আর-রাহীকুল মাখতূম উহুদ যুদ্ধ (غَزْوَةُ أُحُدٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
মুসলিমগণের মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ততা (تَبَدُّدُ الْمُسْلِمِيْنَ فِيْ الْمَوْقِفِ):

যখন মুসলিমরা ভিড়ের মধ্যে এসে পড়েন তখন একটি দল তো জ্ঞানই হারিয়ে ফেলে। তাদের শুধু নিজেদের জীবনের চিন্তা ছিল। সুতরাং তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে দিয়ে পলায়নের পথ ধরল। পিছনে কী ঘটছে তার কোন খবরই তাদের ছিল না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো পালিয়ে গিয়ে মদীনায় ঢুকে পড়ে এবং কিছু লোক পাহাড়ের উপর উঠে পড়ে। আর একটি দল পিছনে ফিরল তারা মুশরিকদের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়। একে অপরকে চিনতে অসমর্থ হয়। এর ফলে মুসলিমগণেরই হাতে কোন কোন মুসলিম নিহত হয়। যেমন সহীহুল বুখারীতে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, উহুদ যুদ্ধের দিন (প্রথমে) মুশরিকরা পরাজিত হয়। এরপর ইবলীস (সাধারণভাবে) ডাক দিয়ে বলে, ‘ওরে আল্লাহর বান্দারা পিছনে (অর্থাৎ পিছন দিক হতে আক্রমণ কর)।’ তার এ কথায় সামনের সারির সৈন্যরা পিছন দিকে ফিরে আসে এবং পিছনের সারির সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হুযাইফা (রাঃ) দেখেন যে, তাঁর পিতা ইয়ামানের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। তিনি তখন বলে ওঠেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! ইনি যে আমার পিতা।’ কিন্তু আল্লাহর শপথ! (মুসলিম) সৈন্যগণ আক্রমণ হতে বিরত হলেন না। শেষ পর্যন্ত আমার পিতা নিহতই হয়ে গেলেন। হুযাইফা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ আপনাদেরকে ক্ষমা করুন।’ উরওয়া (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! হুযাইফা (রাঃ)-এর মধ্যে সদা-সর্বদা কল্যাণ বিরাজমান ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহ তা‘আলার সাথে মিলিত হন।’[1]

মোট কথা, এ দলের সারিতে কঠিন বিক্ষিপ্ততা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। বহু লোক চিন্তান্বিত ও পেরেশান ছিলেন। তাঁরা কোন্ দিকে যাবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় কোন ঘোষণাকারীর ঘোষণা শোনা গেল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন। এ ঘোষণা শুনে তারা জ্ঞান হারা হয়ে গেলেন। অধিকাংশ লোকেরই সাহস ও উদ্যম নষ্ট হয়ে গেল। কেউ কেউ যুদ্ধ বন্ধ করে দিল এবং দুঃখিত হয়ে অস্ত্র শস্ত্র ফেলে দিয়ে কেউ কেউ এ চিন্তাও করল যে, মুনাফিক্বদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই-এর সাথে মিলিত হয়ে তাকে বলা হোক যে, সে যেন আবূ সুফইয়ানের নিকট তাদের জন্যে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে।

কিছুক্ষণ পর ঐ লোকদের পাশ দিয়ে আনাস ইবনু নাযর (রাঃ) গমন করেন। তিনি দেখেন যে, তারা হাতের উপর হাত ধরে পড়ে আছে। তাদেরকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কিসের অপেক্ষা করছ?’ তাঁরা উত্তরে বলল, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিহত হয়েছেন।’ তাদের এ কথা শুনে আনাস ইবনু নাযর (রাঃ) তাদেরকে বললেন, ‘তাহলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যুর পর তোমরা জীবিত থেকে কী করবে? উঠো, যার উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবন দিয়েছেন তার উপর তোমরাও জীবন দিয়ে দাও।’ এরপর তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! ঐ লোকগুলো অর্থাৎ মুসলিমরা যা কিছু করেছে সে জন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আর ওরা অর্থাৎ মুশরিকরা যা কিছু করেছে তার সাথে আমার সম্পর্কচ্ছেদ করছি।’ এ কথা বলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হলেন। সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর সাথে দেখা হলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হে আবূ উমার (রাঃ)! কোথায় যাচ্ছেন?’ আনাস (রাঃ) উত্তরে বলেন, ‘জান্নাতের সুগন্ধি সম্পর্কে আর কী বলব! হে সা‘দ (রাঃ)! আমি ওর সুগন্ধ অনুভব করছি।’ এরপর তিনি সামনের দিকে গেলেন এবং মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। যুদ্ধ শেষে তাঁকে চেনা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাঁর ভগ্নী শুধু তাঁর আঙ্গুলগুলোর পোর দেখে তাঁকে চিনতে পারেন। তাঁকে বর্শা, তরবারী এবং তীরের আশিটিরও বেশী আঘাত লেগেছিল।[2]

অনুরূপ সাবিত ইবনু দাহ্দাহ (রাঃ) স্বীয় কওমকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়ে থাকেন তবে জেনে রেখ যে, আল্লাহ জীবিত রয়েছেন। তিনি মরতে পারেন না। তোমরা তোমাদের দ্বীনের জন্যে যুদ্ধ করে যাও। আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য ও বিজয় দান করবেন।’ তার এ কথা শুনে আনসারের একটি দল উঠে পড়েন এবং সা’বিত (রাঃ) তাদের সহায়তায় খালিদের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর উপর হামলা করেন এবং যুদ্ধ করতে করতে খালিদের বর্শার আঘাতে শহীদ হয়ে যান। তার মতো তার সঙ্গীরাও যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত লাভ করেন।’[3]

একজন মুহাজির সাহাবী একজন আনসারী সাহাবীর পাশ দিয়ে গমন করেন। যিনি রক্ত রঞ্জিত ছিলেন। মুহাজির তাঁকে বলেন, ‘হে অমুক ভাই! আপনি তো অবগত হয়েছেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন।’ তখন ঐ আনসারী বললেন, ‘যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়ে থাকেন তবে জেনে রাখুন যে, তিনি আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। এখন আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে ঐ দ্বীনের হিফাযতের জন্যে যুদ্ধ করা।’[4]

এরূপ সাহস ও উদ্যম বৃদ্ধিকারী কথায় মুসলিম সৈন্যদের উদ্যম বহাল হয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞান ও চেতনা জাগ্রত হয়। সুতরাং তাঁরা তখন অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দেয়া অথবা ইবনু উবাই এর সাথে মিলিত হয়ে নিরাপত্তা প্রার্থনার চিন্তার পরিবর্তে অস্ত্রশস্ত্র উঠিয়ে নেন এবং মুশরিকদের সাথে মোকাবালা করে তাঁদের অবরোধ ভেঙ্গে দেন ও তাঁদের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে নেয়ার চেষ্টায় রত হয়ে যান।

এ সময়েই তাঁরা এটাও অবগত হন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিহত হওয়ার সংবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এর ফলে তাঁদের শক্তি আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তাঁদের উদ্যম ও উদ্দীপনায় নাবীনতা এসে যায়। সুতরাং তারা এক কঠিন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অবরোধ ভেঙ্গে দিয়ে ভিড় হতে বের হতে এবং এক মজবুত কেন্দ্রের চতুর্দিকে একত্রিত হতে সফলকাম হন।

মুসলিম সেনাবাহিনীর তৃতীয় একটি দলের লোক ছিলেন তারা, যারা শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্পর্কেই চিন্তা করছিলেন। এরা এ ব্যবস্থাপনার কথা অবহিত হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে ফিরে আসেন। এদের মধ্যে অগ্রভাগে ছিলেন আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ), উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এবং আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ) প্রভৃতি মহান ব্যক্তিবর্গ। এরা যোদ্ধাদের প্রথম সারিতেও সকলের অগ্রগামী ছিলেন। কিন্তু যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর মহান ব্যক্তিত্বের জন্যে বিপদের আশংকা দেখা দিল, তখন তাঁর হিফাযত ও প্রতিরোধকারীদের মধ্যেও তাঁরা সকলের অগ্রগামী হন।

[1] সহীহুল বুখারী ১/৫৩৯, ২/৫৮১ ফাতহুলবারী ৭/৩৫১, ৩৬২, ৩৬৩ পৃঃ, বুখারী ছাড়া অন্য বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর দীয়াত দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু হুযায়ফা (রাঃ) বলেন যে, আমি তাঁর দীয়াত মুসলিম জাতিকে সদকা করে দিলাম। এ কারণে নাবী (সাঃ)-এর নিকটে হুযায়ফা (রাঃ)-এর মঙ্গল বৃদ্ধি পায়। মুখতাসারুস সীরাহ, শায়খ আব্দুল্লাহ ২৪৬ পৃঃ।

[2] যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯৩ ও ৯৬ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৯ পৃঃ।

[3] আস্সীরাতুল হালাবিয়াহ ২য় খন্ড ২২ পৃঃ।

[4] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ৯৬ পৃঃ।