যুদ্ধের শুরু এবং নায়িম দূর্গ বিজয় (بَدْءُ الْمَعْرِكَةِ وَفَتْحُ حِصْنِ نَاعِمٍ):

উল্লেখিত ৮টি দূর্গের মধ্যে সর্ব প্রথম নায়িম দূর্গের উপর আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। কারণ, অবস্থানগত দিক এবং যুদ্ধ কৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে এ দূর্গটি ছিল প্রথম শ্রেণীর ও সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ, অধিকন্তু, এটি ছিল মারহাব নামীয় সে পরাক্রান্ত ও পরিশ্রমী ইহুদীর দূর্গ যাকে এক হাজার পুরুষের সমকক্ষ মনে করা হতো।

আলী বিন আবূ ত্বালিব (রাঃ) মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে এ দূর্গের সামনে গিয়ে পৌঁছে ইহুদীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। তারা এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের সম্রাট মারহাবের পরিচালনাধীনে মুসলিমগণের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য অবস্থান গ্রহণ করল। প্রথমে মারহাব প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মুসলিমগণকে আহবান জানাল।

যার অবস্থা সম্পর্কে সালামাহ বিন আকওয়া বর্ণনা করেছেন যে, ‘যখন আমরা খায়বারে পৌঁছলাম তখন ইহুদী সম্রাট মারহাব স্বীয় তরবারী হস্তে আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করে গর্বভরে বলল,

قد عَلِمتْ خيبر أني مَرْحَب ** شَاكِي السلاح بطل مُجَرَّب

إذا الحروب أقبلتْ تَلَهَّب **

অর্থ : ‘খায়বার অবহিত আছে যে, আমি মারহাব অস্ত্রে সজ্জিত বীর এবং অভিজ্ঞ, যখন যুদ্ধ ও সংঘাত অগ্নিশিখা নিয়ে সামনে আসে।’

এ প্রেক্ষিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আমার চাচা ‘আমির এগিয়ে এসে বললেন,

قد علمت خيبر أني عامر ** شاكي السلاح بطل مُغَامِر

‘খায়বার জানে যে, আমি ‘আমির, অস্ত্র সজ্জিত, বীর এবং যোদ্ধা।’’

অতঃপর উভয়ে উভয়ের প্রতি আঘাত হানে। মারহাবের তরবারী আমার চাচার ঢালে গিয়ে বিদ্ধ হয়। ‘আমির তাকে নীচ হতে মারার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর তরবারী ছোট থাকার কারণে তিনি ইহুদীর পায়ের গোছার উপর আঘাত হানেন। কিন্তু সে আঘাত মারহাবের পায়ে না লেগে তাঁর নিজের হাঁটুতেই এসে লাগে। নিজের তলোয়ারে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েই অবশেষে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। নাবী কারীম (ﷺ) নিজের দুটি আঙ্গুল একত্রিত করে দেখিয়ে তাঁর সম্পর্কে বলেন যে,

‏(‏إنَّ لَهُ لَأَجْرَيْنِ ـ وَجَمَعَ بَيْنَ إِصْبَعَيْهِ ـ إِنَّهُ لَجَاهِدٌ مُجَاهِدٌ، قَلَّ عَرَبِيٌّ مَشٰي بِهَا مِثْلَهُ‏)

‘তিনি দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবেন। তিনি বড় পরিশ্রমী যোদ্ধা ছিলেন। অল্প সংখ্যকই তাঁর মতো কোন আরব জমিনের উপর চলে থাকবে।[1]

যাহোক, ‘আমির (রাঃ)-এর আহত হওয়ার পর মারহাবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আলী (রাঃ) গমন করেন।

সালামাহ বিন আকওয়া বর্ণনা করেন, ‘ঐ সময় আলী একটি কবিতার এ চরণ আবৃত্তি করছিলেন,

أنا الذي سمتني أمي حَيْدَرَهْ ** كلَيْثِ غابات كَرِيه المَنْظَرَهْ

أُوفِيهم بالصَّاع كَيْل السَّنْدَرَهْ **

অর্থ : আমি সেই ব্যক্তি আমার মাতা যার নাম রেখেছিলেন হায়দার (বাঘ) বনের বাঘের মতো ভয়ংকর, আমি তাদেরকে ‘সা’ এর বিনিময়ে বর্শার দ্বারা তাদের মাপ পূর্ণ করে দিব।

অতঃপর তিনি মারহাবের মাথার উপর তরবারী দ্বারা এমনভাবে আঘাত করলেন যে, সে সেখানে স্তুপ হয়ে গেল। এভাবে আলী (রাঃ)-এর হাতে বিজয় অর্জিত হল।[2]

যুদ্ধের মাঝে আলী (রাঃ) ইহুদীদের দূর্গের নিকট পৌঁছলেন তখন একজন ইহুদী দূর্গের উঁচু স্থান থেকে উঁকি দিয়ে দেখার পর জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে? আলী (রাঃ) বললেন, ‘আমি আলী বিন আবূ ত্বালিব।’

ইহুদী বলল, ‘সে গ্রন্থের শপথ! যা মুসা (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল, তোমরা সুউচ্চে রয়েছ।’

এরপর মারহাবের ভাই ইয়াসের এ কথা বলে বাহির হল, ‘কে এমন আছে যে, আমার সামনে আসবে?’

তার এ আহবানে যুবাইর (রাঃ) ময়দানে অবতরণ করেন। তাঁকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেখে তাঁর মা সাফিয়্যাহ (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার পুত্র কি শহীদ হয়ে যাবে?’

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘না, বরং তোমার ছেলে তাকে হত্যা করবে।’ কিছুক্ষণের মধ্যে আল্লাহর রাসূলের উক্তি সত্য প্রমাণিত হল, যুবাইর (রাঃ) ইয়াসিরকে হত্যা করলেন।

এরপর নায়িম দূর্গের নিকট উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ইহুদী নিহত হয়। অবশিষ্ট ইহুদীগণ হতোদ্যম হয়ে পড়ে যার ফলে মুসলিমগণের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে তারা অক্ষম হয়ে পড়ে। কতগুলো সূত্র থেকে জানা যায় যে, এ যুদ্ধ কয়েক দিন যাবত অব্যাহত ছিল এবং মুসলিমগণকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দূর্গ থেকে মুসলিমগণের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা নিরাশ হয়ে পড়েছিল। এ কারণে অত্যন্ত সঙ্গোপনে তারা এ দূর্গ পরিত্যাগ করে সা’ব নামক স্থানে চলে যায়। ফলে নায়িম দূর্গ মুসলমানদের দখলে চলে আসে।

[1] সহীহুল বুখারী খায়বার যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড ১২২ পৃঃ। যী কারাদ ইত্যাদি যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড ১১৫, সহীহুল বুখারী খায়বার যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড ৬০৩ পৃঃ।

[2] মারহাবের হত্যাকারীর নামের ব্যাপারে অনেক মত বিরোধ রয়েছে, তাছাড়া এ তথ্যের মধ্যেও মত বিরোধ রয়েছে যে কোন দিন তাকে হত্যা করা হয়েছিল এবং কোন দিন এ দূর্গ জয় করা হয়েছিল। সহীহাইনের বর্ণনা করেছি তা বুখারীর র্বণনাকে প্রধান্য দিয়ে স্থির করেছি।