আর-রাহীকুল মাখতূম উহুদ যুদ্ধ (غَزْوَةُ أُحُدٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট সাহাবায়ে কিরামের একত্রিত হওয়ার সূচনা (بِدَايَةُ تَجَمُّعِ الصَّحَابَةِ حَوْلَ الرَّسُوْلِ ﷺ):

এ সব ঘটনা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একেবারে অকস্মাৎ এবং অত্যন্ত ত্বড়িৎ গতিতে সংঘটিত হয়ে যায়। অন্যথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাছাইকৃত সাহাবায়ে কেরাম, যারা যুদ্ধ চলাকালে প্রথম সারিতে ছিলেন, যুদ্ধের পট পরিবর্তন হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দ্রুতগতিতে আসেন যাতে তাঁর কোন অঘটন ঘটে না যায়। কিন্তু তাঁরা প্রথম সারিতে থাকার কারণে এ সব খবর জানতে পারেন নি। অতঃপর যখন তাঁদের কানে এ খবর পৌঁছল তখন তাঁরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দৌঁড়িয়ে আসলেন। কিন্তু যখন তাঁরা তাঁর নিকট পৌঁছলেন তখন তিনি আহত হয়েই গেছেন। ৬ জন আনসারী শহীদ হয়েছেন এবং সপ্তম জন আহত হয়ে পড়ে আছেন। আর সা‘দ (রাঃ) এবং ত্বালহাহ (রাঃ) প্রাণপণে যুদ্ধ করে শত্রুদেরকে প্রতিহত করছেন। তাঁরা পৌঁছা মাত্রই নিজেদের দেহ ও অস্ত্র দ্বারা নাবী (ﷺ)-এর চতুর্দিকে বেড়া তৈরি করে দেন এবং শত্রুদের ভীষণ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দেন। যুদ্ধের সারি হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট যাঁরা ফিরে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্ব প্রথম ছিলেন তাঁর গুহার বন্ধু আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)।

ইবনু হিববান (রঃ) তার ‘সহীহ’ গ্রন্থে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ বাকর (রাঃ) বলেছেন, ‘উহুদ যুদ্ধের দিন সমস্ত লোক নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট হতে চলে গিয়েছিলেন (অর্থাৎ রক্ষকগণ ছাড়া সমস্ত সাহাবী তাঁকে তাঁর অবস্থানস্থলে রেখে যুদ্ধের জন্যে আগের সারিতে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর কাফিরদের দ্বারা মুসলিমগণ পরিবেষ্টিত হওয়ার পর) আমি সর্বপ্রথম তাঁর নিকট ফিরে আসি। দেখি যে, তাঁর সামনে একজন মাত্র লোক রয়েছেন যিনি তাঁর পক্ষ হতে যুদ্ধ করছেন এবং তাঁকে রক্ষা করছেন। আমি (মনে মনে) বললাম, ‘তুমি ত্বালহাহ (রাঃ)-ই হবে। তোমার উপর আমার পিতামাতা উৎসর্গিত হোক! ইতোমধ্যে আবূ উবাইদাহ ইবনু জাররাহ (রাঃ) আমার নিকট এসে পড়েন। তিনি এমনভাবে দৌড়াচ্ছিলেন যেন পাখী (উড়ছে), শেষ পর্যন্ত তিনি আমার সাথে মিলিত হয়ে যান। এখন আমরা দুজন নাবী (রাঃ)-এর দিকে দৌঁড় দেই। তাঁর সামনে ত্বালহাহ (রাঃ) অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ে রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে বললেন,

‏(‏دُوْنَكُمْ أَخَـاكُمْ فَقَـدْ أَوْجَبَ‏)‏

‘তোমাদের ভাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর শুশ্রূষা কর। সে জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে।’

আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেন, আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা মুবারক আহত হয়েছে এবং শিরস্ত্রাণের দুটি কড়া চক্ষুর নীচে গন্ডদেশে ঢুকে আছে। আমি কড়া দুটি বের করতে চাইলে আবূ উবাইদাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমি আল্লাহর নাম নিয়ে বলছি যে, এ দু'টি আমাকেই বের করতে দিন।’ এ কথা বলে তিনি দাঁত দিয়ে একটি কড়া ধরলেন এবং ধীরে ধীরে বের করতে শুরু করলেন, যেন তিনি কষ্ট না পান। শেষ পর্যন্ত তিনি কড়াটি টেনে বের করলেন বটে, কিন্তু তাঁর নীচের একটি দাঁত ভেঙ্গে পড়ে গেল। এখন দ্বিতীয় কড়াটি আমিই বের করতে চাইলাম। কিন্তু এবারও তিনি বললেন, ‘আবূ বাকর (রাঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আপনাকে আমি বলছি যে, এটাও আমাকেই বের করতে দিন।’ এরপর দ্বিতীয়টিও তিনি আস্তে আস্তে টেনে বের করলেন। কিন্তু তাঁর নীচের আর একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- বললেন,

‏(‏دُوْنَكُمْ أَخَـاكُمْ فَقَـدْ أَوْجَبَ‏)‏

‘তোমাদের ভাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর শুশ্রুষা কর, সে জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে।’

আবূ বাকর (রাঃ) বললেন এখন আমরা ত্বালহাহ (রাঃ)-এর দিনে মনোযোগ দিলাম এবং তাঁকে সামলিয়ে নিলাম। তাঁর দেহে দশটিরও বেশী যখম হয়েছিল। ত্বালহাহ (রাঃ) ঐ দিন প্রতিরোধ ও যুদ্ধে কত বীরত্বের সাথে কাজ করেছিলেন এর দ্বারা তা সহজেই অনুমান করা যায়।[1]

আর এ সংকটময় মুহূর্তেই প্রাণ নিয়ে খেলাকারী সাহাবাদের (রাঃ) একটি দলও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চতুর্দিকে এসে পড়েন। তাঁরা হলেন, আবূ দুজানা (রাঃ), আবূ মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ), মালিক ইবনু ত্বালিব (রাঃ), সাহল ইবনু হুনায়েফ (রাঃ), মালিক ইবনু সিনান (রাঃ), আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর পিতা, উম্মু আম্মারা রাহনুসাইবাহ বিনতু কাব মায়িনিয়্যাহ (রাঃ), কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ), উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ), হা’তিব ইবনু আবী বলতাআহ (রাঃ) এবং আবূ ত্বালহাহ (রাঃ)।

[1] যা’দুল মাআ’দ, ২য় খন্ড ৯৫ পৃঃ।