মুসলিমগণের বিষণ্ণতা এবং উমার (রাঃ)-এর বিতর্ক (حُزْنُ الْمُسْلِمِيْنَ وَمُنَاقَشَةُ عُمَرُ النَّبِيَّ ﷺ):

হুদায়বিয়াহ সন্ধি চুক্তির শর্তাদি এবং তার সমীক্ষাসূচক আলোচনা ইতোপূর্বে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এ শর্ত সমূহের মধ্যে দুটি শর্ত স্পষ্টতঃ এ প্রকারের ছিল যা মুসলিমগণের মনে দারুন দুঃখ, বেদনা, হতাশা ও বিষণ্ণতার ভাব সৃষ্টি করেছিল। সেগুলো হচ্ছে (১) বিষয়টি ছিল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন যে, তিনি আল্লাহর ঘরের নিকট গমন করবেন এবং তাওয়াফ করবেন, কিন্তু পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাওয়াফ না করেই মদীনা ফিরে যাওয়ার শর্তে তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন। (২) দুঃখ-বেদনার দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল, তিনি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলাভ তাঁর দ্বীনকে জয়যুক্ত করবেন বলে তিনি ঘোষণাও দিয়েছিলেন, অথচ কুরাইশগণের চাপে পড়ে কী কারণে তিনি সন্ধির এ অবমাননাকর শর্তে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন তা কিছুতেই মুসলিমগণের বোধগম্য হচ্ছিল না। এ দুটি বিষয় মুসলিমগণের মনে দারুণ সংশয় সন্দেহ এবং শঙ্কার সৃষ্টি করেছিল। এ দুটি বিষয়ে মুসলিমগণের অনুভূতি এতই আঘাতপ্রাপ্ত ও আহত হয়েছিল যে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে এর সুদূর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার মতো মানসিক ধৈর্য তাঁদের ছিল না। ভাবানুভূতির ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন এবং সম্ভবত উমার (রাঃ) আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সব চাইতে বেশী।

তিনি নাবী কারীম (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিতত হয়ে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমরা কি সত্যের উপর দন্ডায়মান নই এবং কাফিরেরা বাতিলের উপর?

নাবী কারীম (ﷺ) উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই।’

তিনি পুনরায় আরয করলেন, ‘আমাদের শহীদগণ জান্নাতে এবং তাদের নিহতগণ কি জাহান্নামে নয়? ‘তিনি বললেন, ‘কেন নয়।’

উমার বললেন, ‘তবে কেন আমরা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে মুশরিকদের চাপে পড়ব এবং এমন অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করব যে, এখনও আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ও তাদের মধ্যে কোনই ফয়সালা করেন নি?’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‏(‏يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، إِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ وَلَسْتُ أَعْصِيَهُ، وَهُوَ نَاصِرِيْ وَلَنْ يُضَيِّعَنِيْ أَبَداً‏)

‘ওহে খাত্তাবের সন্তান! আমি আল্লাহর রাসূল এবং কখনই তাঁর অবাধ্য হতে পারব না। আমি বিশ্বাস করি যে সকল প্রয়োজনে তিনিই সাহায্য করবেন এবং কখনই আমাকে ধ্বংস হতে দেবেন না।’

উমার (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কি আমাদের বলেন নি যে, আপনি আল্লাহর ঘরের নিকট গমন করবেন এবং তাওয়াফ করবেন?’

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (‏بَلٰى، فَأُخْبِرْتُكَ أِنَّا نَأْتِيَهُ الْعَامَ‏؟‏‏)‏ ‘অবশ্যই, কিন্তু আমি কি এ কথা বলেছিলাম যে, আমরা এ বছরই আসব।’

তিনি উত্তর করলেন, ‘না’

নাবী (ﷺ) বললেন, (‏فإنك آتيه ومطوف به‏)‏‏ ‘যাহোক ইনশাআল্লাহ্ তোমরা আল্লাহর ঘরের নিকট আসবে এবং তাওয়াফ করবে।

এরপর উমার (রাঃ) ক্রোধে ও অভিমানে অগ্নিশর্মা হয়ে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং তাকেও সে সব কথা বললেন যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলেছিলেন। প্রত্যুত্তরে আবূ বাকরও (রাঃ) সে সব কথাই বললেন যা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছিলেন এবং পরিশেষে এটুকুও বললেন যে, ধৈর্য সহকারে নাবী (ﷺ) পথের উপর দন্ডায়মান থাক যতক্ষণ পর্যন্ত সত্য সমাগত না হয়। কেননা আল্লাহর শপথ তিনি সত্যের উপরেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন।’

এরপর‏(‏إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِيْنًا‏‏‏)‏ ‘আমি তোমাকে দিয়েছি স্পষ্ট বিজয়।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ১] আয়াত অবতীর্ণ হয়। যার মধ্যে এ সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় প্রমাণ করা হয়েছে। এ আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উমার (রাঃ)-কে আহবান করলেন এবং আয়াতটি পড়ে শোনালেন। তিনি তখন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি একে বিজয় বলতে পারি?

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।

এতে তিনি সাত্ত্বনা লাভ করলেন এবং সেখান থেকে চলে গেলেন।

পরে উমার (রাঃ) যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন তখন অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। এ ব্যাপারে তাঁর নিজের বর্ণনা হচ্ছে, ‘আমি সে দিন যে ভুল করেছিলাম এবং যে কথা বলেছিলাম তাতে ভীত হয়ে আমি অনেক আমল করেছি, প্রচুর দান খয়রাত করে আসছি, রোযা রেখে আসছি এবং দাস মুক্ত করে আসছি। এত শত করার পর এখন আমার মঙ্গলের আশা করছি।[1]

[1] হুদায়বিয়াহ সন্ধির চু্ক্তির বিস্তারিত বিবরণের উৎসগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪৩-৪৫৮৮, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৭৮-৩৮১পৃ, ২য় খন্ড, ৫৯৮-৬০০ ও ৭১৭ পৃঃ, সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৪-১০৬ পৃঃ। ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩০৮-৩২২ পৃঃ। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১২২-১২৭ পৃঃ, মুখতাসারুস সীরাহ (শাইখ আব্দুল্লাহ রচিত) ২০৭-৩৫০ পৃঃ, ইবনু জাওযী লিখিত তারীখে উমার বিন খাত্তাব ৩৯-৪০ পৃঃ।