আর-রাহীকুল মাখতূম উহুদ যুদ্ধ (غَزْوَةُ أُحُدٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
মদীনায় প্রত্যাবর্তন এবং প্রেম-প্রীতি ও আত্মোৎসর্গের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের অসাধারণ ঘটনাবলী (الرُّجُوْعُ إِلَى الْمَدِيْنَةِ، وَنَوَادِرُ الْحَبِّ وَالتّفاَنِيْ):

শহীদদের দাফন কাফন এবং মহা মহিমান্বিত আল্লাহর গুণগান ও তাঁর নিকট দু‘আর কাজ শেষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। যুদ্ধকালে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) হতে প্রেম ও আত্মত্যাগের অসাধারণ ঘটনাবলী প্রকাশিত হয়েছিল, ঠিক তেমনই পথ চলাকালে মুসলিম মহিলাগণ হতেও সত্যবাদিতা ও আত্মত্যাগের বিস্ময়কর ঘটনাবলী প্রকাশ পেয়েছিল।

পথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে হামনাহ বিনতে জাহশ (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। তাঁকে তাঁর ভ্রাতা আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ)-এর শাহাদতের সংবাদ দেয়া হয়। তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাঁর মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করেন। তারপর তাঁর মামা হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)-এর শাহাদতের খবর দেয়া হয়। তিনি আবার ইন্নালিল্লাহ পড়েন ও তাঁর মাগফিরাতের জন্য দুআ করেন। এরপর তাঁকে তাঁর স্বামী মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ)-এর শাহাদতের সংবাদ দেয়া হয়। এ খবর শুনে তিনি অস্থিরভাবে চিৎকার করে উঠেন এবং হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‏‏ (‏إِنَّ زَوْجَ الْمَرْأَةِ مِنْهَا لَبِمَكَانٍ‏)‏ ‘স্ত্রীর কাছে স্বামীর বিশেষ এক মর্যাদা আছে।’[1]

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু দীনার গোত্রের এক মহিলার পাশ দিয়ে গমন করেন যার স্বামী, ভ্রাতা এবং পিতা এ তিন জন শাহাদতের পিয়ালা পান করেছিলেন। তাঁকে এদের শাহাদতের সংবাদ দেয়া হলে তিনি বলে ওঠেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর কী?’ সাহাবীগণ উত্তর দেন, ‘হে উম্মু ফুলান, তুমি যেমন চাচ্ছ তিনি তেমনই আছেন (অর্থাৎ তিনি বেঁচে আছেন।)।’ মহিলাটি বললেন, ‘তাঁকে একটু আমাকে দেখিয়ে দিন, আমি তার দেহ মুবারক একটু দেখতে চাই।’ সাহাবীগণ ইঙ্গিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়া মাত্রই হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, (كُلُّ مُصِيْبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ) অর্থাৎ ‘আপনাকে পেলে সব বিপদই নগণ্য।’[2]

পথে চলাকালেই সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর মা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আসেন। ঐ সময় সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এ ঘোড়ার লাগাম ধরেছিলেন। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ইনি আমার মাতা।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন ‘মারহাবা’ বলেন। অতঃপর তাঁর অভ্যর্থনার জন্যে থেমে যান এবং তাঁর পুত্র ‘আমর ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর শাহাদতের উপর সমবেদনাসূচক কালেমা পাঠ করে তাঁকে সান্ত্বনা দেন এবং ধৈর্য্যধারণের উপদেশ দেন। তখন তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যখন আমি আপনাকে নিরাপদ দেখতে পেয়েছি তখন সব বিপদই আমার কাছে অতি নগণ্য।’ তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উহুদের শহীদদের জন্যে দু‘আ করেন এবং বলেন, ‏‏(‏يَا أُمَّ سَعْدٍ، أَبْشِرِيْ وَبَشِّرِيْ أَهْلَهُمْ أَنْ قَتْلاَهُمْ تَرَافَقُوْا فِي الْجَنَّةِ جَمِيْعًا، وَقَدْ شَفَعُوْا فِيْ أَهْلِهِمْ جَمِيْعاً‏‏‏) ‘হে উম্মু সা‘দ (রাঃ) তুমি খুশী হয়ে যাও এবং শহীদদের পরিবারের লোকদেরকে সুসংবাদ শুনিয়ে দাও যে, তাঁদের শহীদরা সবাই এক সাথে জান্নাতে রয়েছে। আর তাঁদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে তাঁদের সবারই শাফাআত কবুল করা হবে।’

সা‘দ (রাঃ)-এর মাতা (রাঃ) তখন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্যেও দু‘আ করুন।’ তিনি বললেন,(‏اللّٰهُمَّ أَذْهِبْ حُزْنَ قُلُوْبِهِمْ، وَاجْبِرْ مُصِيْبَتِهِمْ، وَأَحْسِنْ الخَلْفَ عَلٰى مَنْ خُلِّفُوْ) ‘হে আল্লাহ! তাঁদের অন্তরের দুঃখ দূর করে দিন, তাঁদের বিপদের বিনিময় প্রদান করুন এবং জীবিত ওয়ারিসদেরকে উত্তমরূপে দেখা শোনা করুন।’[3]

[1] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড, ৯৯ পৃঃ।

[2] ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড, ৯৯ পৃঃ।

[3] আস সীরাতুল হালবিয়্যাহ, ২য় খন্ড ৪৭ পৃঃ।