন সা’লাবাহর সংশোধন উপলক্ষে এবং বলা হয়েছে যে, জুহায়নাহ গোত্রের শাখা হারাকাতকে শিক্ষা দানের জন্য। অভিযাত্রীদলের সদস্য সংখ্যা ছিল একশ ত্রিশ।

মুসলিম মুজাহিদগণ সংঘবদ্ধভাবে শত্রুদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং যে কেউ মাথা উঁচু করে আক্রমণ প্রতিহত করতে আসে তাকে হত্যা করেন। অতঃপর শত্রুপক্ষের গবাদি পশুগুলো খেদিয়ে নিয়ে আসেন।

এ অভিযান কালে উসামা বিন যায়দ নাহিক বিন মের্দাসকে (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বলা সত্ত্বেও হত্যা করেছিলেন। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) নিন্দা করে বলেছিলেন,

(‏أَقَتَلْتَهُ بَعْدَ مَا قَالَ‏:‏ لَا إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ‏؟‏‏ فَهَلاَّ شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ فَتَعْلَمُ أَصَادِقٌ هُوْ أَمْ كَاذِبٌ‏؟‏‏)‏‏.‏

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করলে? ‘তুমি তার অন্তর চিরে কেন বুঝাবার চেষ্টা করল না? সে সত্যবাদী কি মিথ্যাবাদী ছিল?’

খায়বার অভিযান (৭ম হিজরী, শাওয়াল মাস) : এ অভিযান ছিল ত্রিশ জন ঘোড়সওয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি দল। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহার (রাঃ) নেতৃত্বে প্রেরিত হয়েছিল এ অভিযান। এ অভিযানের কারণ ছিল, আসীর অথবা বশীর বিন যারাম মুসলিমগণের উপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য গাত্বাফানদের একত্রিত করছিল।

মুসলিমগণ যথাস্থানে পৌঁছার পর আসীরকে এ মর্মে আশ্বাস প্রদান করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে খায়বারের গর্ভনর নিযুক্ত করবেন। তার ত্রিশ জন বন্ধুসহ তাঁদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য তাঁরা তাকে উদ্বুদ্ধ করলেন। কিন্তু কারকা নিয়ার পৌঁছার পর দু’ দলের মধ্যে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি হওয়ার ফলে আসীর এবং তার ত্রিশ জন সাথী মুসলিমগণের হাতে নিহত হয়। ওয়াক্বিদী এই সারিয়্যাকে খায়বারের কয়েকমাস পূর্বে ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

ইয়ামান ও জাবার অভিযান (৭ম হিজরী শাওয়াল মাস) : জাবার এর জিম-এ জবর (হরকত) আছে। এটা বনু গাত্বাফান এবং বলা হয়েছে যে, বনু ফাযারা ও বনু উযরা এলাকার নাম। বাশীর বিন কা‘ব আনসারী (রাঃ)-কে তিনশ মুসলিম সৈন্যের একটি দলসহ সেখানে প্রেরণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল মদীনার উপর আক্রমণ চালানোর লক্ষে প্রস্তুতি গ্রহণরত এক বিরাট বাহিনীকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়া। অভিযাত্রী মুসলিম বাহিনী রাত্রিবেলা পথ চলতেন এবং দিবাভাগে আত্মগোপন করে থাকতেন। শত্রুরা যখন বশীরের অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হল তখন তারা পলায়ন করল। বশীরের বাহিনী শত্রুপক্ষের দু’ ব্যক্তিকে বন্দী করতে এবং অনেকগুলো গবাদি পশু আয়ত্বে নিতে সক্ষম হন। বন্দী দু’জনকে খিদমতে নাবাবীতে হাজির করা হলে তারা ইসলাম গ্রহণ করে।

গা-বা অভিযান : ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম এ অভিযান উমরায়ে ক্বাযার পূর্বে ৭ম হিজরীর অভিযান সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ অভিযানের মূল কথা হচ্ছে, জাশম বিন মু’আবিয়া গোত্রের এক ব্যক্তি অনেক লোকজন নিয়ে গাবা নামক স্থানে আসে। তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বনু ক্বায়স গোত্রের লোকজনদের একত্রিত করা। এ সংবাদ অবগত হয়ে নাবী কারীম (ﷺ) আবূ হাদরাদ (রাঃ)-কে মাত্র দু’জন সঙ্গীসহ তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। হাদরাদ (রাঃ) এমন এক যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেন যার ফলে শত্রুদল শোচনীয় ভাবে পরাজয় বরণ করে। মুসলিম বাহিনী অনেক উট, ভেড়া ও ছাগল খেদিয়ে নিয়ে আসেন।[1]

[1] যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ১৪৯-১৫০ পৃ: এ অভিযানগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ২২৯-২৩১ পৃঃ, যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ১৪৮-১৫০ তালকীহুল ফুহুম, টীকাসহ ৩১ পৃ: আব্দুল্লাহ নাজদী লিখিত সীরাত গ্রন্থের ৩২২-৩২৪ পৃঃ।