২. মিথ্যা অপবাদের ঘটনা (حَدِيْثُ الْإِفْكِ):

উল্লেখিত যুদ্ধের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল মিথ্যা অপবাদের ব্যাপারটি। এ ঘটনার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিয়ম ছিল সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি তাঁর পবিত্র পত্নীগণের মধ্যে লটারী করে নিতেন। লটারীতে যাঁর নাম উঠত তাঁকে তিনি সফরে নিয়ে যেতেন। এ অভিযান কালে লটারীতে ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর নাম বাহির হয়। সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সফরে যান।

অভিযান শেষে মদীনা প্রত্যাবর্তনের পথে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করা হয়। শিবিরে থাকা অবস্থায় ‘আয়িশাহ (রাঃ) নিজ প্রয়োজনে শিবিরের বাহিরে গমন করেন। সফরের উদ্দেশ্যে যে স্বর্ণাহারটি তাঁর বোনের নিকট থেকে নিয়ে এসেছিলেন এ সময় তা হারিয়ে যায়। হারানোর সময় হারের কথাটি তাঁর স্মরণেই ছিল না। বাহির থেকে শিবির ফিরে আসার পর হারানো হারের কথাটি স্মরণ হওয়া মাত্রই তার খোঁজে তিনি পুনরায় পূর্বস্থানে গমন করেন। এ সময়ের মধ্যেই যাঁদের উপর নাবী পত্নির (রাঃ) হাওদা উটের পিঠে উঠিয়ে দেয়ার দায়িত্ব অর্পিত ছিল তাঁরা হাওদা উঠিয়ে দিলেন। তাদের ধারণা যে, উম্মুল মু’মিনীন হাওদার মধ্যেই রয়েছেন। যেহেতু তাঁর শরীর খুব হালকা ছিল সেহেতু হাওদা হালকা থাকার ব্যাপারটি তাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া করে নি। তাছাড়া, হাওদাটি দু’ জনে উঠালে হয়তো তাদের পক্ষে অনুমান করা সহজ হতো এবং সহজেই ভুল ধরা পড়ত। কিন্তু যেহেতু কয়েক জন মিলে মিশে ধরাধরি করে হাওদাটি উঠিয়ে ছিলেন ব্যাপারটি অনুমান করার ব্যাপারে তাঁরা কোন ভ্রুক্ষেপই করেন নি।

যাহোক, হারানো হারটি প্রাপ্তির পর মা ‘আয়িশাহ (রাঃ) আশ্রয়স্থলে ফিরে এসে দেখলেন যে পুরো বাহিনী ইতোমধ্যে সে স্থান পরিত্যাগ করে এগিয়ে গিয়েছেন। প্রান্তরটি ছিল সম্পূর্ণ জনশূন্য। সেখানে না ছিল কোন আহবানকারী, না ছিল কোন উত্তরদাতা। তিনি এ ধারণায় সেখানে বসে পড়লেন যে, লোকেরা তাঁকে যখন দেখতে না পাবেন তখন তাঁর খোঁজ করতে করতে এখানেই এসে যাবেন। কিন্তু সর্বজ্ঞ ও সর্বত্র বিরাজিত প্রজ্ঞাময় প্রভূ আল্লাহ তা‘আলা আপন কাজে সদা তৎপর ও প্রভাবশালী। তিনি যে ভাবে যা পরিচালনা করার ইচ্ছা করেন সে ভাবেই তা বাস্তবায়িত হয়। অতএব, আল্লাহ তা‘আলাভ ‘আয়িশাহর (রাঃ) চক্ষুদ্বয়কে ঘুমে জড়িয়ে দেয়ায় তিনি সেখানে ঘুমিয়ে পড়লেন। অতঃপর সফওয়ান বিন মু’আত্তাল এর কণ্ঠস্বর শুনে তিনি জাগ্রত হলেন। তিনি বলছিলেন, ‘ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর স্ত্রী?’

সফওয়ান (রাঃ) সেনাদলের শেষ অংশে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল একটু বেশী ঘুমানো। ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে এ অবস্থায় দেখা মাত্রই তিনি চিনতে পারলেন। কারণ, পর্দার হুকুম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি তাঁকে দেখেছিলেন। অতঃপর ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠরত অবস্থায় তিনি আপন সওয়ারীকে নাবী পত্নীর (রাঃ) নিকট বসিয়ে দিলেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ) সওয়ারীর উপর আরোহণ করার পর তিনি তার লাগাম ধরে টানতে টানতে হাঁটতে থাকলেন এবং সর্বক্ষণ মুখে উচ্চারণ করতে থাকলেন ইন্না লিল্লাহি...........।

সফওয়ান ইন্নালিল্লাহ... ছাড়া অন্য কোন বাক্য উচ্চারণ করেননি। সাফওয়ান (রাঃ) ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে যখন সৈন্যদলে মিলিত হলেন, তখন ছিল ঠিক খরতপ্ত দুপুর। সৈন্যদল শিবির স্থাপন করে বিশ্রামরত ছিলেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে এ অবস্থায় আসতে দেখে লোকেরা আপন আপন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির নিরিখে ব্যাপারটি আলোচনা পর্যালোচনা করতে থাকলেন। সৎ প্রকৃতির লোকেরা এটাকে সহজ ভাবেই গ্রহণ করল। কিন্তু অসৎ প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির লোকেরা এটাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে চিন্তা করতে থাকল নানা ভাবে। বিশেষ করে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর দুশমন অপবিত্র খবিশ আব্দুল্লাহ বিন উবাই এটিকে পেয়ে বসল তার অপপ্রচারের একটি মোক্ষম সুযোগ হিসেবে। সে তার অন্তরে কপটতা, হিংসা বিদ্বেষের যে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত রেখেছিল এ ঘটনা তাতে ঘৃতাহুতির ন্যায় অধিকতর প্রভাবিত ও প্রজ্জ্বলিত করে তুলল। সে এ সামান্য ঘটনাটিকে তার স্বকপোলকল্পিত নানা আকার প্রচার ও রঙচঙে চিত্রিত ও রঞ্জিত করে ব্যাপকভাবে অপপ্রচার শুরু করে দিল।

পুণ্যের তুলনায় পাপের প্রভাবে মানুষ যে সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে এ সত্যটি আবারও অত্যন্ত নিষ্করুণভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের এ অপপ্রচারে অনেকেই প্রভাবিত হয়ে পড়ল এবং তারাও অপপ্রচার শুরু করল। এমনি দ্বিধান্দ্ব ও ভারাক্রান্ত মানসিকতাসম্পন্ন বাহিনীসহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা প্রত্যাবর্তন করলেন। মুনাফিক্বেরা মদীনা প্রত্যাবর্তনের পথে আরও জোটবদ্ধ হয়ে অপপ্রচার শুরু করে দিল।

এ অপবাদ ও অপপ্রচারের মুখোমুখী হয়ে রাসূলে কারীম (ﷺ) ওহীর মাধ্যমে এর সমাধানের আশায় নীরবতা অবলম্বন করলেন।

কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা সত্ত্বেও ওহী নাযিল না হওয়ায় ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে পৃথক থাকার ব্যাপারে তিনি তাঁর সাহাবাবর্গের সঙ্গে পরামর্শের ব্যবস্থা করলেন। আলী (রাঃ) আভাষ ইঙ্গিতে তাঁকে পরামর্শ দিলেন তাঁর থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে অন্য কোন মহিলাকে বিবাহ করার জন্য। কিন্তু উসামা ও অন্যান্য সাহাবীগণ (রাযি.) শত্রুদের কথায় কান না দিয়ে ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে তাঁর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাখার পরামর্শ দিলেন।

এরপর আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের কপটতাজনিত কষ্ট হতে অব্যাহতি লাভের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বরে উঠে এক ভাষণের মাধ্যমে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এ প্রেক্ষিতে সা‘দ বিন মোয়ায তাকে হত্যা করার অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু সা‘দ বিন উবাদা (যিনি আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের খাযরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন) গোত্রীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে খুব শক্তভাবে এর বিরোধিতা করায় উভয়ের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যার ফলে উভয় গোত্রের লোকেরাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক চেষ্টা করে উভয় গোত্রের লোকজনদের উত্তেজনা প্রশমিত করেন এবং নিজেও নীরবতা অবলম্বন করেন।

এদিকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ‘আয়িশাহ (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক নাগাড়ে এক মাস যাবৎ অসুস্থতায় ভুগতে থাকেন। এ অপবাদ সম্পর্কে অবশ্য তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু তাঁর অসুস্থ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র কাছ থেকে যে আদর যত্ন ও সেবা শুশ্রূষা পাওয়ায় কথা তা না পাওয়ার তাঁর মনে কিছুটা অস্বস্তি ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়ে যায়।

বেশ কিছু দিন যাবত রোগ ভোগের পর ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুস্থতা লাভের পর পায়খানা প্রস্রাবের জন্য এক রাত্রি তিনি উম্মু মিসত্বাহর সঙ্গে সন্নিকটস্থ মাঠে গমন করেন। হাঁটতে গিয়ে এক সময় উম্মু মিসত্বাহ স্বীয় চাদরের সঙ্গে জড়ানো অবস্থায় পা পিছলিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এ অবস্থায় সে নিজের ছেলেকে গালমন্দ দিতে থাকে। ‘আয়িশাহ (রাঃ) তাঁর ছেলেকে গালমন্দ দেয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলায় সে বলে, আমার ছেলেও সে অপবাদ সম্পর্কিত অপপ্রচারে জড়িত আছে, বলে অপবাদের কথা ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে শোনান। ‘আয়িশাহ (রাঃ) সে অপবাদ ও অপপ্রচার সম্পর্কে জানতে চাইলে উম্মু মিসত্বাহ তাঁকে সকল কথা খুলে বলেন। এভাবে তিনি অপবাদের কথা জানতে পারেন। এ খবরের সত্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর পিতা-মাতার নিকট যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অনুমতি চাইলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে অনুমতি প্রদান করলে তিনি পিতা-মাতার নিকট গমন করলেন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিতরূপ অবগত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। নিরবচ্ছিন্ন কান্নার মধ্যে তাঁর দু’ রাত ও এক দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। ঐ সময়ের মধ্যে ক্ষণিকের জন্যও তাঁর অশ্রুর ধারা বন্ধ হয় নি কিংবা ঘুমও আসেনি। তাঁর এ রকম একটা উপলব্ধি হচ্ছিল যে, কান্নার চোটে তাঁর কলিজা ফেটে যাবে। ঐ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখানে তাশরীফ আনয়ন করলেন এবং কালিমা শাহাদাত সমন্বয়ে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রদান করলেন। অতঃপর ইরশাদ করলেন,

‏(‏أَمَّا بَعْدُ يَا عَائِشَةَ، فَإِنَّهُ قَدْ بَلَغَنِيْ عَنْكَ كَذَا وَكَذَا، فَإِنْ كَنْتِ بِرَيْئَةٍ فَسَيُبْرِئُكَ اللهُ، وَإِنْ كُنْتِ أَلْمَمْتِ بِذَنْبٍ فَاسْتَغْفِرِيْ اللهَ وَتُوْبِيْ إِلَيْهِ، فَإِنَّ الْعَبْدَ إَِذَا اعْتَرَفَ بِذََنْبِهِ، ثُمَّ تَابَ إِلٰى اللهِ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ‏)‏‏.‏

‘হে ‘আয়িশাহ তোমার সম্পর্কে কিছু জঘন্য কথাবার্তা আমার কানে এসেছে। যদি তুমি এ কাজ থেকে পবিত্র থাক তাহলে আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ করে এর সত্যতা প্রকাশ করে দেবেন। আর আল্লাহ না করুন, তোমার দ্বারা যদি কোন পাপ কাজ হয়ে থাকে তাহলে তুমি আল্লাহ তা‘আলার সমীপে ক্ষমাপ্রার্থী হও এবং তওবা কর। কারণ, পাপ কাজের পর কোন বান্দা যখন অনুতপ্ত হয়ে খালেস অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার সমীপে তওবা করে তিনি তা কবুল করেন।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য শোনার পর ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর অশ্রুধারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল। তাঁর চোখে তখন এক ফোঁটা পানিও যেন অবশিষ্ট ছিল না। তিনি তাঁর পিতা-মাতাকে বললেন যে, তাঁদেরকে নাবী (ﷺ)-এর এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। কিন্তু জবাব দেয়ার মতো কোন ভাষাই যেন তাঁরা খুঁুজে পেলেন না। পিতা-মাতাকে অত্যন্ত অসহায় ও নির্বাক দেখে ‘আয়িশাহ (রাঃ) নিজেই বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আপনারা যে কথা শুনেছেন তা আপনাদের অন্তরকে প্রভাবিত করেছে এবং আপনারা তাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। এ কারণে, আমি যদি বলি যে, আমি সম্পূর্ণ পাক পবিত্র আছি এবং আল্লাহ অবশ্যই অবগত আছেন যে, আমি পবিত্র আছি, তবুও আপনারা আমার কথাকে সত্য বলে মেনে নেবেন না। আর যদি আমি ঐ জঘন্য অপবাদকে সত্য বলে স্বীকার করে নেই। অথচ আল্লাহ তা‘আলা অবগত আছেন যে, আমি তা থেকে পবিত্র আছি- তবে আপনারা আমার কথাকে সত্য বলে মেনে নেবেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর কসম! আমার ও আপনাদের জন্য ঐ উদাহরণটাই প্রযোজ্য হবে যা ইউসূফ (আঃ)-এর পিতা বলেছিলেন :

‏(‏فَصَبْرٌ جَمِيْلٌ وَاللهُ الْمُسْتَعَانُ عَلٰى مَا تَصِفُوْنَ‏)‏ ‏[‏يوسف‏:‏ 18‏]‏‏

‘ধৈর্য ধারণই উত্তম পথ এবং তোমরা যা বলছ তার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি।’ [ইউসুফ (১২) : ১৮]

এরপর ‘আয়িশাহ (রাঃ) অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন এবং ঐ সময়ই রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর উপর ওহী নাযিল আরম্ভ হয়ে গেল। অতঃপর যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর উপর ওহী নাযিলে কঠিন অবস্থা অতিক্রান্ত হল তখন তিনি মৃদু মৃদু হাসছিলেন। এ সময় তিনি প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন তা হচ্ছে, (‏يَا عَائِشَةُ، أَمَا اللهُ فَقَدْ بَرِأَكِ‏) ‘হে ‘আয়িশাহ! আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর আম্মা বললেন, ‘(‘আয়িশাহ!) উঠে দাঁড়াও (হুজুরের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর)। ‘আয়িশাহ (রাঃ) স্বীয় সতীত্ব ও রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর ভালবাসার উপর ভরসা করে গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তো তাঁর সামনে দাঁড়াব না, শুধুমাত্র আল্লাহর প্রশংসা করব।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিথ্যা অপবাদ সম্পর্কিত যে আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয় তা ছিল সূরাহ নূরের দশটি আয়াত।

(إِنَّ الَّذِيْنَ جَاءُوْا بِالْأِفْكِ عُصْبَةٌ مِنْكُمْ لَا تَحْسَبُوْهُ شَرّاً لَكُمْ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ مَا اكْتَسَبَ مِنَ الْأِثْمِ وَالَّذِيْ تَوَلَّى كِبْرَهُ مِنْهُمْ لَهُ عَذَابٌ عَظِيْمٌ - لَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوْهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بِأَنْفُسِهِمْ خَيْراً وَقَالُوْا هٰذَا إِفْكٌ مُبِيْنٌ - لَوْلَا جَاءُوْا عَلَيْهِ بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَإِذْ لَمْ يَأْتُوْا بِالشُّهَدَاءِ فَأُوْلَئِكَ عِنْدَ اللهِ هُمُ الْكَاذِبُوْنَ - وَلَوْلَا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ فِيْ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِيْ مَا أَفَضْتُمْ فِيْهِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ - إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ وَتَقُوْلُوْنَ بِأَفْوَاهِكُمْ مَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَتَحْسَبُوْنَهُ هَيِّناً وَهُوَ عِنْدَ اللهِ عَظِيْمٌ - وَلَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوْهُ قُلْتُمْ مَا يَكُوْنُ لَنَا أَنْ نَتَكَلَّمَ بِهٰذَا سُبْحَانَكَ هٰذَا بُهْتَانٌ عَظِيْمٌ - يَعِظُكُمُ اللهُ أَنْ تَعُوْدُوْا لِمِثْلِهِ أَبَداً إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ - وَيُبَيِّنُ اللهُ لَكُمُ الْآياتِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ - إِنَّ الَّذِيْنَ يُحِبُّوْنَ أَنْ تَشِيْعَ الْفَاحِشَةُ فِيْ الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ فِيْ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ - وَلَوْلَا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ وَأَنَّ اللهَ رَؤُوْفٌ رَحِيْمٌ)

‘১১. যারা এ অপবাদ উত্থাপন করেছে তারা তোমাদেরই একটি দল, এটাকে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর মনে কর না, বরং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে প্রতিফল যতটুকু পাপ সে করেছে। আর এ ব্যাপারে যে নেতৃত্ব দিয়েছে তার জন্য আছে মহা শাস্তি। তোমরা যখন এটা শুনতে পেলে তখন কেন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন স্ত্রীরা তাদের নিজেদের লোক সম্পর্কে ভাল ধারণা করল না আর বলল না, ‘এটা তো খোলাখুলি অপবাদ।’ তারা চারজন সাক্ষী হাযির করল না কেন? যেহেতু তারা সাক্ষী হাযির করেনি সেহেতু আল্লাহর নিকট তারাই মিথ্যেবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের উপর যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত, তবে তোমরা যাতে তড়িঘড়ি লিপ্ত হয়ে পড়েছিলে তার জন্য মহা শাস্তি তোমাদেরকে পাকড়াও করত। যখন এটা তোমরা মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে আর তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কথা বলছিলে যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান ছিল না, আর তোমরা এটাকে নগণ্য ব্যাপার মনে করেছিলে, কিন্তু আল্লাহর নিকট তা ছিল গুরুতর ব্যাপার। তোমরা যখন এটা শুনলে তখন তোমরা কেন বললে না যে, এ ব্যাপারে আমাদের কথা বলা ঠিক নয়। আল্লাহ পবিত্র ও মহান, এটা তো এক গুরুতর অপবাদ! আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন তোমরা আর কখনো এর (অর্থাৎ এ আচরণের) পুনরাবৃত্তি করো না যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক। আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্টভাবে আয়াত বর্ণনা করছেন, কারণ তিনি হলেন সর্ববিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী, বড়ই হিকমাতওয়ালা। যারা পছন্দ করে যে, মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার বিস্তৃতি ঘটুক তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে (তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে), আল্লাহ দয়ার্দ্র, বড়ই দয়াবান।’ [আন্-নূর (২৪) ১১-২০]

এরপর মিথ্যা অপবাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের অপরাধের দায়ে মিসত্বাহ বিন আসাস, হাসসান বিন সাবেত এবং হামনাহ বিনতে জাহশকে আশি (৮০) দোররা কার্যকর করা হল।[1] তবে খবিস আব্দুল্লাহ বিন উবাই এ শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে গেল। অথচ অপবাদ রটানোর কাজে জড়িত জঘন্য ব্যক্তিদের মধ্যে সে ছিল প্রথমে এবং এ ব্যাপারে সব চাইতে অগ্রগামী ভূমিকা ছিল তারই। তাকে শাস্তি না দেয়ার কারণ হয়তো এটাই ছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা পরকালে তাকে শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাকে এখন শাস্তি প্রদান করা হলে তার পরকালের শাস্তি হালকা হয়ে যাবে এ ধারণায় শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় নি। কিন্তু অন্যান্য যাদের জন্য শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা হয় তাদের পরকালীন পাপ ভার হালকা এবং পাপসমূহের কাফফারা হিসেবেই তা করা হয়। অথবা এমন কোন ব্যাপার এর মধ্যে নিহিত ছিল যে কারণে তাকে হত্যা করা হয় নি।[2]

এভাবে এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সন্দেহ, আশঙ্কা, অশান্তি, অশুভ ও ব্যাকুলতার বিষবাষ্প থেকে মদীনার আকাশ বাতাস পরিস্কার হয়ে উঠল। এর ফলশ্রুতিতে আব্দুল্লাহ ইবনু্ উবাই এতই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হল যে, সে আর দ্বিতীয়বার মস্তক উত্তোলন করতে সক্ষম হল না। ইবনু ইসহাক্ব বলেছেন যে, এর পর যখনই সে কোন গন্ডগোল পাকাতে উদ্যত হয় তখনই তার লোকজনেরা তাকে ভৎর্সনা ও তিরস্কার করতে থাকত এবং বলপ্রয়োগ করে বসিয়ে দিত। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উমার (রাঃ)-কে বললেন,

‏(‏كَيْفَ تَرٰى يَا عُمَرُ‏؟‏ أَمَا وَاللهِ لَوْقَتَلْتَهُ يَوْمَ قُلْتَ لِيْ ‏:‏ اُقْتُلْهُ، لَأَرْعَدَتْ لَهُ آنِفٌ، وَلَوْ أَمَرْتُهَا الْيَوْمَ بِقَتْلِهِ لَقَتَلَتْهُ‏)

হে উমার! এ ব্যাপারে তোমার ধারণা কী? দেখ আল্লাহর শপথ! যে দিন তুমি আমার নিকট অনুমতি চেয়েছিলে সে দিন যদি আমি অনুমতি দিতাম আর যদি তুমি তাকে হত্যা করতে তাহলে এ জন্য অনেকেই বিরূপ মনোভাব পোষণ করত। কিন্তু আজকে যদি সেই সব লোকদের আদেশ দেয়া হয় তাহলে তারাই তাকে হত্যা করবে।

উমার (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি ভাল ভাবেই হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছি যে, রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর কাজ আমার কাজের তুলনায় অনেক বেশী বরকতপূর্ণ।[3]

[1] ইসলামী শরীয়তে এরূপ বিধান আছে যে কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয় অথচ প্রমাণ পেশ করতে সক্ষম না হয় তাহলে তাকে আশি কোড়া মারতে হবে।

[2] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৬৪ পৃঃ, ২য় খন্ড ৬৯৬-৬৯৮ পৃঃ, যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ১১৩-১১৫ পৃঃ. ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ২৯৭-৩০০ পৃঃ।

[3] ইকসু হিশাম ২য় খন্ড ২৯৩ পৃঃ।