এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দেন এবং যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে বলেন,

‏‏(‏وَالَّذِيْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا يُقَاتِلُهُمْ الْيَوْمَ رَجُلٌ فَيَقْتُلُ صَابِرًا مُحْتَسِبًا مُقْبِلًا غَيْرَ مُدْبِرٍ، إِلَّا أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ‏)

‘‘তোমরা আক্রমণ চালাও। যাঁর হাতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রাণ রয়েছে সেই সত্ত্বার শপথ! এদের মধ্যে যে ব্যক্তি যুদ্ধে অটল থেকে যুদ্ধ করাকে সওয়াব বা পুণ্য মনে করে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে পিছপা না হয়ে লড়াই করতে করতে মৃত্যুবরণ করবে আল্লাহ তাকে অবশ্য অবশ্যই জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত ও উৎসাহিত করতে গিয়ে আরো বলেন,

‏‏(‏قُوْمُوْا إِلٰى جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوَاتُ وَالْأَرْضُ‏)‏،

‘‘তোমরা ঐ জান্নাতের দিকে উঠে যাও যার প্রস্থ আসমান ও যমীনের সমান।’

একথা শুনে উমায়ের ইবনু হাম্মাম (রাঃ) বললেন, ‘খুব ভাল! খুব ভাল! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এ কথা কেন বললে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমি আশা রাখি যে, আমিও ঐ জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবো, এছাড়া অন্য কোন কথা নয়।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন ‘হ্যাঁ তুমিও ঐ জান্নাতবাসীদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।’ তারপর তিনি তার খাদ্য থলে হতে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘যদি আমি এ খেজুরগুলো খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত জীবিত থাকি তবে এটাও তো দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে।’ সুতরাং তিনি তার কাছে যে খেজুরগুলো ছিল সেগুলো ফেলে দিলেন। তারপর মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।

এভাবেই খ্যাতনামা মহিলা আফরার (রাঃ) পুত্র আউফ ইবনু হারিশ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের কোন্ কাজে খুশী হয়ে হেসে থাকেন’’? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তিনি বান্দার ঐ কাজে খুশী হয়ে হেসে থাকেন যে, সে অনাবৃত দেহে (যুদ্ধে দেহ রক্ষক পোষাক পরিধান না করেই ) স্বীয় হাত শত্রুদের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়’। একথা শুনে আউফ (রাঃ) দেহ হতে লৌহবর্ম খুলে নিয়ে নিক্ষেপ করলেন এবং তরবারী নিয়ে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।[1]

যে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাতে শত্রুদের আক্রমণের প্রচন্ডতা হ্রাস পেয়েছিল এবং তাদের উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। এজন্য এ কৌশলপূর্ণ পরিকল্পনা মুসলিমদের অবস্থান দৃঢ় করতে খুবই ক্রিয়াশীল হয়েছিল, কেননা, সাহাবীগণ (রাঃ) যখন আক্রমণ করার দির্দেশ পেলেন তখন ছিল তাঁদের জিহাদের উত্তেজনার যৌবনকাল। তাই তাঁরা এক দুর্দমনীয় ও ফায়সালাকারী আক্রমণ পরিচালনা করলেন। তাঁরা শত্রুদের সারিগুলোকে তছনছ ও এলোমেলো করে দিয়ে তাদের গলা কেটে কেটে সামনে অগ্রসর হয়ে গেলেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বর্ম পরিহিত অবস্থায় লাফাতে লাফাতে আসতে দেখে এবং শ্রীঘ্রই তারা পরাজিত হবে ও পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করবে, একথা স্পষ্টভাবে বলতে শুনে তাঁদের উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেলো। এ জন্যেই মুসলিমরা বীর বিক্রমে যু্দ্ধ করলেন এবং ফিরিশতারাও তাঁদেরকে সাহায্য করলেন। যেমন ইবনু সা'দের বর্ণনায় ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ দিন মানুষের মস্তক কেটে পড়ত, অথচ কে কেটেছে তা জানা যেত না এবং মানুষের হাত কর্তিত হয়ে পড়ে যেত, অথচ কে কর্তন করেছে তা জানা যেত না।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একজন মুসলিম একজন মুশরিককে তাড়া করছিলেন। হঠাৎ ঐ মুশরিকের উপর চাবুক মারার শব্দ শোনা গেল এবং একজন অশ্বারোহীর শব্দ শোনা গেল, যিনি বলছিলেন। ‘সম্মুখে অগ্রসর হও।’ মুসলিম মুশরিকটিকে তাঁর সামনে দেখলেন যে, সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল, তিনি লাফ দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, তার নাকের উপর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং অবয়র ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে যেন চাবুক দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। ঐ আনসারী মুসলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি সত্য কথা বলেছো। এটা ছিল তৃতীয় আসমানের সাহায্য।’’[2]

আবূ দাউদ মাযেনী বলেন, ‘আমি একজন মুশরিককে মারার জন্যে তাড়াতাড়ি করছিলাম। অকস্মাৎ তার মস্তকটি, আমার তরবারী ওর উপর পৌঁছার পূর্বে কেটে পড়ে যায়। আমি তখন বুঝতে পারলাম যে, তাকে আমি নই, বরং অন্য কেউ হত্যা করেছে।’

একজন আনসারী আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। তখন আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করেনি। একজন চুলবিহীন মাথাওয়ালা লোক যিনি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর এবং একটি বিচিত্র বর্ণের ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিলেন তিনি আমাকে বন্দী করেছিলেন। তাকে এখন আমি লোকজনদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না।’ আনসারী বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তাকে আমি বন্দী করেছি।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,

‏‏(‏اُسْكُتْ فَقَدْ أَيَّدَكَ اللهُ بِمَلَكٍ كَرِيْمٍ‏)‏‏

‘‘চুপ করো, আল্লাহ এক সম্মানিত ফিরিশতা দ্বারা তোমাকে সাহায্য করেছেন।’

‘আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে এবং আবূ বাকরকে বললেন, তোমাদের একজনের সাথে জিবরীল এবং আরেকজনের সাথে মিকাঈল ও ইসরাফীল (আঃ) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন।

[1] মুসলিম শরীফ ২/১৩৯ পৃঃ, মিশকাত ২/৩৩১ পৃঃ।

[2] মুসলিম শরীফ ২/৯৩ পৃঃ।